শনিবার, ২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
আনাস বিন ইউসুফঃ চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ৷ পাহাড়ের চুড়ায় কেমন এক শুনশান নিরবতা ঢেকে রেখেছেজ আমাদেরকে ৷ নতুন অভিজ্ঞতা ৷ ভিন্ন রকম অনুভূতি ৷ মনে হচ্ছে কোন শ্বশ্মানে বসে আছি ৷ একটু পরেই শৃগালগুলো চিৎকার করতে শুরু করবে ৷ দূর থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ কানে আসবে ৷ ভয়ে তখন বুকটা দুরু দুরু করবে ৷
দিনব্যাপি নির্বাসিত মানুষগুলোর এতো শত কোলাহল এখন আর নেই ৷ সেসব হইহুল্লোড় আর ব্যস্ত হাটা-চলা হারিয়ে গেছে সাময়িক নির্জনতার আড়ালে ৷
দিনের বেলায় শত শত শিশু আমাদের আশপাশ ঘিরে রাখতো ৷ কলম বের করার জন্য পকেটে হাত ঢুকালেও দৌড়ে আসতো ওরা ৷ কিছু পাবার আশায় নিষ্পাপ কচি হাতটা বাড়িয়ে দিতো সামনে ৷
শিশুরা এখন নীড়ে ফিরেছে ৷ হয়তো চার-পাঁচটি শিশু এক বালিশে মাথা রেখেই শান্তিতে ঘুমাচ্ছে ৷
ওদের মায়েরা ওয়ালুদ ৷ দৃষ্টান্তযোগ্য ওয়ালুদ ৷ অধিক পরিমানে সন্তান গ্রহনে দারুণ সক্ষম ৷ এই ওয়ালুদ মায়েদের প্রতিটি সন্তানের জীবন যদি কুরআন-সুন্নাহর আলোয় উদভাসিত হয়ে উঠে তবে কাল বিচার দিবসে এদের নিয়ে গর্ব করবেন প্রিয় নবীজী সাঃ ৷
আগামির ভবিষ্যত সদ্য ফুটন্ত এই গোলাবগুলো ফিরে গেছে মায়ের বুকে ৷ খাদ্যের সন্ধ্যানে সারাদিন ক্যাম্পের এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করেছে ৷ এখন রাতটা কাটাবে মায়ের বুকে, প্রিয় পরশে ৷ ভোরের আলো ফুটা মাত্র ওরাও ফুটে উঠবে ৷ ওদের কিচির মিচিরে পাহাড়ের চারিপাশ মুখোরিত হয়ে উঠবে পুনরায় ৷
নিস্তব্ধ নিরবতার মাঝে চেয়ার পেতে বসে আছি আমি ৷ ঝিঝি পোকারা ঝি ঝি শব্দ করে যাচ্ছে বিরতিহীন ৷ মেঘলা আকাশে আজ চাঁদ মামারও দেখা নেই ৷ দূর আকাশের তারাগুলো মিটমিট করে আলো দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছে অনবরত, কিন্তু পারছে না ৷
আচমকা হঠাত দূর থেকে কোলের শিশুদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে বাতাসের সাথে ৷ হয়তো কোন দুঃখিনী মা তার আরামের ঘুম হারাম করে আদরের দুলালকে কোলে নিয়ে নাচাচ্ছেন, আর শান্ত করার চোষ্টা করে যাচ্ছেন ৷
সমতট থেকে অনেকটা উঁচুুতে বসে আছি ৷ আজ দিনের বেলা রোদের প্রখরতা ছিল প্রচন্ড ৷ দিনের সে ভেপসা গরম এখন আর নেই ৷ অনেকটাই কমেছে ৷
হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন পরবেশে একটুখানি শীতল ছোঁয়া ৷ আকাশের শিশির পড়তে শুরু করেছে পাহাড়ের বুকে ৷ এ যেন এক অন্যরকম ভাললাগা ৷ মোহনীয় পরিবেশ ৷
খোলা দিগন্তের নিচে বসে আছি ৷ আমার চারপাশে গভীর ঘুমিয়ে নিমজ্জিত উম্মতে মুহাম্মাদীর হাজারো সদস্য ৷ খেয়ে না খেয়ে দিন পার করলেও রাতে স্বস্থির ঘুমে ডুবে থাকে ওরা ৷ একেবারে নিশ্চিন্ত মনে ৷ রক্ত নদী পেরিয়ে শুধুমাত্র বেচে থাকবার আশায় এপারে আসা লোকগুলোর ঘুমের ঠিকানা পাহাড়ের উঁচু-নিচু ঢালুতে ৷ কেউবা দুই পাহাড়ের মধ্যখানে ৷
হঠাত হঠাত কিছু শব্দ শুনে দারুণ কৌতুহল সৃষ্টি হল মনের মধ্যে ৷ বুঝার চেষ্টা করলাম, শব্দগুলো কিসের…!
হ্যাঁ, ধরতে পেরেছি ৷ পানি পড়ার শব্দ ৷
কিন্তু এই গভীর রাতে পানির আওয়াজ কেন?
ভাবনার জগতটা প্রসারিত হতে শুরু করলো…
খলিফাতুল মুসলিমিন হযরত ওমর রাঃ রাতের বেলা ঘুরে ঘুরে উম্মতের খবর নিতেন ৷ কে কী অবস্থায় আছে নিজে গিয়ে দেখে আসতেন ৷ খলিফা আজ পৃথিবীতে নেই ৷ তাই রাতে উম্মতের খবর নেয়ারও কেউ নেই ৷ তবে ওমরের আদর্শে উজ্জীবিত কিছু আল্লাহর বান্দা তো এখনো বেচে আছেন জমিনে ৷ তারা নিশ্চই উম্মতকে নিয়ে ফিকির করছেন… ৷
কৌতুহল নিরসনের লক্ষে একটা টর্চ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ক্যাম্প থেকে ৷ দেখি তো- সুর্যাস্তের পর মুহূর্তেই নিরব হয়ে যাওয়া মানুষগুলো কেমন আছে ! কী অবস্থায় রাত কাটাচ্ছে… !!
আকা-বাকা রাস্তা আর উঁচু-নিচু ঢাল বেয়ে হারিয়ে গেলাম রোহিঙ্গা বসতির অভ্যন্তরে ৷ এরপর যা দেখছি তা আমাকে বিস্মিত করেছে ৷ কখনো বাকরুদ্ধও হয়েছি ৷
কিছু রোহিঙ্গা পুরুষ নিজের ঘুম বাদ দিয়ে বাঁশ-কাইম আর পলিথিনে নির্মিত অস্থায়ী তাবুর দরজায় চেয়ার পেতে কিংবা পিড়ি বিছিয়ে বসে আছে ৷
আমি মনে মনে এই বসে থাকার কারণ খুঁজতে গিয়ে দু’টি বিষয় আবিষ্কার করলাম-
এক. তাবুর ভেতরে পর্যাপ্ত জায়গা নেই ৷ বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানাদী এবং বোন-ভাগিনারা শোয়ার পর বড়দের জন্য কোন ব্যবস্থা নেই ৷ তাই দরজায় বসেই রাত কাটাবার চেষ্টা করছে তারা ৷
দুই. প্রাপ্ত বয়স্ক যুবতী মেয়ে এবং স্ত্রীকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে কিছু বাবা নিজেই পাহাড়া দিচ্ছেন ৷ নিজের আরামকে বিসর্জন দিয়ে ঘরে থাকা নারীর সম্ভ্রম বাঁচানোর সংগ্রাম করছেন ৷ এটা আবিষ্কার করে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই…
টর্চ হাতে ধীর পদে হাটছি ৷ এক পর্যায়ে ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে প্রবেশ করি ৷ লক্ষ করলাম, কোন কোন তাবুর ভিতর থেকে গুনগুন শব্দ আসছে ৷ হয়তো কুরআন তেলোয়াত চলছে ৷ অথবা শোকাহত মায়েরা মোনাজাতে অশ্রু ঝড়াচ্ছেন বিধাতার আশ্রয় চেয়ে… ৷
আমি এগিয়ে চললাম আরো সামনের দিকে ৷ রাতের পাহাড়ে আরো কিছুর সন্ধ্যান মিলে কিনা সে প্রত্যাশায় ৷ ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ফিরে এলাম নিজেদের ক্যাম্পে ৷
এর মধ্যে আমার মূল কৌতুহলটাও কেটে গেছে ৷
যে কৌতুহলের কারণে এই অন্ধকার রাতে ক্যাম্প থেকে বেরিয়েছিলাম ৷ পানি পড়ার যে শব্দ শুনে প্রথমে বের হয়েছিলাম সে শব্দের রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি ৷
পানির শব্দগুলো ছিল আগত রোহিঙ্গাদের মধ্যে পর্দানশীল নারীদের অসম্ভব কষ্টের সাক্ষী ৷ শরীয়তের বিধান পালনার্থে দিনের বেলা এসকল নারী গোসলের জন্য কোথাও বের হয় নি ৷ বের হলে পর্দার বিধান করার ক্ষেত্রে বিগ্ন ঘটবে ৷ এখন সবাই যখন ঘুমে নিমজ্জিত, চারদিক অন্ধকারে ঢেকে আছে তখন তারা বেড়িয়েছে শরীরটাকে শীতল করার জন্য ৷ একটুখানি সুখের খোঁজে! তাই সুযোগমত কোন একটা টিউবওয়েলে গিয়ে মগে পানি নিয়ে গা ভিজিয়ে নিচ্ছে ৷
এমন নারীর সংখ্যা অনেক ৷
এরা সংগ্রাম করে বাঁচার জন্য ৷
সংগ্রাম করে নিজের সতিত্ব হেফাজতের জন্য ৷
এরাই আজকের পাহাড়ী আঁধারের আলোকিত নারী ৷