মঙ্গলবার, ৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ৯ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

শতাব্দীর চিঠি – (০২) কবি মুসা আল হাফিজ

( পূর্বপ্রকাশের পর)

আপনি আর শামস বলখী শুধু দরবেশ ছিলেন না,সমাজতত্ত ও সামরিকতায়ও ছিলেন কুশলী। সোনার গাঁয়ে, শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার বিশ্ববিদ্যালয়ে বলখী জ্ঞান লাভ করেন।শিক্ষক হিসেবে আবু তাওয়ামাকে পাননি,পেয়েছিলেন ইয়াহইয়া মানিরীকে। আপনি ইয়াহইয়া মানেরীর শিষ্য হন ক্লাসে নয়, সান্নিধ্যে। সোনার গাঁ বিশ্ববিদ্যালয়, তার মানসগঠন প্রক্রিয়া এবং শিক্ষককূলকে আপনি আপন করে পেয়ে যান পিতার কল্যাণে। হ্যাঁ,সোনারগাঁয়
ে স্থানান্তর আপনার জন্য সুফলই এনেছিলো। আপনি পেয়েছিলেন পিতার বন্ধু – মহান মানেরীকে।
মানিরী ছিলেন এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও প্রধান ছাত্র।মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি ভারতের মানেরের সেই ধনাঢ্য ও জ্ঞানপ্রাজ্ঞ পিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবু তাওয়ামার সঙ্গী হয়ে জ্ঞানের সন্ধানে বের হন। আবু তাওয়ামা তখন ভারতের শীর্ষ মনীষী। দিল্লীর সালতানাত তার জ্ঞানের প্রভাব ও প্রতাপকে ধারণ করতে পারেনি। ভয় পেয়ে যায় তার জনপ্রিয়তাকে। তাওয়ামা যদি চান,জনগণকে উস্কে দিয়ে দিল্লীর মসনদ উল্টে দিতে পারেন। এই ছিলো সালতানাতের ভীতি ও আতঙ্ক।অথচ তাওয়ামা দিল্লির স্থায়ী অধিবাসী ছিলেন না। এসেছিলেন মধ্য এশিয়ার বোখারা থেকে। অবস্থান নিয়েছিলেন দিল্লির ছোট এক মসজিদে। সেখানেই যাদেরকে পেতেন এবং যারা চাইতো, তাদেরকে জ্ঞান দান করতেন। কয়েক বছরেই তার পাঠদানের খ্যাতি সারা ভারতে ছড়ালো। হাজার হাজার শিক্ষার্থী তাকে ঘিরে মৌমাছির চাক রচনা করলো। সপ্তাহে এক দিন জনসাধারণকে ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি উপদেশ দিতেন। সে দিন সারা দিল্লি ভেঙ্গে পড়তো তার মহল্লায়। রাজা,রাজপুত্র থেকে নিয়ে ভিখিরি, সর্বহারা – সকলেই ধুলির আসনে সাম্যের জলসায় বসে যেতো।রাজাদের ভুল ধরিয়ে দিতেন,করণীয় নির্দেশ করতেন।আমির- নবাবদের ইচ্ছাবিলাসের সমালোচনা করতেন,দেখাতেন সুপথ। কারো ভালো লাগা,মন্দ লাগার কোনো পরোয়াই ছিলো না তার। অথচ আবু তাওয়ামার তখনো কোনো ঘর নেই,বাসভবন নেই।মসজিদেই এতেকাফ করেন বছরভর। বিত্তহীন এই ফকিরের প্রভাব যখন সর্বব্যাপী, তখনই দিল্লির সালতানাত তাকে দিল্লি ত্যাগের আদেশ দিলো।গিয়াসুদ্দীন বলবনের আদেশ পেয়ে বিনা প্রতিবাদে, সন্তুষ্টচিত্তে তিনি বেরিয়ে এলেন। হাজারো জনতা রোদন করে করে আবু তাওয়ামার পেছনে যাত্রা করলো।সম্রাট বলবনও ছদ্মবেশে কাফেলার সঙ্গ নিলেন।
এক সময়। উত্তেজিত জনতা আবু তাওয়ামার চারপাশে।ছদ্মবেশ
ী বলবন তাদের হয়ে কথা বলছেন।
-” আপনি হুকুম করুন, আজই আমরা বলবনের মসনদে আগুন লাগিয়ে দেবো।”
হাজারো জনতা প্রতিধ্বনি তুললো – “এটাই হোক”
” আপনাকে আমরা বসাবো ক্ষমতায় অথবা বসাবো তাকে, যাকে আপনি অঅনুমোদন করবেন!”
আবু তাওয়ামা শান্ত,ধীরোদাত্ত।বললেন-“থামো!…
আমি আল্লাহর এক ইচ্ছা থেকে আরেক ইচ্ছার দিকে দিকে যাচ্ছি।”
” আমি, আমরা এমন নই, যাদেরকে আঘাত করলে প্রতিশোধ নেয়”
” ব্যক্তিগত হারানো বলতে আমাদের কোনো হারানো নেই। আমাদের হারানো সেটাই,যেটা হারায় আমাদের জাতি।”
” তোমরা বিদ্রোহ করতে চাও? হ্যাঁ,বিদ্রোহ করো সেই চরিত্রের বিরুদ্ধে, যে চরিত্রের কারণে তোমরা এক তাওয়ামার জন্য এক সাম্রাজ্যকে বিরাণ করতে চাও।যুদ্ধের আগুন জ্বালাতে চাও”
” আমার জন্য তোমরা উদ্বিগ্ন হয়ো না। উদ্বিগ্ন হও সেই ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে, যা তোমাদের ও তোমাদের শাসকদের দায়িত্বহীন করে রেখেছে।”
” ক্ষমতা আমরা চাই না। যখন চাইতে থাকবো, তখন আমরা আর আমরা থাকবো না। ক্ষমতাকে সুপথে চালানোর চেষ্টা আমাদের। দিল্লিতে থাকতে এটা যেমন চলেছে,দূরে গেলেও চলবে। আমি চললাম।তোমরা ফিরে যাও।দিল্লি ও দিল্লির সুলতানের জন্য দোয়া থাকবে আমার।”
সম্রাট বলবন ততক্ষণে লজ্জা ও অপরাধবোধে মাটি হয়ে যাচ্ছেন। সাধকের আসল অবয়ব দেখে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নুয়ে পড়লেন। ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করে নিবেদন করলেন,” আমিই বলবন,হে মহান! আমি অপরাধি।দিল্লি আপনার।আপনি দিল্লিতে আসুন।”
কিন্তু আবু তাওয়ামা ফিরলেন না। তিনি সম্রাট ও জনতাকে কল্যাণের উপদেশ দিয়ে বিদায় করে দিলেন। মরুভুমি মাড়িয়ে চলতে থাকলেন দূরের দিগন্তে।
উদ্দেশ্য ঢাকার নিকটবর্তি সোনারগাঁ। পথে, মানেরে, রাত্রি যাপন করলেন, ইয়াহইয়া মানেরীদের বাসায়। কিশোর ইয়াহইয়া মেহমানের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হলেন।মেহমানও কিশোরের মধ্যে দেখলেন ভুবন জাগানো আলো। ভবিষ্যতের বিপুল ঐশ্বর্য।
মানেরী মহান মেহমানের সঙ্গী হতে চাইলেন। তার মা- বাবা রাজী হলেন।মহান মেহমানও অসম্মত নন। অতঃপর মানেরীকে দিয়ে শুরু হবে আবু তাওয়ামার বিশ্ববিদ্যালয়- যেখানে এক সময় এসে ভিড় করবে বিহার,দাক্ষিণাত্য, খোরাসান,কান্দাহার,বোখারা এমনকি সিরিয়া- ইয়েমেনের জ্ঞানপিপাসুরা।
সোনারগাঁয়ের বিশ্ববিদ্যালয় বিখ্যাত হয়ে উঠবে হাদীস, তাসাউফ,লজিক ও নৌবিদ্যার জন্য।জ্যোতির্বিজ্ঞান,ইতিহাস,সম
াজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব,আইনতত্ত্ব এখানে গুরুত্ব পাবে। সময়ের ব্যবধানে এটি শুধু বিদ্যালয়ই থাকবে না।হয়ে উঠবে সমাজ- রাজনীতির শোধনাগার। তার থাকবে নিজস্ব নৌবাহিনী- প্রবল ও অপ্রতিহত নৌবাহিনী। একটি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে নদী- সমুদ্রঘেরা বাংলার জনজীবনের নিরাপত্তার আমানতদার। বাংলার ধর্মজীবনের শুদ্ধি ও সুরক্ষা, সাংস্কৃতিক সচেতনতা, স্বাধীনতা ও জাতিয় সংহতি রক্ষা,হিন্দু- মুসলিম সম্প্রীতি, হানাদারদের প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে ভরষার কেন্দ্র হয়ে উঠবে এ বিশ্ববিদ্যালয়।
এ বিশ্ববিদ্যালয় সুলতান নাসির উদ্দিন বুগরা খানের মাধ্যমে দিল্লির পথভ্রান্ত সালতানাতকে সংশোধনে হয় সচেষ্ট। বুগরা খান ছিলেন সম্রাট বলবনের কণিষ্ঠ ও দ্বিতীয় পুত্র। ১২৮১ থেকে ১২৯১ সাল অবধি দিল্লির প্রতিনিধি হয়ে তিনি বাংলা তথা লাখনৌতি শাসন করেন।বুগরা খান যখন জানলেন, আবু তাওয়ামা এসেছেন সোনারগাঁয়ে,তিনি এ আগমনকে নিজের সৌভাগ্য হিসেবে দেখলেন। জ্ঞান ও হৃদয়বৃত্তির এমন উদ্যানের স্বপ্ন তিনি বুনতে থাকলেন, যার সুবাতাস গোটা ভারতে ছড়াবে শুদ্ধতার প্রবাহ। আবু তাওয়ামাকে ঘিরে সোনারগাঁয়ে সেটাই শুরু হলো।
এ ছিলো এক স্বপ্নের জাগরণ,নতুন আলোর আন্দোলন। দিল্লির অস্থির রাজনীতির বাতাসে যেটা হয়ে উঠার ছিলো না। বুগরা খান তাই বাংলাকেই ভালোবাসলেন। ভালোবাসলেন এতোই যে, বলবন তাকে দিল্লির মসনদ দিতে চাইলেন।কিন্তু বুগরা খান তাকে জানালেন- আমি এখানেই আছি ভালো। এখানেই আমার আরাম।
( অসমাপ্ত)

Archives

March 2024
S S M T W T F
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031