শনিবার, ২৭শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি

‘শিখড়ের টানে শেকড় বিচ্ছিন্ন হওয়া’ – আব্দুল হাই

Khutbah Tv

তখনকার কথা । হবে হয়ত বছর বিশেক আগের। হিসেবটা ১৯-২০ হলেও বড় কোন ভুল হবে না। ‘অলক’ তখন ঢাকায় পড়াশোনা করে। পড়াশোনার চাপ আর টিউশনির দৌড়ে ঢাকার যান্ত্রিক জীবনটা অন্ত:সারশূন্য মনে হয়। সারাটা বছর মুখিয়ে থাকে পূজোর ছুটিটার জন্য। বাবার ¯স্নেহার্দ ডাক ‘অলক’ মায়ের মুখভরা মমতায় ‘খোকা’ ডাকটা যেন জীবন জাগানিয়া শক্তির অফুরান ফগ্লুধারার উৎস।


অর্ক আসে চট্টগ্রাম থেকে, টুটুন মুরাদনগর, জয় থাকে কুমিল্লায়। এই ছুটিটাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্মৃতিগুলোকে এক করে দেয়।

দিনভর হৈ-হল্লা, বিনোদন, খাওয়া-দাওয়া, চাটুজ্জেদের মন্ডপ হয়ে পরিমল কাকার মন্ডপ, তারপর সীতেশ দাদাদের বাড়ির সামনে বটতলার মন্ডপ, সন্ধ্যার আরতি, ধোপের গন্ধ, রমণীদের উলুধ্বনি, পুচকাপুচকিদের দৈাড়ঝাপ, প্রসাদ বিলি; এ এক উত্তেজনাকর মূহুর্ত।

Default Ad Content Here

Image may contain: 2 people, people sitting, beard and indoor

সময়গুলি কিভাবে কেটে যেত কখনও টের পেতাম না। ফেরার আগের দিন মায়ের পুঁটলি বাঁধা আমাকে জানান দিত, “আমার যাওয়ার সময় হলো, দাও বিদায়”। আঁচলে মুখ গুঁজে অভিযোগমাখা নির্দেশনা; “তোকে কত করে বলি খাবারটা ঠিকঠাকমত খেয়ে নিবি, অত রাত করে ন্যাকাপড়া করতে যেয়ে তোমার শরীরের ধ্বংস আমি হতে দেব না বাপু! তোমার বাবুর যে ব্যবসা আছে সেটা দেখলেই তোমরা দুইভাই দিব্যি ভালোয় ভালোয় চলে যেতে পারবে। ভগবানের আশীর্বাদে আমাদের এমনিতেই চলে যাবে, জানামতে তোর বাবা কারো অনিষ্টের চিন্তা করেনি কখনও, ভগবান তোদের অনিষ্ট করবে না।” অলক আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে মাকে প্রবোধ দেয়; মা তুমি আমার মঙ্গলের জন্য আশীর্বাদ করো।

বাড়ি থেকে হাঁটার দুরত্বে বাস স্ট্যান্ড, হেঁটে যেতে মিনিট পাঁচেক । তবুও বাবা রিক্সা নিয়ে হাজির বাড়ির বাইরে থেকেই হাঁক ছাড়ে- কোথায় অলকের মা ! ট্রেন মিস করবে তো। ওকে পাঠাও, রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে।

বাবার সাথে তেমন কোন কথা হয় না। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সকল শব্দ নিস্তব্ধতায় রূপ নেয়। বাবা-ই শুরু করেন হামেশা। অন্যায় কোন পথে হাঁটবে না কখনো, তোমার দাদা আজন্ম একজন সৎ পুরুষ। কেউ কোনদিন তোমার বংশের নামে খারাপ কথা রটাতে পারেনি। শরীরের প্রতি খেয়াল রেখো। টিউশনি করতে হবে না তোমার, আগামী মাস থেকে আমি টাকা আরো বাড়িয়ে পাঠাবো। নাহ বাবা, আমি টিউশনি করাই চর্চায় থাকার জন্য অন্যকিছু নয়, আর সেখানে চাপও কিছু নেই।

ট্রেন ছেড়ে চলে যায়, ঝক ঝকা ঝক শব্দে। ট্রেনের হুইসেলের শব্দ আর ফুঁপিয়ে উঠা অন্তরের কান্না এক হয়ে যায়। নির্নিমেষ চোখে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে থাকে বাবা।

রাত নেমে আসে সকল আলোকে দুরীভূত করে, সকাল হওয়া, আড়ৎ খোলা, টিউশনিতে দৌড়ানো, ক্লাস এ্যাটেন্ড, সব বয়ে চলে, থেমে থাকেনা কিছু।

পর্ব-২
সময়টা বর্তমান। আফরোজা এই সময়টাতে অনেক বেশি আবেগি হয়ে পড়ে। তাহাজ্জুদ এর সময় আলতো করে ডেকে তুলে। ঘুমকাতুরে খালেদের চোখ খুলতে গিয়েও খুলে না। পিটপিট করে তাকানো শেষে, আধোঘুমে প্রশ্ন সুধায়- ক’টা বাজে ? ৩টা বেজে ৪৮ মিনিট। একলাফে উঠে বসে খালেদ। ওযু শেষ করে লম্বা সূরায় তাহাজ্জুদ আদায়ান্তে কায়মনোবাক্য নিয়ে রবের দরবারে ফরিয়াদ উঠায়। সকল চাওয়া, ব্যাথা, ইচ্ছা, আকাঙ্খা পেশ করে রহমানের দরবারে। হেঁচকি উঠে, কান্নার রোল পরে, দমবন্ধ হয়ে যায়। রবের কাছে চাওয়া। ভেজালবিহীন নিরেট ভিখারীর মত।

সকাল সকাল সুমাইয়া, আব্দুল্লাহ নতুন সাজে বসে আছে। আজ দাদু বাড়ি যাবে, ওদের খুশিতে পুরো পৃথিবীটা যেন হাসছে, আনন্দে দোল খাচ্ছে। খালেদ ছেলে মেয়েকে নিয়ে পিত্রালয় অভিমুখে রওনা হলো। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই দৃষ্টিনিবদ্ধ হলো বাবার দিকে। বাবা একটি চেয়ারে বসে পত্রিকায় দৃষ্টি বুলাচ্ছেন। খালেদকে দেখামাত্রই বাবা চেয়ার ছেড়ে দৌড়ে আসলেন পুত্রের দিকে। ‘অলক’, বাবা এসেছিস ! কোথায় রে সুমন দেখ দেখ তোর দাদা এসেছে । আলিঙ্গনাবদ্ধ দুটি স্বত্বা একে অপরে শুধু জড়িয়েই থাকলো না এক হয়ে গেলো। ঔরসজাত সন্তানের দেহ ! বাক্যবিনিময় হয় না শুধু হেঁচকির শব্দ হয় ! বাবার শরীরের সেই চিরচেনা ঘ্রাণ, সেই চিরচেনা অনুভব। যতক্ষন শরীরের সাথে লেগে ততক্ষণ একটা শান্তি কাজ করে।
বোস বোস জার্নি করে ক্লান্ত হয়ে এসেছিস। সুমাইয়া-আব্দুল্লাহ দাদুর কোলে একরকম আছড়ে পড়লো দাদুউউউউ বলে । পরম মমতায় দাদু তাদেরকে বাহুডোরে আবদ্ধ করলেন। তোর মা বেঁচে থাকলে কতইনা খুশি হত তোদেরকে দেখে। গন্ডদেশ বেয়ে অঝোর ধারায় তপ্তজল গড়িয়ে পড়ে অনবরত। মায়ের যেদিন প্রয়াণ হলো অলকের সামনেই সুমন মায়ের মুখাগ্নি করল। অশ্রুবিসর্জন ছাড়া আর কীইবা করার ছিলো ! বিশ্বাসে তো জোরজবরদস্তি নেই। ঘৃণা নেই। আশা আছে, ভরসা আছে।

খালেদ আজও কায়মনোবাক্যে রবের দরবারে ফরিয়াদ করে সকল মঙ্গল দ্বারা যেন পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ সুশোভিত হয়। আলোকবর্তিকার সন্ধান পায়।

উৎসর্গ- অলক কান্তি থেকে হিজরত হওয়া অসংখ্য Khalid Saifullah সহ অসংখ্য মুহাজির ভাই-বোনদেরকে। যাদের শিখড়ের টানে শেকড়ের সাথে বিচ্ছেদ হয়।

নিজেকে ঐ অবস্থানে কল্পনাও করতে পারিনা। অন্তর ফেঁটে চৌচির হয়ে যায়। নিজেকে বড় অধম মনে হয়।

শুধু এতটুকুনই বলা এই কুরবানীর বদলা উপরওয়ালাই বুঝিয়ে দিবেন ইনশাআল্লাহ।

Archives

January 2025
S S M T W T F
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031