শনিবার, ১লা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ই রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গা মুহাজির ক্যাম্পের পথে প্রান্তরে! [পর্ব-২] – লুৎফর ফরায়েজী

গতপর্বের পর থেকে

এক জন বলতে লাগলেনঃ হযরত! ভয়ানক সংবাদ হল, যারা আসছেন, তারা বলছেন পাহাড়ের উপার মগ দস্যু এবং বার্মার সেনাবাহিনীরা রোহিঙ্গা সুন্দরী যুবতীদের আটকে রাখছে। সীমান্ত পাড় হতে দিচ্ছে না। দিনের পর দিন তাদের উপর অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের উদ্ধার করার কেউ নেই। না সেখানে কেউ যেতে পারে। কোন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও সেখানের খবর নিতে পারে না।

Default Ad Content Here

আহ! হৃদয়টা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল।

ইউসুফ মাহমূদী শুনালেনঃ গতকাল সীমান্ত পাড়ি দেবার সময় গুলি করা হয়। গুলিবিদ্ধ এক ভাইকে আমরা নিয়ে আসি। রক্তে লাল হয়েছিল নাফ নদীর পানি। ব্রিজটা রক্তে ভিজে গিয়েছিল। অবশেষে শিশুটা মারা যায়। জানাযা হয় পাশের মাদরাসা মাঠে।

লিমন ভাই যোগ করলেনঃ আজ এক ব্যক্তি মাথায় ঝুপড়ি নিয়ে আসছিল। যখন তাকে বললাম “ভাত রেডি, আসেন”। কথা শুনার সাথে সাথে মাথার ঝুপড়ি ফেলে ছুট দিল খানা খেতে। খাবার সামনে পেয়ে অনেকেই হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। চার পাঁচদিনের অনাহার মানুষকে কি পরিমাণ বিপর্যস্ত করে দেয় তাদের না দেখলে তা কল্পনাও করা যাবে না।

কথাগুলো শুনছিলাম আর উঁকি দিচ্ছিলাম মাঠে বসে থাকা নিরাপরাধ নির্যাতিত শরণার্থীদের দিকে। আফসোস! কি অপচয় আমরা করি। কত আইটেমের খাবার আমরা খাই। আর একবেলা খাবারের জন্য আমাদের কিছু ভাইবোনেরা কিভাবে হাহাকার করছে।

বললামঃ শুনেছি আমাদের দেশের কতিপয় কুলাঙ্গার মাঝিরা জবরদস্তিমূলক এক দেড় লাখ টাকা নৌকা ভাড়া নিচ্ছে। চরম হিংস্রতার পরিচয় দিয়ে শরণার্থীদের মাল সামানা কেড়ে নিচ্ছে। অনেককে মাঝনদীতে ফেলেও নাকি দিয়েছে?

মাদরাসার শিক্ষা সচিব জানালেনঃ আমি এখানকার বিজিবি ক্যাম্পের ইমাম। আগে এমন হয়েছে অনেক। কিন্তু এখন আর করতে পারে না। কারণ, আগে রোহিঙ্গাদের সরকারী স্বীকৃতি ছিল না। কিন্তু এখন আছে। তাই এসব করার দুঃসাহস আর তারা দেখায় না। যারা এমন হিংস্রতা করেছিল, তাদের প্রত্যেককে শাস্তি দেয়া হয়েছে। মাঝিদের নৌকাও আটকিয়েছে বিজিবি। সারাদিন তাদের বেঁধেও রেখেছিল। পিটিয়েছে অনেক। কয়েকজনকে ধরে থানায়ও পাঠিয়েছে। তাই এমন জুলুম করার সাহস এখন আর কারো নেই। আমরা সাধ্যানুপাতে নৌকা পারাপারে চেষ্টা করি। এখানে যারা আছেন, তারা মিলে রাতের বেলা আমরা নৌকা ঠিক করে উপারে পাঠাই। নৌকা আসলে আমরা অভ্যর্থনা করে শরণার্থীদের মাদরাসায় নিয়ে আসি। তারপর তাদের খানার ব্যবস্থা করি। সকালে তাদের ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।

বললামঃ এটা কি শুধু আপনারাই করেন না আরো অন্য মাদরাসার উস্তাদরা এ কাজ আঞ্জাম দেন?

বললেনঃ এখানে আরেকটি বড় মাদরাসা আছে। তারাও একাজ করছেন। এছাড়া আরো অনেকেই এ খিদমাতে নিয়োজিত।

বললামঃ মাশাআল্লাহ। অনেক বড় কাজ। আল্লাহ তাআলা এর উত্তম বদলা আপনাদের অবশ্যই দান করবেন।

যোহরের নামায শেষে খানা শেষ করলাম। সিদ্ধান্ত হল, আমাদের সাথে আসা পাবনার প্রতিনিধি দল আজকে মাদরাসায় থাকবে। রাতে সীমান্ত পাড়ি দেয়া শরণার্থীদের সহযোগিতা করবে। সকালে উনছিপ্রাং ক্যাম্পে আমরা একত্র হবো ত্রাণ কার্য পরিচালনা করতে।

শরণার্থী পারাপার ও তাদের খানা খাওয়ানো এবং ক্যাম্পে পৌঁছানো ফান্ডে আমরা ও পাবনার প্রতিনিধিরা সম্মিলিতভাবে বিশ হাজার টাকা মাদরাসা কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিলাম।

এবার বিদায় নেবার পালা শাহপরীর দ্বীপ থেকে। রওয়ানা টেকনাফের পথে। মাদরাসা মাঠে আসতেই দেখা হল, কতিপয় নারী ও শিশু রোহিঙ্গাদের সাথে। জানা গেল, তারা সম্ভ্রান্ত পরিবারে সদস্য। এখন আর ক্যাম্পে যাবার সুযোগ তাদের নেই। কারণ পানি শুকিয়ে গেছে। কংকরময় দীর্ঘ রাস্তা পেড়িয়ে ক্যাম্পে যাওয়া আজ সম্ভব নয়। এখন তারা করবে কি?

লিমন ভাই মোবাইল বের করে আলাপ করলেন স্থানীয় তাবলীগী যিম্মাদারের সাথে। এ পরিবারকে আজকের মত আশ্রয় নিতে হবে উক্ত তাবলীগী আমীরের বাসায়। রওয়ানা হলাম তাদের পৌঁছে দিতে। ছোট ছোট বাচ্চা শিশু। হাটছে। কারো মাথায় বড় বড় পুটলি। খালি পা। লিমন ভাইয়ের হাতে দুই হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, আমরাতো চলে যাচ্ছি, এখানকার খালি পা শিশুদের জন্য সামনের বাজার থেকে জুতা কিনে দিয়েন।

বললেন, আচ্ছা।

অটোযোগে রওয়ানা হলাম। আসার পথে যেখানে নৌকায় নেমেছিলাম সেখানে এসেতো হতবাক। পানি কোথায়? এতো খাঁ খাঁ করছে। দেখা যাচ্ছে ভাঙ্গা পিচ উঠে যাওয়া খানাখন্দময় পথ। অল্প একটু নৌকায় যাওয়া যাবে। বাকিটা হেটে।

নৌকায় চড়ে ভাবতে লাগলাম। আল্লাহর কি কারিশমা। সকালে দেখে গেলাম আদিগন্ত বিস্তৃত পানির দরিয়া। আর এখন খালি মাঠ। এটা কি করে সম্ভব?

সম্ভব। মহান মালিকের জন্য সবই সম্ভব। মাওলানা মুয়াজ্জেম বলে উঠলেনঃ যদি এক হাজার সেঁচ মেশিনও লাগানো হতো, তাহলে সকাল থেকে এত পানি শুকানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু আল্লাহর কি মহিমা। মুহুর্তেই পানির এ বিশাল দরিয়া শুকিয়ে দিলেন। এরই নাম জোয়ার ভাটা!

জোয়ারে আকুল দরিয়া। ভাটায় খাঁ খাঁ মাঠ।

সমস্যা হল মাঝখানের সেই ডুবন্ত সেতুটা। যাবার সময় যাকে দেখেছিলাম প্রায় ডুবন্ত। এখন তা পূর্ণ দৃশ্যমান। সেতুর দুপাশে পানি আর হাটু অবধি কাঁদামাটি। এখন? শিশু বৃদ্ধ, পুরুষ নারী সবার জন্য এ এক মূর্তমান আপদের নাম।

সাধু সেজে থাকলে কাজ হবে না। নামতে হল কাঁদামাটিতে। কোন মতে পাড় হলাম। এবার আর জুতা পড়ার জোঁ নেই। খালি পায়ে খানিক হাটতেই পায়ে ফোসকা পরা যোগার। এক ভাইয়ের কাছে থেকে পানি নিয়ে পা ধুয়ে জুতা পরলাম। অবশেষে সিএনজি মিলল। টেকনাফে এসে মাগরিব পরে স্থানীয় এক হোটেলে রাত্রি যাপন।

আবার কাল সকাল থেকে কাজ শুরু হবে ইনশাআল্লাহ।

চলবে

Archives

March 2025
S S M T W T F
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031