বুধবার, ৯ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ই মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

কা’বা ঘরে মাদার মেরির ছবি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ভিত্তিহীন তথ্য !

কা’বা ঘরে মাদার মেরির ছবি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ভিত্তিহীন তথ্য !
আরিফুল ইসলাম
…………………………………………………………..
১।
আমার পড়া হুমায়ূন আহমেদের প্রথম বই হিজিবিজি। এরপর একে একে হিমু সিরিজ, মিসির আলী সিরিজ, শুভ্র সিরিজের প্রায় সবগুলো বই পড়েছি। ২০১৭ সালে যে একক লেখকের সর্বোচ্চ বই পড়েছি তিনিও হুমায়ূন আহমেদ। অদ্যাবধি আমার প্রিয় লেখকদের একটা লিস্ট করলে হুমায়ূন আহমেদকে আমার পছন্দের লিস্টে রাখবো।
 
তথাপি হুমায়ূন আহমেদ স্যারের কিছু লেখা পড়ে বিভ্রান্ত হয়েছি। তারমধ্যে একটি ছিলো কুকুর নিয়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম এর হাদীসের নামে উনার এক অপব্যাখ্যা, হিজিবিজি বইয়ে। ঠিক একই বইয়ে কা’বা ঘরে মাদার মেরির ছবি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এক ভিত্তিহীন তথ্য দেন। হয়তো উনার অজ্ঞতাবশত কিংবা ইচ্ছাকৃত এরকম ভিত্তিহীন তথ্য পরবর্তীতে ইসলাম বিদ্বেষীরা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছে।
 
হিজিবিজি ৯৫ পৃষ্ঠায় ‘এখন কোথায় যাব,কার কাছে যাব?’ শিরোনামে লিখা কা’বা ঘরে মাদার মেরির ছবি অপসারণ করতে নবী সা: এর অনীহা প্রকাশের কাহিনী নামে এক ভিত্তিহীন তথ্য প্রকাশ করেছেন যা ২৭ অক্টোবর ২০০৮ সালে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়।
 
গত কয়েকমাস আগে সুপ্রিম কোর্টে গ্রীক দেবীর মূর্তি অপসারণের সময় বামপন্থি লেখক এবং বিভিন্ন পত্রিকা নবী সা: এর মাদার মেরির ছবি সংরক্ষণের ইতিহাস টানতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এই কাহিনীটা উল্লেখ করেছে।
 
২।
হূমায়ুন আহমেদ বইটিতে যা উল্লেখ করেন তা হলো:
 
‘‘আমাদের মহানবী (সা.) কাবা শরীফের ৩৬০টি মূর্তি অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেয়ালের সব ফ্রেসকো নষ্ট করার কথাও তিনি বললেন। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ল কাবার মাঝখানের একটি স্তম্ভে, যেখানে বাইজেন্টাইন যুগের মাদার মেরির একটি অপূর্ব ছবি আঁকা। নবীজী (সা.) সেখানে হাত রাখলেন এবং বললেন,
‘এই ছবিটা তোমরা নষ্ট করো না।’ কাজটি তিনি করলেন সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর অসীম মমতা থেকে। মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের পরেও ৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ধর্মপ্রাণ খলিফাদের যুগে কাবা শরীফের মতো পবিত্র স্থানে এই ছবি ছিল, এতে কাবা শরিফের পবিত্রতা ও শালীনতা ক্ষুণ্ণ হয়নি।
 
মহানবীর (সা.) প্রথম জীবনীকার ইবনে ইসহাকের (আরব ইতিহাসবিদ, জন্ম : ৭০৪ খৃষ্টাব্দ, মদীনা, মৃত্যু : ৭৬৭ খৃষ্টাব্দ, বাগদাদ) লেখা দি লাইফ অব মোহাম্মদ গ্রন্থ থেকে ঘটনাটি বললাম। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বইটি অনুবাদ করেছেন আলফ্রেড গিয়োম (প্রকাশকাল ২০০৬, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫৫২)’’
 
৩।
রেফারেন্স হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন মুহাম্মদ সা: এর জীবনী নিয়ে ইবনে ইসহাকের লিখা গ্রন্থ থেকে যা অনুবাদ করেন আলফ্রেড গিয়োম ১৯৫৫ সালে।
 
আদতে আলফ্রেড গিয়োম ইবনে ইসহাকের গ্রন্থ থেকে তার ‘Life of Muhammad’ গ্রন্থটি সংকলন করেননি!
 
ইবনে ইসহাকের লিখা মুহাম্মদ সা: এর জীবনী গ্রন্থটি নষ্ট হয়ে যায়,পরে তার ছাত্র ‘যিয়াদ আল বাক্কানী’ সেগুলো সম্পাদনা করেন, দূর্ভাগ্যবশত সেগুলোও নষ্ট হয়ে গেলে বাক্কানীর ছাত্র ইবনে হিশাম সেগুলো সম্পাদনা করেন এবং ইবনে ইসহাকের ভিত্তিহীন তথ্যগুলো বাদ দেন। ভিত্তিহীন তথ্য বলতে যেগুলোর সনদ সহীহ নয় এবং তাদলীসের প্রবণতা আছে।
ইবনে হিসামের সিরাত গ্রন্থ এতে করে নবী সা: এর নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থ হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করে।
 
আলফ্রেড গিয়োম মূলত ইবনে হিশামের সিরাত গ্রন্থ থেকে তার বইটি লিখেন কিন্ত বইয়ের প্রচ্ছদে ইবনে ইসহাকের সংকলন বলে উল্লেখ করেন। তার কারণ ইবনে হিশাম থেকে যেসব বর্ণনা ইবনে ইসহাক কর্তৃক বর্ণিত সেগুলোই কেবল তিনি তার Life of Muhammad গ্রন্থে সংকলন করেন।
 
পাশাপাশি আলফ্রেড গিয়োম কিছু তথ্য উল্লেখ করেন যা ইবনে হিশাম বা ইবনে ইসহাক কর্তৃক বর্ণিত হয়নি,সেগুলো তিনি ব্রেকেটের বর্ণনা করেন।
হুমায়ূন আহমেদ স্যার আলফ্রেড গিয়োমের গ্রন্থ থেকে যা বর্ণনা করেন সেটি ঐ ব্রেকেটেরই অংশ। সরাসরি ইবনে ইসহাক বা ইবনে হিসাম থেকে প্রাপ্ত তথ্য নয়।
 
৪।
আলফ্রেড গিয়োম তার গ্রন্থের ৫৫২ পৃষ্ঠায় যা উল্লেখ করেন তা হলো:
I. I. From Hakim b.`Abbad b. Hanif and other traditionists : Quraysh had put picturers in the Ka’ba including two of Jesus son of Mary and Mary (on both of whom be peace!)
 
1. Shihab said : Asma’ b. Shaqr said that a woman of Ghassan joined in the pilgrimage of the Arabs and when she saw the picture of Mary in the Ka’ba she said, `My father
and my mother be your ransom! You are surely an Arab woman!’ The apostle ordered that the pictures should be erased except those of Jesus and Mary.
 
হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে আলফ্রেড গিয়োমের কাহিনী বর্ণনা করেন,আদতে আলফ্রেড গিয়োম সেরকম কাহিনী উল্লেখই করেননি!
তিনি(আ.গি) যা উল্লেখ করেছেন তা ইবনে ইসহাক থেকে নয় বরং আযরাকীর ‘আখবারু মক্কা’ নামক গ্রন্থ থেকে।
 
এখন প্রশ্ন জাগে,আযরাকী কে ছিলেন?
 
আযরাকী ইবনে ইসহাকের ছাত্রও ছিলেন না এমনকি কোনো নির্ভরযোগ্য রাবী ও ছিলেন না।
বুখারী,মুসলিম কিংবা সিহাহ সিত্তার কোনো গ্রন্থেই আযরাকীর কোনো বর্ণনার উদ্ধৃতি দেওয়া হয়নি।
 
তার গ্রন্থ ‘আখবারু মক্কায়’ ইবনে শিহাবের বর্ণনায় যে কাহিনী বলা হয়েছে সেটাও ইবনে শিহাব বলেছেন কোনো সূত্র ছাড়া।অর্থাৎ তাদলীসের প্রবণতা বা মাঝখানের সূত্রের অনুপস্থিতি।
যেখানে ইবনে শিহাবের জন্ম ৫০ হিজরীতে এবং মক্কা বিজয় হয় ৮ম হিজরীতে সেখানে কিভাবে ইবনে শিহাব কোনো সূত্র ছাড়া সেই কাহিনী এমনভাবে বর্ণনা করেন যা দেখে মনে হয় তিনি নিজেই তখন উপস্থিত ছিলেন যখন কা’বা ঘরে মূর্তি ভাঙ্গা হয়!
 
৫।
নবী সা: যে কাবা ঘরের মূর্তি ভাঙ্গার আগে এবং ছবি অপসারণ করার আগে প্রবেশ করেননি সেই সংক্রান্ত সহীহ হাদীসগুলো দেখে নেয়া যাক:
 
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় এলেন তখন বাইতুল্লাহ্য় মিথ্যা উপাস্যদের থাকা অবস্থায় তাতে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। তাঁর আদেশে ওই মূর্তি ও প্রতিকৃতিগুলো বের করা হল। এগুলোর মধ্যে ইবরাহীম আ. ও ইসমাঈল আ.-এরও প্রতিকৃতি ছিল। তাঁদের হাতে ছিল ভাগ্যনির্ধারণী শর! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ ওদের ধ্বংস করুন, তাদের জানা ছিল যে, এই দুইজন কখনও শর দ্বারা ভাগ্যগণনার চেষ্টা করেননি।
(সহীহ বুখারী হা. ৪২৮৮,১৬১৯; সুনানে আবু দাউদ হা. ২০২০)
 
জাবির রা. থেকে বর্ণিত, মক্কাবিজয়ের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমর ইবনুল খাত্তাব রা.কে আদেশ দিলেন, তিনি যেন কাবা ঘরের সব ছবি মুছে ফেলেন। সকল ছবি মোছার আগ পর্যন্ত তিনি কাবায় প্রবেশ করেননি। (সুনানে আবু দাউদ হা. ৪১৫৩; সহীহ ইবনে হিববান হা. ৫৮৫৭; তবাকাতে ইবনে সা’দ খ : ২, পৃষ্ঠা : ৩২০ আরো দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা খন্ড : ২০, পৃষ্ঠা : ৪৭৯ হা. ৪/৩৮০৭৪)
 
তথ্যসূত্র :
১। হিজিবিজু – হুমায়ূন আহমেদ।
২। Life of Muhammad – Alfred Guillaume
৩। প্রথম আলো – ২৭ অক্টোবর ২০০৮।
৪। মাসিক আল কাউছার।
৫। Wikipedia – Alfred Guillaume.
 
আরিফুল ইসলাম (লেখক,আর্গুমেন্টস অব আরজু)

Archives

July 2024
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031