শনিবার, ২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

সিরাতে মুস্তফা (সঃ) (পর্ব ০৪) :: রাবিয়া ইবনে নসরের স্বপ্ন

This entry is part 4 of 12 in the series সিরাতে মুস্তফা (সঃ)

রাবিয়া ইবনে নসরের স্বপ্নঃ 

রাজাদের মধ্যে ইয়ামানের রাবিয়া ইবনে নসর একজন দুর্বল পরাধীন রাজা ছিলেন।একবার তিনি একটা ভয়ংকর সপ্ন দেভে ভীষণভাবে ঘাবড়ে যান। তাঁর রাজ্যে যত গণক, যাদুকর, আয়েফ [৬. তৎকালে এক ধরনের গণক ছিল যারা পখির ডাক, গতিবিধি ইত্যাদি দ্বারা ভবিষ্যদ্বাণী করতো। তাদেরকে বলা হতো আয়েফ।]

বা জ্যোতিষী ছিল তাদের সবাইকে তিনি সমবেত করে বলেন, “আমি এমন একটা স্বপ্ন দেখেছি যা আমাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। তোমরা আমাকে বলবে আমি কি স্বপ্ন দেখেছি এবং তার ত’বীরই বা কি?” সমবেত জ্যোতিষীরা বললো, “সপ্নটা আমাদের কাছে বর্ণনা করুন। আমরা তার তাবীর বলবো।” রাজা বললেন, “স্বপ্নটা যদি আমি বলে দিই তাহলে তোমাদের তাবীরে আমি স্বস্তি বা প্রশান্তি লাভ করতে পারবো না। কেননা এই স্বপ্নের তা’বীর বা ব্যাখ্যা একমাত্র সে-ই করতে সক্ষম যে আমার বলার আগেই স্বপ্ন সম্পর্কেও বলতে সক্ষম।” জ্যোতিষীদের একজন বললো, ‘জাঁহাপনা, যদি এইভাবে স্বপ্নের তা’বীর জানতে চান তাহলে সাতীহ ও শেক্কে ডেকে পাঠান। কারণ তাদের চেয়ে পারদর্শী আর কেউ রনই। আপনি যা জানতে চান তা তারাই বলতে পারবে।”

Default Ad Content Here

রাজা ঐ দ’জন ভবিষ্যদ্বক্তাকে ডেকে পাঠালেন। প্রথমে রাজার দরবারে হাজির হলো সাতীহ। রাজা তাকে বললেন, “আমি এমন একটা স্বপ্ন দেখেছি যা আমাকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। তুমি বল আমি কি স্বপ্ন দেখেছি? তুমি যদি স্বপ্নটা সঠিকভাবে বলতে পার তাহলে তার ব্যাখ্যাও সঠিকভাবে করতে পারবে।”

সাতীহ বললো, “বেশ, আমি তাই করবো। আপনি স্বপ্নে দেখেছেন, অন্ধকারের ভেতর থেকে এক টুকরো আগুন বেরিয়ে এসে নিম্নভূমিতে নামলো এবং সেখানে যত প্রাণী ছিল, সবাইকে গ্রাস করলো।”

রাজা বললেন, ‘বাহ্! স্বপ্নটা তো তুমি সঠিকভাবেই বলে দিয়েছ। এখন বলতো এর তাৎপর্য কি?”

সে বললো, “দুই প্রস্তরময় দেশে বিরাজমান সমস্ত সাপের শপথ করে বলছি, আবিসিনিয়াবাসী আপনার ভূখন্ডে প্রবেশ করবে এবং সমগ্র ইয়ামান দখল করে নেবে।”রাজা বললেন, “হে সাতীহ, এটাতো ভীষণ বেদনাদায়ক ও ক্রোধোদ্দীপক ব্যাপার।

এটা কবে ঘটবে? আমার আমলেই, না আমার পরে।?”

সে বললো, “আপনার আমলের কিছু পরে, ষাট বা সত্তর বছরের বেশী অতিক্রান্ত হয়ে যাবে।” রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “এই ভূখন্ঠ কি চিরকালই তাদের অধিকারে থাকবে, না তাদের জবরদখলের অবসান ঘটবে?” সে বললো, “৭০ বছরের কিছু বেশীকাল উত্তীর্ণ হবার পর তাদের দখলের অবসান ঘটবে? তারপর তারা হয় নিহত হবে নয়তে পালিয়ে যাবে। রাজা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “তাদেরকে কে হত্যা বা বহিষ্কার করবে?” সাতীহ বললো, “তারা নিহত বা বহিষ্কৃত হবে ইরাম ইবনে যীইয়াযানের হাতে। তিনি এডেন থেকে আবির্ভূত হবেন এবং ইয়ামানে তাদের একজনকেও অবশিষ্ট রাখবেন না।”

রাজা বললেন,“ইরামের আধিপত্য কি চিরস্থায়ী হবে না অস্থায়ী?”

সাতীহ বললো, “তাদের আধিপত্য অস্থায়ী হবে।”

রাজা বললেন, ’‘কার হাতে ক্ষমতার অবসান ঘটবে।?”

সাতীহ বললো,“এক পূত:পবিত্র নবীর হাতে। তিনি ঊর্ধজগত থেকে ওহী লাভ করবেন।”

রাজা বললেন, “এ নী কোন বংশোদ্ভূত?”

সাতীহ বললো,“তিনি নাদারের পুত্র মালেকের পুত্র ফিহির, ফিহিরের পুত্র গালেবের বংশ থেকে উদ্ভূত হবেন। তাঁর জাতির তাতে ক্ষমতা থাকবে বিশ্বজগতের বিলুপ্তি ঘটার মুহূর্ত পর্যন্ত।”

রাজা  বললেন, “বিশ্বজগতের আবার শেষ আছে নাকি?”

সে বললো,“হ্যাঁ, যেদিন পৃথিবীর প্রথম মানবগন ও শেষ মানবগণ একত্রিত হবে। যারা সৎকর্মশীল তারা সুখী হবে, আর যারা অসৎকর্মশীল তারা দুঃখ ভোগ করবে।”

রাজা বললেন,“তোমার ভবিষ্যদ্বাণী কি সত্য?”

সে বললো, “হ্যাঁ, রাতের অন্ধকার ও ঊষার আলোর শপথ, সুবিন্যস্ত প্রভাতের শপথ, আমি যা বলেছি তা পুরোপুরি সত্য।”

এরপর শেক এসে পৌঁছলো রাজার দরবারে। সাহীহকে রাজা যা যা বলেছিলেন শেককেও তাই বললেন। কিন্তু সাতীহ যা বলেছে তা তাকে জানতে দিলেন না- তারা উভয়ে একই ধরনের ভবিস্যদ্বাণী করে, না ভিন্ন রকমের, তা দেখবার জন্য তিনি ব্যাপারটা গোপন করলেন।

শেক বললো, “আপনি স্বপ্নে দেখেছেনে, অন্ধকার থেকে এবটি অগ্নিশিখা বেরিয়ে এলো। সেটা একটা পর্বত ও একটা বাগানের মাঝখানে পতিত হলো। অতঃপর সেখানকার সকল প্রণীকে গ্রাস করলো।”

রাজা বুঝতে পারলেন যে, উভয়ের বক্তব্য অভিন্ন। শুধু এতটুকু পার্থক্য যে সাতীহ বলেছিল, টুকরোটা নিম্নভূমিতে নামলো। আর শেক বলেছে, একটি পর্বত ও একটি বাগানের মাঝখানে নামলো। অতঃপর তিনি শেককে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ। এবার বল এর তাবীর কি?”

সে বললো,“ দুই পর্বতাকীর্ণ দেশের সমস্ত মানুষের শপথ করে বলছি, আপনার দেশে সুদানীরা আক্রমণ চালাবে এবং সব দুর্বল লোক তাদের অঙ্গুলী হেলনে চলতে বাধ্য হবে। তারা আবইয়ান থেকে নাজরান পর্বত সমগ্র ভূখ-ের ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে।”

রাজা বললেন, “এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও ক্রোধোদ্দীপক ব্যাপার। এ ঘটনা কবে ঘটবে? আমার জীবদ্দশাতেই, না আরো পরে?”

সে বললো, “আপনার পরে বেশ কিছুকাল অতিক্রান্ত হবার পর। এরপর একজন পরাক্রমশালী ব্যক্তি আপনাদেরকে উদ্ধার করবে এবং হানাদারদেরকে ভীষণভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে বিতাড়িত করবে।”

রাজা বললেন, “এই পরাক্রমশালী ব্যক্তি কে?”

সে বললো, “একজন যুবক, যিনি নগণ্য বা নীচাশয় নয়। যী-ইয়াযানের বাড়ী থেকে তার অভ্যুদয় ঘটবে। তিনে হানাদারদের একজনকেও ইয়ামানে টিকতে দেবেন না।”

রাজা বললেন, “এই ব্যক্তির শাসন কি চিরস্থায়ী হবে না ক্ষণস্থায়ী?”

শেক বললো একজন প্রেরিত রাসূলের আগমনে তার শাসনের অবসান ঘটবে-যিনি সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন, ধার্মিক ও সজ্জনদের সমভিব্যাহারে আসবেন, তাঁর জাতির শাসন চলবে কিয়ামত পর্যন্ত।”

রাজা বললেন, “কিয়ামত কি?”

সে বললো,“যেদিন শাসকদের বিচার হবে, আকাশ থেকে আহ্বান আসবে, সে আহ্বান জীবিত ও মৃত সকলেই শুনতে পাবে। আর নির্দিষ্ট সময়ে সকল মানুষকে সমবেত করা হবে। সেদিন মিতাচারী লোকদের জন্য হবে সাফল্য ও কল্যাণ।”

রাজা বললেন, “তুমি যা বলেছো তা বি সত্য?”

সে বললো,“হ্যাঁ, আকাশ ও পৃথিবী এবং তার মধ্যকার সকল সমতল ও অসমতল সব কিছুর রবের শপথ করে বলছি, আমি আপনার কাছে যে ভবিষ্যদ্বাণী করলাম তা সঠিক ও সন্দেহাতীত।”

রাবিয়া এই দুই ভবিষ্যদ্বক্তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করলেন এবং স্বীয় পরিবার পরিজনকে প্রয়োজনীয় পাথেয় দিয়ে ইরাক পাঠিয়ে দিলেন। তারপর পারস্যের তৎকালীন সম্রাট শাপুর ইবনে খুরযাদকে চিঠি লিখে পাঠালেন। শাপুর তাদেরকে হিরাতে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দিলেন।

আবু কারব হাস্্সান ইবনে তুব্বান আস’আদ কর্তৃক ইয়ামান রাজ্য অধিকার এবং ইয়াসরিব আক্রমণ

রাবিয়ার মৃত্যুর পর সমস্ত ইয়ামানের রাজত্ব বলে যায় আবু কারব হাস্সান ইবনে তুব্বান আস’আদের হাতে। তাঁর পিতা তুব্বান আস’আদ আগে থেকেই পূর্ব দিক দিয়ে মদীনায় (ইয়াসরিব) আসতেন এবং এভাবে মদীনাবাসীদেরকে বিব্রত না করেই সুকৌশলে আপন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেন। সেখানে তিনি নিজের এক পুত্রকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। কিন্তু উক্ত পুত্র সহসা গুপ্তঘাতক কর্তৃক নিহত হয়। এরপর তুব্বান মদীনা ধ্বংস ও তার অধিবাসীদেরকে নির্মূল করার পরিকল্পনা নিয়ে আবার সেখানে আসেন। অতঃপর আমর বিন তাল্লার নেতৃত্বে লোকদের একটি দল সংঘবদ্ধ হয়। তারা শেষ পর্যন্ত তাঁর  সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই দলটি এমন ভাব দেখায় যে, তারা যেন দিনের বেলায় তাঁর সাথে যুদ্ধ করে ও রাত্রে আতিথেয়তা করে। তুব্বান তাদের এ আচরণে বিষ্মিত হয়ে বলেন, আশ্চর্য! এ জাতি বাস্তবিক পক্ষেই ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত। এভাবে যুদ্ধ অব্যাহত থাকলো। এমতাবস্থায় একদিন দু’জন ইহুদী পন্ডিত মদীনা ও তার অধিবাসীদেরকে ধ্বংস করার ব্যাপারে তাঁর ইচ্ছ্রা কথা জানতে পেরে তাঁর কাছে আসেন। তারা তাঁকে বললেন,“হে রাজা, এ কাজটি করবেন না আপনি যদি জিদ ধরেন, তাহলেও আপনার সমনে অপ্রতিরোধ্য বাধা আসবে। ফলে আপনি যা চান তা করতে পারবেন না। অথচ আপনি অচিরেই শাস্তি ভোগ করবেন।” রাজা বললেন, “কি আরণে আমি শাস্তি ভোগ করবো?” তারা বললেন, “মদীনা শেষ যামানার নবীর আশ্রয় স্থল। কুরাইশদের দ্বারা তিনি পবিত্র স্থান থেকে বহিস্কৃত হবেন এবং এখানে এসে বসবাস করবেন।”

এ কথা শুনে রাজা নিবৃত্ত হলেন। তাঁর মনে হলো নোক দুটো যথার্থই জ্ঞানী লোক। তাদের কথঅয় রাজা মুগ্ধ হলেন। তিনি মদীনা ত্যাগ করে ঐ পন্ডিতদ্বয়ের ধর্ম গ্রহন করলেন।

তুব্বা তথা তুব্বান আস’আদ ও তাঁর গোত্রর লোকেরা পৌত্তলিক ছিলেন।তিনি ইয়ামানের পথে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। উসমান ও আমাজ নামক স্থানদ্বয়ের মধ্যস্থলে পৌঁছলে হাযাইল ইবনে মুদারাকা গোত্রের কতিপয় লোক তাঁর কাছে বললো,“হে রাজা, আপনি কি এমন এবটি অজানা ঘরের সন্ধান পেতে ইচ্ছুক, যা হীরক, মণিমুক্তা, চুন্নিপান্না প্রভৃতি মূল্যবান সম্পদে পরিপূর্ণ, অথচ আপনার পূর্ববর্তী রাজারা সে ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল।” রাজা বললেন, “হ্যাঁ, এরকম ঘরের সন্ধান অবশ্যই পেতে চাই।” তারা বললো, ‘মক্কাতে একটি ঘর আছে। মক্কাবাসীরা সেখানে ইবাদাত করে ও তার পাশে নামায পড়ে।”

আসলে বনী হুযাইলের লোকেরা তুব্বানকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে েেদয়ার উদ্দেশ্যেই এ পরামর্শ দিয়েছিল। কেননা তারা জানতো, কাবাঘরকে করতলগত করার ইচ্ছে যে রাজাই করেছ এবং তার ওপর আক্রমণ যে-ই চালিয়েছে, সে-ই ধ্বংস হয়েছে।

তুব্বানের ইচ্ছাহলো, বনী হুযাইলের পরামর্শ অনুসারে কাজ করবে। কিন্তু তা করার আগে সেই ইহুদী পন্ডিতদ্বয়ের কাছে দূত পাঠিয়ে তাদের মতামত জানতে চাইলেন। পন্ডিতদ্বয় বললেন, “আপনাকে ও আপনার সৈন্য সামন্তকে ধ্বংস করাই বনী হুযাইলের ইচ্ছা। পৃথিবীতে আল্লাহর কোন ঘরকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ নিজের মালিকানায় নিতে পেরেছে বলে আমাদের জানা নেই। তারা যে পরামর্শ দিয়েছে সে অনুসারে আপনি যদি কাজ করেন তাহলে আপনার ও আপনার সহচরদের সমূলে বিনাশপ্রাপ্ত হতে হবে। এটা অনিবার্য ও অবধারিত।” রাজা বললেন, “তাহলে আমি যখন ঐ ঘরের কাছে যাব তখন আমার কি করা উচিত বলে আপনারা মনে করেন?” তারা বললেন “মক্কাবাসীরা যা করে আপনিও তাই করবেন। ঘরের চারপাশে তাওয়াফ করবেন এবং তার সম্মান ও তাজীম করবেন। তার কাছে থাকাকালে মাথায় চুল কামিয়ে ফেলবেন। যতক্ষণ ঐ ঘরের কাছ থেকে বিদায় না হন ততক্ষণ অত্যন্ত বিনয়াবনত থাকবেন।” রাজা বললেন, “আপনারা এসব করেন না কেন?”তারা বললেন, “খোদার কসম, ওটা আমাদের পিতা ইব্রাহীমের বানানো ঘর। এ ঘর সম্পর্কে আপনাকে আমরা যা যা বলেছি সবই সত্য। তবে ঘরের চারপাশে বহুসংখ্যক মূর্তি স্থাপন করে মক্কাবাসী আমাদের ঐ ঘরের কাছে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। ঐ ঘরের কাছে রক্তপাত(নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও) চালু রেখেও তারা আমাদের যাওয়া বন্ধ করেছে। তারা অংশীবাদী ও অপবিত্র।”

তুব্বান ইহুদী আলেমদ্বয়ের উপদেশ মেনে নিলেন এবং তা বাস্তবায়িত করলেন। এরপর হুযাইল গোত্রের সেই লোকদের কাছে গেলেন এবং তাদের হাত পা কেটে দিলেন। অতঃপর মক্কায় গেয়ে পবিত্র কা’বাঘর তাওয়াফ করলেন, তার পাশে পশু জবাই করে কুরবানী আদায় করলেন এবং মাথার চুল কামালেন। এভাবে তিনি ছয়দিন মক্কায় কাটালেন। এ ছয়দিন পশু কুরবানী করে মক্কাবাসীকে খাওয়ানো এবং মধু পান করানোই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। তিনি স্বপ্নে দেখলেন কা’বা শরীফকে তিনি যেন গিলাফ দিয়ে আচ্ছাদিত করছেন। অতঃপর তিনি খাসফ নামক মোটা কাপড় দিয়ে কা’বায় গিলাফ চড়ালেন।

তিনি আবার স্বপ্ন দেখলেন যে, আরো ভালো কাপড় দিয়ে কা’বাকে গিলাফ পরাচ্ছেন। সুতরাং পরে তিনি মূল্যবান ইয়ামানী কাপড়ে কা’বাকে আবৃত করলেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা, এই তুব্বা তথা তুব্বানই প্রথম ব্যক্তি যিনি কা’বা শরীফকে গিলাফ পরিয়েছিলেন এবং কা’বার মুতাওয়াল্লী জুরহুম গোত্রের লোকদেরকে গিলাফ পরানোর অসীয়াত করে গিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম কা’বা ঘরকে পবিত্র করার (মূর্তি থেকে মুক্ত করা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল) নির্দেশ দেন, কা’বার ধারেকাছে যেন তারা রক্তপাত না ঘটায়, মৃতদেহ এবং ঋতুবর্তী মহিলাদের ব্যবহৃত ময়লা বস্ত্রখ- ফেলে না রাখে-এসব ব্যাপারে তিনি সবাইকে সাবধান করে দেন। তিনি কা’বা ঘরের জন্য দরজা তৈরী ও তালাচাবির ব্যবস্থা করেন।

এরপর তুব্বা মক্কা থেকে বেরিয়ে তাঁর সৈন্য সামন্ত ও ইহুদী প-িতদ্বয়কে নিয়ে ইয়ামান অভিমুখে যাত্রা করেন। ইয়ামানে পৌঁছে তিনে সেখানকার জনগণকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করে তাঁর গৃহীত ধর্মমত গ্রহণের দাওয়াত দেন। ইয়ামান বাসী সুস্পষ্টভাবে জানায় তারা তাদের প্রথামত আগুনের কাছে ফায়সালা চাওয়া ছাড়া ধর্ম ত্যাগ করবে না।

ইয়ামনবাসীরা আগুনের মাধ্যমে ঝগড়া বিবাদের মীমাংসা করতো। ঐ আগুন অত্যাচারীকে গ্রাস করতো কিন্তু মযলুমের ক্ষতি করতো না। একদিন ইয়ামনবাসী তাদের প্রতিমাসমূহ ও তাদের ধর্ম পালনের অন্যান্য সরঞ্জামাদি সহকারে এবং ইহুদী প-িতদ্বয় তাদের আসমানী কিতাব কাঁধে ঝুলিয়ে যে স্থান দিয়ে আগুন বেরোয় সেখানে গিয়ে বসলো। আগুন বেরিয়ে প্রথমেই ইয়ামানবাসীদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। ইয়ামান বাসী তা দেখে ভীত হয়ে পড়লো এবং আগুন থেকে দূরে সরে গেল। উপস্থিত লোকেরা তাদেরকে তিরষ্কার করে ধৈর্যের সাথে যথাস্থানে বসে থাকতে বললো। তারা ধৈর্য ধারণ করে বসতেই আাগুন তাদেরকে ঘেরাও করে ফেললো এবং প্রতিমা ও অন্যান্য ধর্মীয় সাজ সরঞ্জাম পুড়িয়ে ভষ্ম করে দিল। হিমইয়ার গোত্রের যে ক’জন পুরোহিত ধর্মীয় সাজ সরঞ্জাম বহন করছিল তারাও ভষ্মীভ’ত হলো। ফলে হিমইয়ার গোত্র তুব্বানের ধর্মে দীক্ষা নিল। তখন থেকে ইয়ামানে ইহুদী ধর্মের পত্তন হলো।

তুব্বানের পর ইয়ামানের রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন তাঁর ছেলে হাস্সান। তিনি সমগ্র ইয়ামনবাসীকে সাথে নিয়ে সমগ্র আরব ও অনারাব জগত দখল করার অভিপ্রায়ে এক বিজয় অভিযান শুরু করেন। এভাবে বাহরাইন ভূখ-ে পৌঁছলে হিমইয়ার ও অন্যান্য ইয়ামানী গোত্রগুলো তাঁর সাথে আর সামনে এগুতে চাইল না। তারা তাদের স্বদেশ ও পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধাস্ত নিল। তারা ঐ বাহিনীতে অংশগ্রহণকারী হাস্সানের এক ভাই আমরের কাছে এ অভিপ্রায় ব্যক্ত করে বললো,“তুমি তোমার ভাই হাস্সানকে হত্যা কর এবং আমাদের সাথে স্বদেশে ফিরে চল। আমরা তোমাকেই রাজা হিসেবে বরণ করে নেব।” আমর তার বহিনীর লোকজনের সাথে আলোচনা করলে সবাই একমত হলো। কেবল যূ-রুআইন আল হিমইয়ারী এর বিরোধিতা করলো ও হত্যাকা- ঘটাতে নিষেধ করলো। কিন্তু আমর তার নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করলো। তখন যূ-রুআইন নিম্নলিখিত কবিতা আবৃতি করলো,

“হুঁশিয়ার! কে আছে নিজের নিদ্রার বিনিময়ে নিদ্রাহীনতাকে বরণ করে নেবে।

যে ব্যক্তি তার সুখময় জীবনকে অব্যাহত রাখে

সে-ই প্রকৃত ভাগ্যবান। কিন্তু

হিমাইয়ার বিশ্বাসঘাতকতা করলো। আর যূ-রুআইনের জন্য খোদার স্বীকৃত ওজর রইল।”

এই কবিতাটুকু সে ইক টুকরো কাগজে লিখে তাতে সীল মারলো। অতঃপর আমরের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো, “আমার লেখা এই চিরকুট আপনার কাছে রেখে দিন।” আমর সেটা রেখে দিল। অতঃপর সে তার ভাই হাস্সানকে হত্যা করলো এবং দলবল সাথে নিয়ে ইয়ামানে প্রত্যাবর্তন করলো।

আমর ইবনে তুব্বান ফিরে আসার পর ঘোর অনিদ্রায় আক্রান্ত হলো। রোগ যখন মারাত্নক আকার ধারণ করলো তখন সে চিকিৎসক পাখীর সাহায্যে ভাগ্য গণনাকারী জ্যোতিষী ও ভবিষ্যদ্বক্তাদের ডাকলো এবং তার রোগের রহস্য উদ্ঘাটনে তাদের মতামত চাইলো। একজন বললো, “দেখুন, আপনি যেভাবে নিজের ভাইকে হত্যা করেছেন, এভাবে আপন ভাই বা রক্ত সম্পর্কীয় আপনজনকে যখনই কেউ হত্যা করেছে তাকে এ ধরনের নিদ্রাহীনতহায় ভুগতে হয়েছে।”

একথা শোনা মাত্রই আমর তার ভাই হাস্সানকে হত্যার পরামর্শ দানকারী ইয়ামানের সকল প্রভাবশালী ব্যক্তিকে হত্যা করতে লাগলো। একে একে তাদের সবাইকে হত্যা করার পর যখন যূ-রুআইনের কাছে এলো তখন সে বললো, “আমার নির্দোষিতার প্রমাণ আপনার কাছেই রয়েছে।” আমর বললো, “সেটা কি?” যূ-রুআইন বললো, “আমার লিখিত এক টুকরো কাগজ যা আমি আপনাকে দিয়েছিলাম।” তখন আমর সেটা বের করে দেখলো তাতে দু’টি পংক্তি লেখা আছে। সে বুঝতে পারলো যে, যূ-রুআইন তাকে সদুপদেশই দিয়েছিল। তাই সে তাকে হত্যা করলো না।

এরপর আমর মারা গেল। তার মৃত্যুর পর হিমইয়ারী শাসনের ক্ষেত্রে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিল এবং তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়লো। এই সুযোগে ঘাড়ের উপর শাসক হয়ে চেপে বমলো লাখনিয়া ইয়াসূফ যূ-শানাতির নামক রাজ পরিবার বহির্ভূত এক ভয়ঙ্কর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি। সে তাদের সম্ভ্রান্ত লোকজনদেরকে হত্যা করলো এবং রাজ পরিবারের লোকজনদের সাথে আমোদ প্রমোদে লিপ্ত হলো।

লাখনিয়ার সবচেয়ে বড় পাপাবার ছিল সমকাম। হাস্সানের ভাই এবং তুব্বানের ছেলে যূর’আ যু-নাওয়অসকে একদিন সে এই অভিপ্রায়ে ডেকে পাঠালো। হাস্সান নিহত হওয়ার সময় যূর’আ ছিল ছোট বালক। কিছু দিনের মধ্যে সে এক সুঠামদেহী ও বুদ্ধিমান তরুণ যুবকে পরিণত হলো। যূর’আর কাছে লাখনিয়ার বার্তাবাহক এলে সে তার কমতলব বুঝতে পারলো। সে একখানা তীক্ষèধার হালকা ছুরি নিজের পায়ের তলায় জুতার ভেতর লুকিয়ে নিয়ে লাখনিয়ার কাছে গেল। লাখনিয়া নিভৃতে ডেকে নিয়ে যূর’আর ওপর  চড়াও হলো। সে সুযোগ বুঝে তৎক্ষণাৎ ছুরি দিয়ে তাকে প্রচ-ভাবে আঘাত করলো। যূর’আ লাখনিয়অকে হত্যা করে জনসাধারণের সামনে এসে সগর্বে নিজের কীর্তি প্রচার করতে লাগলো। এবার জনগণ বললো,“তুমি আমদেরকে এই নরাধমের হাত থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছ। সুতরাং আমাদের শাসক হিসেবে তুমিই যোগ্যতম ব্যক্তি।”

হিমইয়ার গোত্র ও সমগ্র ইয়ামানবাসীর সহযোগিতায় যূর’আ যূনাওয়াস তাদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী পরাক্রমশালী রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত  করলো। যূর’আ ছিলেন হিমইয়ার বংশের সর্বশেষ সম্রাট এবং সে (কুরআনের সূরা বুরূজের) পরিখায় পুরে আগুনে পুড়িয়ে মারার গটনার নায়ক।

ইয়ামানের নাজরান প্রদেশে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রকৃত অনুসারীদের অবশিষ্ট একটি গোষ্ঠী তখনও বেঁচে ছিল। তাঁরা ছিলেন জ্ঞানী-গুণী ও সুদৃঢ় মনেবলের অধিকারী। তাঁদের নেতা ছিলেন আবুদল্লাহ ইবনে সামের। যূ-নাওয়াস তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে ইহুদীবাদ গ্রহণের দাওয়াত দিলো এবং পরিষ্কার বলে দিলো, “হয় ইহুদী হও, নচেৎ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।” সুতরাং তাদের জন্য পরিখা খনন করা হলো। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নির্মমভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো এবং অনেককে তরবারি দিয়ে হত্যা করে তাদের লাশ বিকৃত করা হলো। এভাবে যূ-নাওয়াস প্রায়২০ হাজার লোককে হত্যা করলো।

এই যূ-নাওয়াস ও তার সৈন্য-সামন্তের প্রসঙ্গেই আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ওহী নাযিল করেন, “পরিখার জ্বলন্ত অগ্নি কুন্ডলীর নায়কদের ওপর অভিসমাপ্ত। স্মরণ কর যখন তারা পরিখার পাশে বসেছিল, মুমিনদের ওপর তারা যে হত্যালীলা অনুষ্ঠানে ব্যাপৃত ছিল, সে দৃশ্য উপভোগ করছিল। মুমিনদের বিরুদ্ধে তাদের শুধু এই কারণে আক্রোশ ছিল যে, মহাপরাক্রান্ত, চিরনন্দিত আল্লাহ তায়ালার প্রতি তারা ঈমান এনেছিল।”

কথিত আছে যে, যূ-নাওয়াসের হাতে নিহত এই মুমিনদলের ইমাম ও অধিনায়ক ছিলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সামের।

এক ক্লিকে

সিরাতে মুস্তফা (সঃ) 

 

Series Navigation<< সিরাতে মুস্তফা (সঃ) (পর্ব ০৩) :: বংশপরম্পরাসিরাতে মুস্তফা (সঃ)-(পর্ব ০৫) :: হাবশীদের দখলে ইয়ামান >>

Archives

October 2024
S S M T W T F
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031