বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা বলা, পোশাক ও দিবস উদ্যাপনের মধ্যে উগ্রবাদের প্রভাব প্রকট হয়ে উঠছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক।
তাদের প্রণীত এক গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, তাঁরা দেখেছেন, সম্ভাষণ, বিদায়সহ দৈনন্দিন নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কথাবার্তায় আরবি শব্দের ব্যবহার বাড়ছে। নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে হিজাব, নেকাব পরা এবং ছেলেদের মধ্যে ওয়াহাবি মতাদর্শ অনুসরণকারীদের মতো গোড়ালির ওপর প্যান্ট পরার প্রবণতা বাড়ছে।(উল্লেখ্য, হিজাব-নেকাব, ও ছেলেদের গোড়ালির উপর প্যান্ট পরা ইসলামের বিধান, সেই বিধান পালন নিয়েই তারা উদ্বিগ্ন!!) বৈশাখের মতো বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন দিবস উদ্যাপন করার বিষয়ে কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাঁরা মঙ্গল শোভাযাত্রাকে হিন্দুধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ বলে মনে করেন।
গতকাল শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ‘বাংলাদেশ: ফেসিং চ্যালেঞ্জেস অব র্যাডিকালাইজেশন অ্যান্ড ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, অধ্যাপক আমেনা মহসিন ও অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন যৌথভাবে গবেষণাটি করেছেন। দুই দিনব্যাপী গণহত্যা ও গণসংঘাত-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের একটি অধিবেশনে এই গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।
গবেষকেরা জানান, তাঁরা গবেষণার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার নর্থ সাউথ ও মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
গবেষকদের একজন ছাত্র নাকি বলেছেন, সম্রাট আকবর পয়লা বৈশাখ প্রবর্তন করেছেন। আকবর তো মুসলমান ছিলেন না, তিনি দ্বীন-ই-ইলাহি নামে একটি ধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন। তরুণদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নিয়েও নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। (উল্লেখ্য, অসংখ্য ছাত্রদের কাছ থেকে মতামত নিলেও তাদের পছন্দমত একজনমাত্র ছাত্রের কথিত উদ্ধৃতিই ওনারা উল্লেখ করেছেন।)
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, তরুণদের মধ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়েও ক্ষোভ আছে। তাঁরা মনে করেন, দেশে কোনো নিয়মকানুন, ব্যবস্থা কাজ করে না। কেউ লেখাপড়া শেষ করে সঠিক উপায়ে চেষ্টা করে চাকরি পাবে, সে ভরসা নেই। এমন নানা বিষয় তাঁদের উগ্রবাদের প্রতি আকর্ষণ বাড়াচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের এভাবে প্রভাবিত হওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব কাজ করেছে বলে মনে করছেন গবেষকেরা। অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, দেখা গেছে, একজন শিক্ষার্থী ১৩ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত রয়েছেন। তাঁকে সে মাধ্যমে প্রভাবিত করা সহজ। নিউইয়র্কে হামলাকারী বাংলাদেশি তরুণ আকায়েদ উল্লাহর উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, এই তরুণ সামাজিক মাধ্যমে উগ্রবাদে যুক্ত হয়েছেন বলে বলা হচ্ছে।
প্রবন্ধে বলা হয়, একটি জঙ্গিবাদী ঘটনার পর রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে দায়ী করে। এ প্রবণতা উগ্রবাদবিরোধী কর্মকাণ্ডে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তখন রাজনৈতিক সংঘাত আর উগ্রবাদী তৎপরতার মধ্যে তফাত করা কঠিন হয়ে পড়ে। যদিও বাস্তবে দুটি আলাদা বিষয়।
প্রবন্ধে পাঁচটি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কোনোভাবেই উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক রং দেওয়া যাবে না। উগ্রবাদবিরোধী মতবাদকে শক্তিশালী করতে হবে। দেখা যায়, ফেসবুকে বাঁশের কেল্লার মতো গ্রুপগুলো উগ্রবাদ ছড়াচ্ছে। এদের পাল্টা মতবাদ তৈরি করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে উগ্রবাদবিরোধী উপাদান যুক্ত করা যেতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীরা বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করতে পারেন। আরবি ধর্মীয় বইগুলোর প্রচুর বাংলা অনুবাদ করতে হবে, যাতে মানুষ ধর্মের বিষয়গুলো নিজে নিজেই নিজের ভাষায় জানতে, বুঝতে পারে। সর্বোপরি জঙ্গিবাদ দমনের মতো বিষয়গুলোতে মানবাধিকারের বিষয়টিকে মাথায় রাখতে হবে।
এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক রওনক জাহান। তিনি বলেন, অন্যান্য ধর্মীয় উগ্রবাদের বিষয়ও এই আলোচনায় যুক্ত করা হলে আরও ভালো হতো। তিনি বলেন, উগ্রবাদীরা যে মতাদর্শ প্রচার করছে, তার বিপরীত মতাদর্শ (কাউন্টার ন্যারেটিভ) তৈরি করা দরকার। এটা অনেক চ্যালেঞ্জের বিষয়। সরকার অনেক টাকা খরচ করে এটা করতে পারে। তবে তা কতটা কার্যকর হবে, তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।
একই অধিবেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আরেক শিক্ষক নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস ‘কমিউনিটি এনগেজমেন্ট অ্যান্ড প্রিভেন্টিং ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম: দ্য কেস অব বাংলাদেশ’ নামের গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সেখানে তিনি বলেন, উগ্রবাদ দমনের জন্য সমাজের বিভিন্ন ধাপকে কার্যকরভাবে যুক্ত করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কমিউনিটি পুলিশ ও কমিউনিটি পুলিশের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা উগ্রবাদ দমনে তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতন নন।
প্রবন্ধ উপস্থাপন শেষে আলোচনায় অংশ নিয়ে গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোনো দোষ নেই। যাঁরা এর ব্যবহারকারী, তাঁরা এটাকে কীভাবে ব্যবহার করছেন, সেটা হচ্ছে বিষয়।
পরে উন্মুক্ত আলোচনায় উপস্থিত তরুণ শ্রোতারা(যারা ধর্মবিরোধী উগ্রবাদে বিশ্বাসী) ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরকারের সমঝোতা হয়েছে উল্লেখ করে এর সমালোচনা করেন।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো