বুধবার, ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ২২শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

রোহিঙ্গা মুহাজির ক্যাম্পের পথে প্রান্তরে! (শেষ পর্ব) – লুৎফর ফরায়েজী

৩য় পর্বের পর থেকে

গোসল করায় শরীরটা হালকা হল। নামায শেষে খানা খেয়ে এবার মসজিদ নিয়ে আলোচনা শুরু। মাওলানা নাজমুলকে বললাম-মসজিদ করার মাকসাদ শুধু মসজিদ নয়। এটার মাধ্যমে আমরা দ্বীন প্রচারের কাজ করবো। যদিও ত্রাণ দিচ্ছে অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরাই। কিন্তু স্থানে স্থানে ব্র্যাকসহ অন্যান্যা সুদী এনজিওগুলো তাদের ব্যানার টানিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তারা এ সুযোগে মানুষকে ধর্মহীন করার হীনচেষ্টাও করতে পারে। তাই আমাদের দাওয়াতী কার্যক্রম বন্ধ করা যাবে না। আমার টার্গেট মসজিদকে কেন্দ্র করে দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করা। আমি সময় পেলেই উক্ত মসজিদে আসবো। থাকবো। দ্বীনী কথা শেয়ার করবো।

মসজিদের নাম কী হবে? জানালামঃ মসজিদে মুয়াবিয়া রাঃ। খুশি হলেন নাজমুল ভাই। সুন্দর নাম।

বললামঃ মসজিদের সাথে একটি টয়লেট এবং একটি টিউবওয়েলও লাগবে। তাই না।

বললেনঃ হ্যাঁ, এছাড়া পূর্ণ হবে না।

ঠিক আছে। কত টাকা হলে এ তিনটি কাজ হতে পারে? জানালেন এক লাখ টাকা হলে হয়ে যাবে।

এক লাখ টাকা মাওলানার হাতে বুঝিয়ে দিলাম। বললামঃ আপনি যায়গা দেখে কাজটি সম্পন্ন করে রাখুন। আমি আগামী সপ্তাহের দিকে আবার আসবো। ইনশাআল্লাহ উক্ত মসজিদে এসে নামায পড়বো।

উক্ত মাদরাসার ত্রাণ ফান্ডে দুই হাজার টাকা অনুদান দিয়ে বিদায় নিলাম।

এবার যাত্রা পালংখালীর দিকে। পালংখালীতে পৌঁছে কয়েকজন রোহিঙ্গা আলেমকে কিছু সহযোগিতা করে ছুটলাম কুতুপালং পানে। সেখানে অবস্থান করছিল বার্মা থেকে আগত কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। বার্মাতে যাদের ছিল বিশাল ব্যবসা। নিজস্ব গাড়ি বাড়ি। কিন্তু আজ পথের ফকীর। কুতুপালং বাজারে দেখা হল ভাইদের সাথে। আগে থেকেই ফোনে যোগাযোগ হওয়ায় সহজ হয়েছিল। এক চা দোকানে বসে তাদের শান্ত্বনা দিলাম। মানুষগুলোর চেহারায় আভিজাত্য পরিষ্ফুটিত। গত বছর তাদের এক পরিবার পালিয়ে এসেছিলেন। দুই মেয়ে ঢাকায় এক মহিলা মাদরাসায় পড়াশোনা করছে। সেখান থেকেই তাদের ব্যাপারে জানা। এবার বাকি পরিবার এসেছে। কথাবার্তায় পরিস্কার শিক্ষিত। সম্ভ্রান্ত। এখানকার ছোট ছোট তাঁবুতে থাকা তাদের জন্য অস্বস্থিকর। কিন্তু ভাগ্য মেনে তাই করছেন। আগে দান করতেন। এখন দান পাবার আশায় বসে থাকেন। কিছু হাদীসের বাণী শুনিয়ে দশ হাজার টাকা দিলাম পাঁচ পরিবারকে।

মাগরিব নামাযের আজান বেজে উঠল মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে। নামায শেষে রাস্তায় দাঁড়ালাম সিএনজির আশায়। হাজারো শিশুর মাঝখানে আটকে গেলাম। টাকাতো আর নেই। খালি হাত। কি করতে পারি?

এক পিচ্ছি মেয়ে নির্বাক নয়নে তাকিয়ে আছে। কাছে গেলাম। জড়িয়ে ধরলাম বুকে। বললামঃ আম্মু! আমার কাছেতো কিছু নেই। কি দিবো তোমাকে? আমাকে মাফ কর। মাথায় চুমু খেলাম। মনের অজান্তে আমার চোখ দিয়ে অঝর ধারায় নেমে এল অশ্রু। চোখ মুছে বললামঃ আম্মু তুমি কিছু খাবে। মাথা নাড়ল। দোকানে নিয়ে গেলাম। মুড়ির প্যাকেট ঝুলছে দোকানে। হাতে ধরিয়ে দিতেই মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল। মনে হল আমি যেন বিশ্বজয় করেছি। এতোটা খুশি আচ্ছন্ন করল। সাথে সাথে আরো অজস্র হাত এগিয়ে এল। একে একে দোকানের সব ক’টি মুড়ির প্যাকেটই বিলি করা শেষ। কিন্তু চাহিদা শেষ হয়নি। অবশেষে তাদের কাউকে জড়িয়ে ধরে, কারো মাথায় হাত বুলিয়ে, কারো কাছে ক্ষমা চেয়ে ছুটলাম সিএনজি পানে। সিএনজি ছুটছে কক্সবাজারের পথে। মনটা পড়ে রইল রোহিঙ্গা ক্যাম্পের তাঁবুতে, গলিতে-রাস্তায়। এক রাশ বেদনা, অব্যক্ত কষ্টের যাতনা নিয়ে ফিরে চললাম ঢাকার পথে।

দেশ ও বিদেশের যেসব মুখলিস দাতাদের কল্যাণে এ সামান্য খিদমাত সম্ভব হল তাদের জন্য হৃদয় নিংড়ানো দুআ। নামগুলো প্রচারিত না হলেও কিরামান কাতিবীনের খাতায় নামগুলো লিখা থাকবে ইতিহাস হয়ে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা ভাইবোনদের কবুল করুন।

বিঃদ্রঃ
আগামী ১০ অক্টোবর মঙ্গলবার মসজিদে মুয়াবিয়া রাঃ পরিদর্শন ও খানিক ত্রাণ বিতরণে আবার মুহাজির ক্যাম্পে যাবার ইচ্ছে। আল্লাহ তাআলা সহজ করে দিন।

Archives

December 2023
S S M T W T F
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031