বৃহস্পতিবার, ১০ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

সিরাতে সাহাবা (রাঃ) – পর্ব ০৬ “সুহাইল ইবন আমর আল-কুরায়শী (রা)“

Khutbah Tv 

সুহাইল ইবন আমর (রা) মক্কার কুরায়শ গোত্রের আল-আমিরী শাখার সন্তান । তার পিতা আমর ইবন আবদি শামস এবং মাতা হুবাই বিনত কায়স। সুহাইলের (রা) ডাক নাম আবু ইয়ামীদ।১ খতীবু কুরায়শ’ অর্থাৎ কুরায়শদের খতীব বা বক্তা হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।২ তিনি ছিলেন কুরায়শদের উচু স্তরের সম্মানীয়,বুদ্ধিমান ও বাগ্মী নেতাদের একজন। ঘোরতর ইসলাম বিদ্ধেষী ছিলেন। তিনি তার বগ্মিতা দ্বারা ইসলাম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতেন। তার উপরের ঠোঁটটি ফাটা ছিল। দুর্ভাগ্য তার বদর যুদ্ধে কাফির অবস্থায় মুসলিম বাহিনীর হাতে বন্দী হন। তাকে বন্দী করেন মালিক ইবন দুখশুম। মক্কা বিজয়ের দিন সুহাইল (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন।”

বদরে বন্দী হবার পর যখন তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে উপস্থাপন করা হয় তখন উমর (রা) উত্তেজিত কষ্ঠে বলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাকে আমার হাতে দিন, আমি তার সামনের দু’টি দাত উপড়ে ফেলি। তাহলে সে আর কক্ষনো আপনার বিরুদ্ধে বক্তা হিসেবে দাড়াতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: উমার,থাম! হতে পারে একদিন সে এমন ভূমিকা পালন করবে যার জন্য তুমিও তার প্রশংসা করবে।

উল্লেখ্য যে,তার উপরের ঠোঠ কাটা ছিল। আর এজন্য উমর (রা) তার সামনের দুটি দাত উপড়ে ফেলার কথা বলেন। তাহলে আর স্পষ্ট করে কথা বলতে পারবে না।”।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুহাইলের (রা) জীবনে যে দিনটির আশা করেছিলেন সত্যই তা এসে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যখন ওফাত হলো তখন গোটা আরবে ধর্মত্যাগের একটা হিড়িক পড়ে গেল। তা দেখে মাক্কাবাসীদের মধ্যেও একটা দ্বিধা-দ্বন্দের ভাব দেখা দেয়। এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ সঃ এর নিযুক্ত মক্কার আমীর আত্তাব বিন উসাইদ (রা) লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। তখন সুহাইল ইবন আমর (রা) মাক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে একটা দীর্ঘ ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি বলেনঃ

ওহে কুরাইশ গোত্রের জনমন্ডলী! তোমরা সর্বশেষ ইসলাম গ্রহণকারী এবং সর্বপ্রথম তা ত্যাগকারী হয়ো না। আল্লাহর কসম! সূর্য ও চন্দ্র উদয় থেকে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত যেমন দীর্ঘায়িত হয় তোমনি । এ দীনও অবশ্যই দীর্ঘ হবে।

ভাষণ শেষ করে তিনি আত্তাব ইবন উসাইদকে (রা) জনগণের সামনে হাজির করেন। অতপর কুরাইশরা সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে। ইসলামের ওপর অটল হয়ে যায়। জারীর ইবন হাযিম (রহ) হাসান আল- বাসরী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন।

একবার মক্কার কুরাইশ গোত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যেমন সুহাইল আমর, আবু সুফিয়ান ইবন হারব, হারিছ ইবন হিশাম খলীফা উমার ইবন আল-খাত্তাবের (রা) সাথে সাক্ষাতের জন্য তার বাড়ির দরজায় সমবেত হন। উল্লোখ্য যে, তারা সকলে মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। সেখানে সাধারণ মুসলিমদের আরো অনেকে উপস্থিত আছেন। এক সময় অনুমতি দানকারী ভিতর থেকে বেরিয়ে আসলেন এবং প্রথমেই সুহাইব,বিলাল,আম্মার ও বদরীদের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিতে থাকেন। উমার (রা) তাদেরকেই ভালোবাসতেন।

আবু সুফইয়ান (রা) বিরক্তির সূরে বললেন; আজকের মত আর কখনো এমন দেখিনি। তিনি এই দাসদের অনুমতি দিচ্ছেন, আর আমরা এখানে বসে আছি, আমাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না। সুহাইল ইবন আমর (রা)। বললেন; ওহে, আপনাদের চেহারায় যে ভাব ফুটে উঠেছে তা আমি দেখতে পেয়েছি। যদি আপনারা রেগে গিয়ে থাকেন তাহলে নিজেদের উপর রাগ করুন। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান জানানো হয়েছিল। তারা খুব দ্রুত তা গ্রহণ করে, কিন্তু আপনারা খুব বেশি দেরী করে ফেলেন। তারা মর্যাদায় আপনাদেরকে অতিক্রম করে গেছে। আপনারা তা দেখতেই পারছেন,তাদেরকে আর পিছনে ফেলার কোন উপায় নেই।”

এখন এই জিহাদের দিকে দেখুন এবং তাতে অংশগ্রহণ করুন। হতে পারে আল্লাহ আপনাদেরকে শাহাদাত দান করবেন। তারপর তিনি কাপড় গুটিয়ে উঠে দাড়ান এবং শামে চলে যান।”৬  

সুহাইল (রা) তার মেয়ে হিন্দ ছাড়া পরিবারের অন্য সকলকে নিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে শামে চলে যান। তার এই মেয়ে হিন্দ এবং ছেলে উতবার মেয়ে ফাখতা ছাড়া পরিবারের সকলে সেখানে মৃত্যুবরণ করেন।

একথাও বর্ণিত হয়েছে যে,সুহাইল (রা) হিজরী ১৮ সনে উমারের খিলাফত কালে আমওয়াসের প্লেগের (তাউন) মহামারিতে মৃত্যুবরণ করেন। একথাও বর্ণিত হয়েছে যে, ইয়ারমূক যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। খলীফা ইবন খায়্যাত বলেন, প্রথম মতটি সঠিক।”৭ হারিছ ইবন হিশাম (রা) তার পরিবারের সকলকে নিয়ে শামে চলে যান। সেখানে তার ছেলে আব্দুর রহমান ছাড়া সকলে মারা যান। যখন সুহাইলের (রা) নাতনী ফাখতা ও আব্দুর রহমানকে সেখান থেকে মদীনায় এনে উমারের (রা) নিকট উপস্থাপন করা হয় তখন তিনি তাদের দু’জনকে বিয়ে দিয়ে দেন। তাদের মাধ্যমে সুহাইলও হারিছের (রা) বংশ বিস্তার ঘটে।” 

হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় এই সুহাইল (রা) মক্কার কুরাইশদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাদের প্রতিনিধি হিসেবে সন্ধি পত্রে সাক্ষর করেন। যে সকল কুরাইশ নেতা মাক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে সুহাইল (রা) সবচেয়ে বেশি সালাত আদায়, সিয়াম পালন ও দান খয়রাত করতেন। আখিরাতের বিষয়টি তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। ফলে তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়। তিনি খুব বেশি কান্নাকাটি করতেন। কুরআন তিলাওয়াতের সময় ভয়ে বিগলিত হয়ে যেতেন। বর্ণিত আছে, তিনি মুআয ইবন জাবালের (রা) নিকট যেতেন। মুআয (রা) তাকে কুরআন শেখাতেন, আর তিনি কাদতেন। এক সময় মুআয মাক্কা ছেড়ে চলে যান।

একদিন দিরার ইবন আল-আযওয়ার তাকে বলেন; ওহে আবু যায়দ (সুহাইল) আপনি এই মদীনাবাসী খাযরাজ বংশীয় লোকটির নিকট কুরআন পড়তে যান কেন? আপনার গোত্রের কোন লোকের নিকট যেতে পারেন না? সুহাইল (রা) বললেন; ওহে দিরার! এই ব্যক্তি আমাদের সংগে যাই কিছু করুন না কেন,সব দিক দিয়ে তিনি আমাদেরকে অতিক্রম করে গেছেন। আমার জীবনের শপথ আমি তার নিকট বারবার যাব। জাহিলী যুগের সব রীতিনীতি ইসলাম দূর করে দিয়েছে। ইসলাম এমন বহু সম্প্রদায়কে উপরে উঠিয়েছে জাহিলী যুগে যাদের উল্লেখ করার মত তেমন কিছু ছিল না। আফসোস! আমরা যদি তাদের সংগে থাকতাম তাহলে তাদের মতই অগ্রগামী হতাম। আমার পরিবারের নারী পুরুষ এবং আমার দাস উসাইর ইবন আওফ আগেভাগে ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহ আমার ভাগ্যে যা নির্ধারণ করেছেন তার জন্য আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি। তাদের দু’আর বরকতে আল্লাহ আমাকে ধ্বংস করেননি, যেমন আমার সমপর্যায়ের লোকেরা মারা গেছে অথবা নিহত হয়েছে ইসলাম গ্রহণ না করেই। সত্যের প্রতিপক্ষ হিসেবে আমি বহু ক্ষেত্রে উপস্থিত থেকেছি,যেমন: বদর,উহুদ ও খন্দকের দিনসমূহে।

ওহে দিরার! হুদায়বিয়ার দিন সন্ধি চুক্তিপত্র লেখার দায়িত্ব পালন করি। আমি স্মরণ করি সেদিন বার বার আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংগে মতবিনিময় করি । অসত্যের উপর থাকার কারণে সেদিন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করতে পারিনি। তারপর আমি মাক্কায় এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায়। আমি আমার আচরণের জন্য লজ্জিত হই। তারপর ইয়ামামার যুদ্ধে আমার ছেলে আবদুল্লাহ শাহাদাত বরণ করে। তখন খলীফা আবু বকর (রা) আমার নিকট সমবেদনা প্রকাশ করেন। তিনি আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বাণীটি শোনান: . –

–إن الشهيد ليشفع لسبعين من أهل بيته

একজন শহীদ ব্যক্তি তার পরিবারের সত্তর জনের জন্য সুপারিশ করবে। আমি আশা করি সে যাদের জন্য সুপারিশ করবে আমি হবো তাদের প্রথম ব্যক্তি।’

অবশ্য তার ছেলের মৃত্যুর সন ও সময় সম্পর্কে কিছুটা মতপার্থক্য আছে।”

মাক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবাঘরের ভিতরে প্রবেশ করেন। তারপর বেরিয়ে এসে কাবার দরজার উপর হাত রেখে সেখানে উপস্থিত কুরাইশ নেতৃবৃন্দকে লক্ষ্য করে বলেনঃ এখন তোমাদের বক্তব্য কী? তখন সুহাইল বলেন : আমরা উত্তম কথাই বলবো এবং আপনার কাছ থেকে ভালো আচরণ আশা করবো। আপনি হলেন একজন মহৎ উদার ভাই এবং মহৎ উদার ভাইয়ের ছেলে। আজ আপনাকে ক্ষমতাবান করা হয়েছে। তার কথার জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

আজ তোমাদেরকে সেই কথাই বলবো যা আমার ভাই ইউসূফ (আ) বলেছিলেন …, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনরূপ ধমক ও প্রতিশোধ নয় ।১০

পূর্বেই উল্লেখ করেছি বদর যুদ্ধে তিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কুরাইশ বাহিনীর সঙ্গে যান। পরবর্তীকালে বদর যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলতেন ১১

. * – لقد رأيت يوم بدر رحالأبيضاءعلى خيل بلق بين السماء والأرض معلمين يقاتلون – . .ويأسرون

 আমি বদরের দিন কিছু শেত শুভ্র মানুষকে দেখলাম , তারা সাদা কালো ঘোড়ায় সাওয়ার হয়ে আকাশ এবং পৃথিবীর মাঝখানে ঝুলন্ত অবস্থায় যুদ্ধ করছে এবং বন্দী করছে। ইসলাম গ্রহণের পর সুহাইল (রা) বলতেন “আল্লাহর কসম! আমি মুশরিকদের সংগে থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে ভূমিকা পালন করেছি, এখন আমি মুসলিমদের সংগে থেকে তাদের বিরুদ্ধে একই ভূমিকা পালন করবো। আর মুশরিকদের সংগে থেকে যে পরিমাণ অর্থ-কড়ি ব্যয় করেছি, ঠিক সেই পরিমাণ অর্থ-কড়ি এখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যয় করবো ” ।১২

আবু সাইদ ইবন ফুদালা (রা) ছিলেন একজন সাহাবী। তিনি বলেন,শাম অভিযানে আমি সুহাইলের সঙ্গী ছিলাম। সে সময় আমি তাকে বলতে শুনেছি যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা বলতে শুনেছিঃ

ساعة من عمره خير من عمله عمره في أهله.

পরিবারের মধ্যে অবস্থান করে তোমাদের কারো সারা জীবনের আমলের চেয়ে জীবনে এক ঘন্টা আল্লাহর পথে অবস্থান করা উত্তম।

তারপর সুহাইল বলেন: আমি আমৃত্যু আল্লাহর পথে ঘোড় সাওয়ার থাকবো, মাক্কায় আর ফিরে যাব না। শামে অবস্থানকালেই আমওয়াসের তাউনে (প্লেগ) আক্রান্ত হয়ে সেখানে মারা যান। ।১৩

Archives

July 2024
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031