শনিবার, ২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
মনে করুন! যদি কোনো অমুসলিম ভাইকে প্রশ্ন করা হয়, বলুনতো দেখি ইসলাম কাদের ধর্ম? নিশ্চয়ই তিনি উত্তরে বলবেন মুসলমানদের ধর্ম। একই প্রশ্ন যদি কোনো মুসলমান ভাইকে করা হয়, তারাও উত্তর দিবে, এতো আমাদের ধর্ম। কিন্তু একটু বুকে হাত রেখে চিন্তা করুন, আদৌ এই উত্তরটি কি সঠিক? আসুন এর বাস্তবতায় পৌঁছাতে আমরা কুরআনে হাকীমের মাঝে গভীরভাবে চিন্তা করি।
কুরআনে হাকীমে আল্লাহ সুব্হানাহু তাআলা তাঁর ইবাদতের হুকুম দিতে গিয়ে ইরশাদ করেন
يـٰۤـاَيُّـهَاالنَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّـكُمُ الَّذِىْ خَلَقَكُمْ وَالَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَـتَّقُوْنَ (البقرة২১)
এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা يٰۤـاَيُّهَا النَّاسُ শব্দ ব্যবহার করেছেন। যার অর্থ হয় হে মানবগণ! এখানে ‘ النَّاسُ’ শব্দের ভিতর রাসূলে কারীম থেকে নিয়ে কেয়ামাত পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে আসবে সকলেই এই মানুষের অন্তর্ভুক্ত। এখানে না আছে কোনো যুগের শর্ত, না আছে কোনো অঞ্চল নির্দিষ্ট? বরং সকল মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিচ্ছেন (يٰۤـاَيُّهَا النَّاسُ) হে মানব সকল! পৃথিবীর ৬ শত কোটি মানুষ সকলেই মানুষের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু প্রশ্ন হলো ৬ শত কোটি মানুষ সকলেই কি আল্লাহর ইবাদত করে? অথবা কমপক্ষে এতটুকু কি তাদের জানা আছে যে, আমাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদত করতে হবে? যদি উত্তর ‘না’ হয়। তাহলে কোনো মুসলমানের পক্ষ থেকে অমুসলিম ভাইদের কাছে এ কথা পৌঁছানো হয়েছে কি? তবে এ গুরুদায়িত্বটি কাদের?
এমনি ভাবে যদি প্রশ্ন করা হয় মুহাম্মাদ কাদের নবী? হিন্দুভাইদের পক্ষ থেকে উত্তর আসবে তিনি মুসলমানদের নবী। তারা বলবে, আমাদের অবতারতো শ্রীকৃষ্ণ ও রামের রূপধারণ করে এসেছিলেন। তদ্রƒপ খ্রিস্টান ভাইদের পক্ষ থেকে উত্তর আসবে, তিনি হলেন মুসলমানদের নবী। আমাদের নবী হলেন ঈসা (আ.)। ঠিক মুসলমানদের পক্ষ থেকেও উত্তর আসবে তিনি তো আমাদেরই নবী। আচ্ছা এই উত্তরগুলো কি সঠিক? রাসুলুল্লাহ কি শুধু মুসলমানদেরই নবী ?
আসুন! আমরা কুরআনে হাকীম থেকে জানি, কুরআন এ ব্যাপারে কী বলে? কুরআনে হাকীমে আল্লাহ তা’আলা বলেন
قُلْ يٰۤـاَيُّهَا النَّاسُ إِنِّىْ رَسُوْلُ اللّٰهِ إِلَيْكُمْ جَمِيْعًا
হে নবী! আপনি বলে দিন, হে মানব জাতি! আমি তোমাদের সকল মানুষের জন্য রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। -আরাফ-০৭:১৫৮
অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, ইহুদী, খ্রিস্টান ইত্যাদি, এদের সকলেরই নবী হলেন হযরত মুহাম্মদ । এখন প্রশ্ন হলো, আদৌ কি তারা জানে যে, হযরত মুহাম্মাদ তাদেরও নবী?
রাসুলুল্লাহ কে কুরআন দান করা হয়েছে। যদি হিন্দু ভাইদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়, বলুনতো কুরআন কাদের কিতাব? উত্তরে তারা বলবে এটা মুসলমানদের কিতাব। আমাদের কিতাবতো হলো গীতা, রামায়ণ ইত্যাদি। খ্রিস্টান ভাইয়েরা এমন প্রশ্নের উত্তরে বলবে, আমাদের কিতাব তো হলো বাইবেল, আর কুরআন হলো মুসলমানদের কিতাব। ইহুদীরা একই প্রকার উত্তর প্রদান করবে। এবার আমরা দেখি কুরআন এ ব্যাপারে কী বলে।
কুরআনে হাকীমে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেনÑ
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىْ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰى وَالْفُرْقَانِ (البقرة :১৮৫)
অর্থ : বরকতময় রমজান মাসে সকল মানুষের হেদায়াতের জন্য কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।
শুধু মুসলমানদের হেদায়াতের জন্য নয়। অর্থাৎ এই মহা পবিত্র গ্রন্থ সকল মানুষের জন্য হেদায়াতনামা।
এখন প্রশ্ন হলো ৬০০ কোটি অমুসলিম ভাই-বোন তারা কি জানে যে এই কিতাব তাদের জন্যও পথ প্রদর্শক? এর উত্তরে আপনি নিজেই বলবেন, অবশ্যই তারা জানে না। আমরা জানি। আমরা কি তাদের কাছে এ বার্তাটি পৌঁছিয়েছি?
এক অমুসলিম ভাইকে বলা হলো, কুরআন তোমাদের জন্যও পথ প্রদর্শক, হেদায়াতনামা। সে খুবই আশ্চর্যের সাথে বলল, এটা যদি আমাদের কিতাব হতো, তাহলে এতোদিন তোমরা আমাদেরকে দাওনি কেন? উত্তরে বলা হলো, এ কথা অধিকাংশ মুসলমানও জানে না। মুসলিম-অমুসলিম সকল মানুষকে অন্ধকার ও পথভ্রষ্টতা থেকে বাঁচানোর জন্য এই কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছে। শুধু মুসলমানদের জন্য অবতীর্ণ করা হয়নি। উল্লেখিত আয়াত তিনটিকে যদি একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ি তাহলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যাবে, এই আয়াতগুলোতে الناس শব্দ ব্যাবহার করা হয়েছে। এই আয়াতগুলো একত্রে আমরা এভাবে বুঝতে পারি।
১. ইবাদাত (সকল মানুষের জন্য)
يٰۤـاَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّـكُمُ الَّذِىْ خَلَقَكُمْ
২. রিসালাত (সকল মানুষের জন্য)
قُلْ يٰۤـاَيُّـهَا النَّاسُ إِنِّىْ رَسُوْلُ اللّٰهِ إِلَيْكُمْ جَمِيْعًا
৩.কুরআন (সকল মানুষের জন্য)
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىْ أُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْاٰنُ هُدًى لِّلنَّاسِ.
৪. মুসলিম (সকল মানুষের জন্য) اخرجت للناس………..
এর উদ্দেশ্য হলো, সকল মানুষকেই আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। চাই সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান যেই হোক না কেন। হযরত মুহাম্মাদ মুসলিম-অমুসলিম সকল মানুষের নবী এবং কুরআন পুরো দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য পথ পদর্শক। চাই সে যে কোন ধর্মেরই হোক না কেন।
এখানেও সেই একই প্রশ্ন উঠবে, বাস্তবে এ সব কিছু জানে কারা?
কারা এর ধারক বাহক ? প্রকৃত পক্ষে আমরা মুসলমানরাই এ ব্যাপারে জ্ঞাত। আমরাই এর ধারক-বাহক। এখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে এই মুসলমানদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে কেন? কুরআনে হাকীম এই প্রশ্নের উত্তর এভাবে দেয়।
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ (العمران:১১০)
তোমরাই সর্বোত্তম জাতি। তোমাদেরকে বের করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎকাজ হতে নিষেধ করো। এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করো।”
-আলে ইমরান:১১০
অর্থাৎ বিশ্বের মানুষকে আল্লাহ তাআলা দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন।
১. خَيْرَ امة উত্তম জাতি। ২. الناس মানুষ। অর্থাৎ ২০০ কোটি মুসলমান যারা خيرامة উত্তম জাতি। আর বাকি ৬০০ কোটি অমুসলিম “মানুষ”এর জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। ২০০ কোটি মুসলমান خير امة উত্তম জাতি, ৪৮০কোটি অমুসলিম মানুষকে المعروف সৎকাজের আদেশ দিবে এবং المنكر অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে।
উল্লেখিত আয়াতের তাফসীরে মুফাস্সিরগণ লিখেছেন : خير امة হওয়ার জন্য ৩টি শর্ত।
১. امربالمعروف সৎকাজের আদেশ।
২.نهي عن المنكر অসৎকাজের নিষেধ।
৩. ايمان بالله আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা।
একটু চিন্তা করি, আমরা কি এই তিনটি শর্তের ওপর আমল করছি? যদি উত্তর নেতিবাচক হয়, তাহলে আমরা কি উত্তম জাতি? যদি উত্তর হয়, ‘না’ তাহলে এই জাতিকে خير امة উত্তম জাতি হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত: উত্তম জাতি বানানোর ফিকির করতে হবে কি-না? এ জন্য আমাদেরকে امربالمعروف এবং نهي عن المنكر অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের দাওয়াত ও তাবলিগ করতে হবে। যদি আমরা এই জিম্মাদারী আদায় না করি, তাহলে আমাদের উপর আল্লাহর কঠিন শাস্তি আসতে পারে।
আল্লাহর দরবারে দুআ করি, তিনি যেন উম্মতকে তাদের যিম্মাদারীর হক আদায় করার তৌফিক দান করেন। আমিন।