রবিবার, ৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে রজব, ১৪৪৬ হিজরি
১২৮৭ সাল এলো ভারতের জন্য দমকা হাওয়া হয়ে। ছোট ছোট রাজ্যগুলো স্বাধীন হতে চায়।মোঙ্গলদের চোখ রাঙানিতে দিল্লি কম্পমান, সারাক্ষণ যুদ্ধের শঙ্কা সীমান্তে। এরই মধ্যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন গিয়াসুদ্দিন বলবন। তার বড় পুত্র ভীষণ এক যুদ্ধে জীবন দিলেন মোঙ্গলদের হাতে। ছোট পুত্র বুগরা খানই দিল্লির ক্ষমতা সামলাতে পারতেন।কিন্তু তিনি দিল্লিতে গেলেন না। বুগরার বড় পুত্র কায়কোবাদ হলেন দিল্লির সম্রাট। কায়কোবাদের বয়স তখন আঠারো। বুগরার উচিত ছিলো দিল্লির শাসন হাতে নেয়া কিংবা পৃষ্ঠপোষকতার দ্বারা অপ্রস্তুত কায়কোবাদকে সহায়তা করা। তিনি চললেন উল্টো পথে। দিল্লির জটিলতা থেকে মুক্ত হবেন বলে ১২৮৭ সালেই নাসিরুদ্দিন মাহমুদ উপাধি নিয়ে লাখনৌতির স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন।
দিল্লির আকাশে তখন মেঘের দাপাদাপি।কিশোর সম্রাটকে নিয়ে অজস্র ষড়যন্ত্র। দরবারের কর্তারা তাকে পুতুল বানাতে চায়। প্রত্যেকেই শুরু করলো আপন আপন স্বার্থের খেলা। সম্রাটের চারপাশে মন্দদের ভিড়। চাটুকারদের দঙ্গল। সম্রাটকে তারা ভোগ আর বিলাসের স্বাদ চাখাতে লাগলো। প্রধানমন্ত্রী নিজামুদ্দিন সাম্রাজ্যের সকল ক্ষমতা হাতে নেয়ার জোর প্রয়াস শুরু করলো। আবু তাওয়ামা এ পরিস্থিতিতে বুগরা খানকে উদ্যোগি হবার পরামর্শ দিলেন। তিনিও ভাবছিলেন এমনটাই।রাখছিলেন দিল্লির সকল খবর।পুত্রের অধঃপাতের সংবাদ তার হৃদয়ের রক্ত ঝরাতো। তিনি চিঠির পর চিঠি পাঠাতে থাকেন পুত্রকে।পুত্র ততক্ষণে পেয়ে গেছেন মদ,নারী অার আয়েশের স্বাদ। তিনি নিজেকে বদলালেন না। পিতার সাবধানবাণীর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। বাধ্য হয়ে বুগরা খান সেনা অভিযান চালালেন দিল্লির দিকে।লাখনৌতি তথা বাংলা এগিয়ে চললো দিল্লিকে সংশোধনের জন্য। শায়েস্তা করার জন্য। বাংলা তখন সত্যিই শক্তিমান।
কায়কোবাদ যুদ্ধ চাইছিলেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চাইলেন। মন্ত্রণাদাতারা চাইছিলেন। অতএব কায়কোবাদকে যুদ্ধযাত্রা করতে হলো, পিতার প্রতিরোধে। তার বাহিনীতে ছিলেন মহাকবি আমির খসরু। কাছ থেকে তিনি দেখেছেন নাটকিয় সব দৃশ্যপট।
সরযু নদীর দুই তীরে দুই বাহিনী। কবি দেখলেন যুদ্ধের উন্মাদনা। হত্যার প্রস্তুতি। হাতির বৃংহতি,দামামার চিৎকার আর যোদ্ধার হাকডাক।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুত্র ভীত হলেন।যুদ্ধ ছাড়াই এলেন পিতার সমীপে।মিলন হলো পিতা- পুত্রের। বুগরা খান পুত্রকে বসালেন মসনদে।দিলেন বিবিধ উপদেশ।শুনালেন দেশ পরিচালনা নীতি, ইনসাফ ও সততার নির্দেশনা।পিতা পুত্রকে বুকে জড়ালেন।এগিয়ে দিলেন বহুদূর। আমির খসরু উভয় দৃশ্যই দেখলেন। দেখলেন তীব্র ঘৃণা ও প্রবল ভালোবাসা। দেখলেন যুদ্ধের কালো মেঘ আর শান্তির রৌদ্রধারা। লিখলেন এই কাহিনী সবিস্তারে।নাম দিলেন ‘ কিরানুসসাদাইন’ বা দুই তারকার মিলন। কাহিনীর ভেতরে যে বিস্ময়, তার অবিশ্বাস্য বর্ণনা দিয়ে কবি লিখেন ‘ শায়েরী নেস্ত,হামা রাস্ত’ – কবিত্ব নয়,পুরোপুরি সত্য।
কায়কোবাদ ফিরে গেলেন দিল্লি।বুগরা চললেন লাখনৌতি। গিয়েই লাখনৌতিকে বিভক্ত করলেন চার রাজ্যে: বিহার, সপ্তগ্রাম, বঙ্গ ও দেবকোট। সংহত করলেন শাসনকে। সোনারগাঁয়ের আধ্যাত্মিক প্রভাব তাকে আরো বেশি দায়িত্ববান করে তুললো। নিজে সমর্পিত হতে থাকলেন অারো বেশি কল্যাণে। আর কায়কোবাদ? তিনি আবারো ভেসে গেলেন বিলাসিতা ও স্বেচ্ছাচারে। পাপ ও বিশৃঙ্খলার বাজার জমে উঠলো। দরবারিদের জুলুম জনগণকে বিষিয়ে তুললো।চরম নৈরাজ্যকর প্রেক্ষাপটে খিলজি সৈনিক জালালুদ্দিন ফিরোজ শাহ হত্যা করলেন কায়কোবাদ ও তার পুত্রকে।অধিকার করলেন দিল্লির মসনদ।
বুগরা খান বৃত্তান্ত শুনে মর্মযাতনায় নেতিয়ে পড়লেন। শাসন ও ক্ষমতার প্রতি তার অনীহা বেড়ে গেলো।১২৯১ সালে নিজের কনিষ্ঠ পুত্র রুকনোদ্দিন কায়কাউসের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দিয়ে তিনি হয়ে গেলেন নির্জন দরবেশ!
লাখনৌতির রাজার এ সব ভুমিকা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিলো সোনারগাঁয়ের সাধক- বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা। সেই প্রভাব যুগ যুগ ধরে নানাভাবে বাংলার রাজনীতি ও সালতানাতে ক্রিয়াশীল থেকেছে। মহান আবু তাওয়ামার পরে মুসলিম বাংলার সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি আন্দোলিত হতে থাকলো শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরীর উত্থানে।
রোকনুদ্দিন কায়কাউস থেকে গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ।১২৯১ থেকে ১৩৯৩ সাল। আবু তাওয়ামা – ইয়াহইয়া মানেরীর সেই প্রভাবক ভুমিকায় অবতীর্ণ হলেন শামস বলখি আর আপনি – নুর কুতবুল আলম।
আপনারা দেখলেন গণেশের মনুবাদ বাংলাকে গিলে খেতে উদ্যত। আজম শাহকে সতর্ক করলেন। করণীয় নির্দেশ করলেন।
জাতিয় বৃহৎ লক্ষ্য পূরণের পথে ক্ষুদ্র লক্ষ্য আপনাদের বিভ্রান্ত করতো না।
ব্যক্তিগত কোনো চাহিদা নিয়ে আপনারা সুলতানের দ্বারস্থ হননি কখনো।কখনো আপন শক্তি প্রদর্শন ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার খেয়ালে সুলতানকে কোনো বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করেননি। শাসকের তোষামোদি ও পীঠচাপড়ানোতে আপনাদের ছিলো প্রবল অনীহা আর ঘৃণা।
যা সত্য,যা জাতির জন্য সমীচিন,তা আপনারা বলতেনই। বলতেন,সুলতানের অপ্রিয় সত্যটিও।
আপনাদের ব্যক্তিত্ব তাই ছিলো পাহাড়সমান।সুলতান আপনাদের প্রতি ছিলেন পরম শ্রদ্ধাশীল।
আপনাদের উদ্যোগে তিনি সতর্ক হলেন, কর্তব্যের প্রতি সজাগ হলেন।কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে জেঁকে বসা মনুবাদী চক্র অদম্য হয়ে উঠছে।তারা গড়ে তুলেছে গুপ্তঘাতকদের নেটওয়ার্ক। আজম শাহ সজাগ হতেই গণেশের চক্র আরো অধিক সক্রিয় হলো। আজম শাহ উদ্যোগ নিলেন সংস্কারের। তারা উদ্যোগ নিলো আজম শাহকে উচ্ছেদের।
( অসমাপ্ত)