মঙ্গলবার, ২৭শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
মাহফুজুর রহমান
আমার দৃষ্টিতে মওদূদী সাহেবের সাহিত্য সামগ্রীতে সবচেয়ে ক্ষতিকর বিষয়টি হলো,কুরাআন শরীফের তাফসীর করতে গিয়ে মনগড়া অবস্হান গ্রহন এবং তাতে নিজস্ব মতামত সংযুক্তি। এর স্বীকারোক্তি তিনি নিজেই প্রদান করেছেন। তিনি তাফসীর করতে গিয়ে সালফে সালেহীন তথা সোনালী যুগের উলামায়ে কেরামের বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি; বরং নিজের মেধায় যেটা এসেছে তার ভিওিতে তাফসীর করেছেন। তিনি তার তাফসীরের ভূমিকায় এ প্রসঙ্গে স্বীয় স্বীকারোক্তি এভাবে প্রদান করেছেন যেঃ
اس میی جس چیز کی کوشش میی نے کی ہے وہ یہ ہے کہ قرآن کو پڑہکر جو مفہوم میری سمجھ میی اتا ہے اور جو اثر میرے قلب پڑتا ہے حتی الامکان جو کاتو اپنی زبان میی منتقل کردو-( ترجمان محرم س ٢١ ص ٢)
অনুবাদঃ এতে আমি যে বিষয়ে চেষ্টা করেছি তা হলো, কুরাআন পড়ে যে ভাবার্থ আমার বুঝে আসে এবং এর যে প্রভাব আমার অন্তরে পড়ে, তা যথাসাধ্য নিজের ভাষায় হুবুহু তুলে ধরতে চেয়েছি।- তরজমানুল কুরাআন, মুহাররম ১৩৬১ হিজরী
এর চেয়ে আরো মারাত্মক হলো, মওদূদী সাহেব এই থিওরী ও ভাবধারা নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং নিজ দলের সকলকে এর উপর তুলতে এবং এভাবে পরিচালিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি শিক্ষা সংস্কার সম্পর্কে লিখেনঃ
اس طرز تعلیم کو بدلنا چاہئے قرآن و سنت رسول کی تعلیم سبپر مقدم ہے مگر تفسیر و حدیث کے پرانے ذخیروں سے نہیں ان کے پڑہا نے والے ایسے ہونا چاہئیی جو قرآن حدیث کے مغز کو پا چکے ہیی-( تنقحات ص ١٢٦)
অনুবাদঃ এই শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করা দরকার। কুরাআন ও হাদিসের শিক্ষা সবকিছুর উপর প্রাধান্য পাবে কিন্তুু তাফসীর ও হাদিসের পুরাতন ভান্ডার দিয়ে নয়। এর শিক্ষক এমন হওয়া উচিত যিনি কুরাআন,হাদিসের সারাংশ বা মগজ লাভ করেছেন অর্থাৎ, তার মর্ম যথাযথ (রি)দয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়েছেন।
-(তানকীহাত-১২৬)
সে শিক্ষা সংস্কারের শিরোনাম ছিলঃ হামারে নিজামে তা’লীমকা বুনিয়াদী উসূল” অর্থাৎ শিক্ষা কারিকুলামের মৌলিক ত্রুটি।
পাঠকবর্গ! এই উদ্ধৃতিগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ুন এবং চিন্তা করে দেখুন যে, দ্বীন মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে চায় [অর্থাৎ আল্লাহ্ ও আল্লাহ্ র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে] আর জামাআতে ইসলামী কুরাআন-হাদিসের পুরাতন ভান্ডার ছেড়ে কোথায় নিয়ে যাবে (অর্থাৎ কুরাআন-হাদিসের ভিন্ন পথের দিকে)।
মওদূদী সাহেব শিক্ষা সংস্কারের আরেক স্হানে লিখেনঃ
قرآن کے لئے کسی تفسیر کی حاجت نہیں ایک اعلی درجہ کافی ہے جس نے قرآن کا بنظر غئر مطالعہ کیا ہو اور جو طرز جدید پر قرآن پڑہانے اور سمجہانے کی اہلیت رکہتا ہو وہ اپنے لکچروں سے انڑ میڑیٹ میی طلبہ کے اندر قرآن فہمی کی ضروری استعداد پیدا کرےگا-( تنکیحات-٢١٢)
অনুবাদঃ কুরাআনের জন্য কোন তাফসীরের প্রয়োজন নেই। একজন প্রথম শ্রেনীর প্রফেসরই যথেষ্ট। যিনি কুরাআনের অধ্যায়ন গভীর দৃষ্টিতে করেছেন এবং আধুনিক পদ্ধতিতে কুরাআন পড়ানো এবং শিখানোর যোগ্যতা রাখেন। তিনি তার লেকচারের দ্বারা ইন্টারমিডিয়েট (H.S.C) পড়ুয়া ছাএদের মধ্যে কুরাআন বোঝার যোগ্যতা সৃষ্টি করবেন। -(তানকীহাত-২১২)
মওদূদী সাহেবের ভক্তদের বলছি এই ধরনের বিষয় বস্তুু পড়ার সময় ঐ সমস্ত হাদিস কি আপনার মনে পড়ে না, যাতে মনগড়া তাফসীরের উপর নিন্দাবাদ ও কঠিন হুঁশিয়ারী এসেছে!
পবিত্র কুরআনের ব্যপারে মনগড়া কথা বলা বা তার শব্দ কিংবা অর্থকে মনগড়াভাবে বর্ণনা করা মারাত্মক অন্যায় ও মহাপাপ। এর শাস্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
منْ قال في القرآن برأيه ، فلْيتبوأْ مقْعده من النّار.
“যে ব্যক্তি কুরআনের ব্যাপারে নিজের মনগড়াভাবে বললো, সে যেন নিজের অবস্থান দোযখে বানিয়ে নেয়।” (জামি‘ তিরমিযী, হাদীস নং ২৯৫১/ সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং ১০৯-১১০/ মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২০৬৯, ২৪২৯, ২৯৭৬, ৩০২৫ প্রভৃতি)
তাহলে কি দাড়ালো যে ব্যক্তি তাফসীর করতে গিয়ে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করে অর্থাৎ, মনগড়া তাফসীর করে তার ঠিকনা হবে জাহান্নাম।
অনুরুপ আরেক হাদিসে এসেছেঃ
من قال فی القرآن برايه فاصاب فقد اخطا-
“যে ব্যক্তি কুরআনের ব্যাপারে নিজের মনগড়াভাবে বললো, চাই তা সত্য বা বাস্তবই হোক না কেন সে ভুল করল। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি নিজস্ব মতের আলোকে তাফসীর করে থাকে, যদিও তার ব্যাখ্যা প্রদান করাটা বাস্তব ও ঠিকই হয়েছে তথাপি নিজস্ব মতের আলোকে করার কারনে এটা তার পন্থাগত ভুল বলে বিবেচিত হবে।- (তিরমিযি ২৯৫২,আবু দাউদ)
মওদূদী সাহেব তাফসীর এবং হাদিসের পুরাতন ভান্ডার থেকে মূখ ফিরিয়ে সরাসরি কুরআন অনুধাবনের প্রতি বিভিন্ন স্হানে আহ্বান জানান এবং তিনি নিজেও অকপটে এটা স্বীকার করেন। এক স্হানে তিনি লিখেনঃ
یوں تو قرآن مجید کی آیات میی معنوی تحریف کر نے کی ہر زمانہ میی کو ششیں کی گئ ہیں اور ہر دور میں نظر لو گوں کایہی شیوہ رہاہے کہ کتاب الہی کے واضح ارشادات کو توڑ مڑور کر اپنے نفس کی خواہشات یا اپنے دوستوں کے رجحانات و مطالبات کے مطابق ڈہا لتے ر ہے ہیں۔( تفہیمات ص ١٨٢)
অনুবাদঃ এটাতো সত্য যে, কুরাআন মাজীদের অন্তর্নিহিত অর্থ রদবদল করার অপচেষ্টা সর্বযুগেই চলে আসছে এবং প্রত্যেক যুগেই বক্রদৃষ্টিসম্পন্ন রোকদের এই স্বভাব ছিল যে, তারা কালামুল্লাহ-এর স্পষ্ট আহ্বানকে ম্লান ও মিটিয়ে নিজেদের ইচ্ছা এবং দলীয় লোকদের উক্তি ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী পেশ করার চেষ্টা করেছে। -(তাফহীমাত-১৮২)
এবার পাঠকবর্গ আপনারাই বলুন, কুরাআনে বিকৃতি রোধের বাস্তব কোন উপায় যদি থেকে থাকে তাহলে তা ছিল কুরাআন-হাদিসের পুরাতন ভান্ডারেরই মধ্যে। কিন্তুু এখন আপনারা তা দাফন করতে তৎপর হয়েছেন। এবার জামাআতের নিতিনির্ধারক আপনারা বলুন তো আল্লাহ্ র নিকট ও মানুষের নিকট আপনাদের (যাদের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় মওদূদী সাহেবের রচিত পুস্তকাদি এবং তার নিজস্ব মনগড়া তাফসীর অনেক স্বরলমণা সাধারন মানুষের কাছে নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে) এই দায়িত্ব কি বর্তায় না যে, জনসম্মুখে ঘোষনা দিবেন- আমাদের কর্মনীতি দ্বারা মওদূদী সাহেবের পুস্তীকা ও তাফসীরকে একমাএ গ্রহনযোগ্য দলীল মনে করবেন না? অথবা তার বল্গাহীন তাফসীর ও পুস্তীকায় যেখানে যেখানে তিনি আহলে হকের খেলাফ করেছেন সে স্হানসমূহ চিহ্নিত করে সতর্ক করে দেওয়া যে, এই এই স্হানে জমহুর ও আহলে হকের সাথে তার মতবিরোধ আছে? কিন্তুু আপনারা তা না করে নীরব ভাষায় ঐ বিষয়গুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করে চলছেন, যেগুলো মওদূদী সাহেব জমহুরের খেলাফ করেছেন নিজের স্বাধীন মতামতের দ্বারা।
যখন আপনারা আপনাদের সভা-সমিতিতে উপস্হিত হয়ে ভাষণ এবং লেখনীর মাধ্যমে মওদূদী সাহেব ও তার সাহিত্য-কর্মের প্রশংসা করেন (আর আমিও তার লেখনী ও সাহিত্যের স্বীকৃতি দিই) তখন একাকী এই বলে দেয়াটা মোটেও যথেষ্ট নয় যে, আমি তার বিতর্কিত বিষয় ও তাফসীর সমর্থন করি না। আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টি বলে যে, মওদূদী সাহেবের তাফসীরের ভ্রান্তির মোড়ক উন্মোচন করার দায়িত্ব বর্তমানে যারা জামাআতের দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন তাদের। আলেম ওলামারা তো তার ভুলগুলো চিহ্নিত করে জনসাধারণকে বাঁচাতে লিখনি ও জনসম্মুখে আলোচনার মাধ্যমে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর জামাআতের কর্মিরা যেহেতু আপনাদেরকে বেশি মানে তাই, মওদূদী সাহেবের লিখনীতে কোথায় কোনটা ভুল আছে কর্মিরা তা আপনাদের মূখ থেকেই তারা শুনতে চায়। আপনাদের মূখ থেকে এটা প্রকাশ পেলে জামাআতের কর্মিরা তা বেশি গুরুত্ব দিবে এবং তার ভ্রান্ত তাফসীর ও তার ভুল লিখনীর কবল থেকে আত্নরক্ষার চেষ্টা করবে। আপনারা যদি চুপ থাকেন, তাহলে আপনাদের এই নিরবতা হবে মওদূদীর তাফসীর ও তার লিখিত পুস্তিকার সমর্থন করার নামান্তর। আপনারা এটাতো অস্বিকার করতে পারবেন না যে, মওদূদীকৃত তাফসীরের অনেক স্থানে জমহুরের তাফসীরের পরিপন্থী হয়েছে। স্পষ্টভাষায় আমি আপনাদের জানিয়ে দিলাম, যাতে পরে এই খোঁড়া অজুহাত পেশ করতে না পারেন যে, আমরা তার তাফসীরের ভ্রান্তি সম্পর্কে জানতাম না!
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মওদূদী সাহেবের সকল প্রকার ভ্রান্তিমূলক লিখনী থেকে হেফাজত ফরমান।
লেখকঃ মাহফুজুর রহমান