বুধবার, ২৯শে ফাল্গুন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ৩রা রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

নওমুসলিমদের সাক্ষাৎকার [পর্ব-০২] :: বোন আয়েশার (বেলোন্দ্র কোর)-এর সাক্ষাৎকার


মৃত্যুর পুর্বে ঈমান পেয়ে জান্নাতের দৃশ্য দেখেছি

বোন আয়েশার (বেলোন্দ্র কোর) সাক্ষাতকার

ঈমানের নেয়ামতের মূল্যায়ন করুন। ঈমানের সঙ্গে একদিন, ঈমানবিহীন হাজার বছর বেঁচে থাকার চেয়েও শ্রেয়। আর গোটা জগতের প্রতি রহমতস্বরূপ প্রেরিত নবীর উম্মত হওয়ার কারণে গোটা পৃথিবীর মানুষকে দুনিয়ার এই কয়েদখানা থেকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার ফিকির করুন। আমার এবং আমার পরিবারের জন্য দুআ করুন, যেন সবার শেষ নিঃশ্বাস ঈমানের উপর হয়।


আসমা যাতুল ফাওযাইন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
আয়েশা : ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ

প্রশ্ন : আয়েশা দিদি! কী ব্যাপার, এবার তো অনেক দিন পর এখানে এলেন?
উত্তর : বোন আসমা! আমি তো আসার জন্য উন্মুখ ছিলাম কিন্তু হযরতজীকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। কিভাবে যেন এবার তাঁকে পেয়ে গেলাম এবং সময় চেয়ে এসে পড়লাম।

প্রশ্ন : আসলে আমাদের এখান থেকে আরমুগান নামে একটি উর্দু মাসিক পত্রিকা বের হয়। আব্বু আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আমি যেন আরমুগানের জন্য আপনার একটি সাক্ষাৎকার নেই।
উত্তর : হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি আরমুগান সম্বন্ধে জানি। কিছু কিছু উর্দু পড়তেও শিখেছি। এখন আরমুগানও দেখে দেখে পড়তে পারি।

প্রশ্ন : প্রথমে আপনার পারিবারিক পরিচয় বলুন।
উত্তর : আমি ১৯৬৫ সালের ৩ রা জুন পিরোজপুর জেলার এক গ্রামের শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। আব্বুর নাম শ্রী ফতেহ সিং। তিনি ছিলেন এলাকার শিক্ষিত জমিদারদের একজন। আমার পুরনো নাম ছিল বেলোন্দ্র কোর। শহরের গুরু গোবিন্দ সিং কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেছি। জলন্ধরের এক শিক্ষিত পরিবারে আমার বিয়ে হয়। আমার স্বামী তখন পুলিশের এস.ও (ং.ড়) ছিলেন। সাহসিকতা ও দক্ষতার কারণে পদোন্নতি হতে হতে তিনি ডি.এস.পি. হয়ে যান। আমার দুই ছেলে এক মেয়ে। তিনজনই পড়াশোনা করছে।

নওমুসলিমদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসুন 

প্রশ্ন : আপনার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কিছু বলুন!
উত্তর : আশা কোর নামে আমার একটি ছোট বোন ছিল। আব্বু তাকেও পুলিশের এক থানা ইনচার্জের সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন। সে ছিল অত্যন্ত সুন্দরী। তার স্বামী তাকে খুবই ভালোবাসত। বিবাহের পর থেকে আমার বোনটি অধিকাংশ সময়ই অসুস্থ থাকতো। নিত্যই তার অসুখ-বিসুখ কোনো একটা লেগে থাকতো। চিকিৎসা করালে কিছুটা ভালো হতো, তারপর আবার অসুস্থ হয়ে পড়তো। তার স্বামী এতে অনেক টাকা ব্যয় করেছে, কিন্তু কোনো উপকার হয়নি। বাধ্য হয়ে ঝাঁড়ফুককারী করিবাজকেও দেখিয়েছে। কেউ বলল, তার উপর ‘উপরের প্রভাব’ (জ্বীন-ভুত) রয়েছে। কিন্তু কেউ চিকিৎসা করতে পারেনি। একজন বলল, মালির কোটলায় এক মহিলা আছে, সে এর চিকিৎসা করে। তাকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হল। সে মহিলা কিছু ঝাড় ফুঁক করার পর সে আরাম বোধ করল। তিনি আশাকে বললেন, তুমি এই দু’চারদিনের কষ্ট সহ্য করতে পারছো না, তাহলে দোযখের চিরস্থায়ী কষ্ট সহ্য করবে কিভাবে? এজন্য সেই কষ্ট দূর করার ফিকির করো। আর তার ব্যবস্থা হল, তুমি মুসলমান হয়ে যাও। আমার বিশ্বাস মুসলমান হয়ে গেলে তোমার এই রোগ ভালো হয়ে যাবে। তারপর আমি তোমাকে আমার হযরতজীর কাছে নিয়ে যাবো। তিনিও তোমার জন্য দুআ করবেন। আমি আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা তোমাকে অবশ্যই সুস্থ করে দিবেন।
আশা তাকে বলল, ঠিক আছে, আমি আমার স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে দেখব। তিনি বললেন, ঈমান আনা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ ব্যাপারে স্বামীর অনুমতিরও প্রয়োজন নেই। বরং স্বামী যদি বিরোধিতাও করেন এমনকি মারধোর করে বা তাড়িয়েও দেন তবুও ঈমান গ্রহণ করার মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত। কেননা এতে সৃষ্টিকর্তা মালিককে সন্তুষ্ট করে সে চিরস্থায়ী জান্নাত অর্জন করতে পারবে। আশা বলল, তারপরও পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করা এবং চিন্তা-ভাবনার দরকার আছে। তিনি বললেন, ঠিক আছে, তুমি যথা শ্রীঘ্রই পরামর্শ করে ফিরে আসবে। আমি তোমাকে কালিমা পড়িয়ে আমাদের হযরতজীর ওখানে পঠিয়ে দেবো।
সে বাড়িতে ফিরে স্বামীকে বলল, আমি বেশ আরাম বোধ করছি কিন্তু আপা বলেছেন, তুমি মুসলমান হয়ে গেলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। আশার স্বামী তাকে অত্যন্ত ভালোবাসতো। বলল, যা ইচ্ছা কর, যা ইচ্ছা হও তুমি সুস্থ হলেই আমি খুশি। আশা ফোন করে আপাকে বলল, আমাকে আপনাদের হযরতজীর ঠিকানা বলুন। আমি গিয়ে তার হাতেই মুসলমান হতে চাই। তিনি হযরতজীর ফোন নাম্বার দিয়ে দিলেন। ২৫ শে মে, ২০০৪ সালের সকালে আশা হযরতজীকে (মাওলানা কলিম সিদ্দিকী সাহেব) ফোন করল। আশা আমাকে বলেছে, আমি হযরতজীকে বললাম, আমি ইসলাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে আসতে চাই। তবে আমার স্বামী, সন্তান এবং ঘরের লোকজন মুসলমান হবে না। আমি একাই মুসলমান হবো। মাওলানা সাহেব কারণ জানতে চাইলে মালির কোটলার সেই আপার সঙ্গে আশার যে কথাবার্তা হয়েছিল তা খুলে বলল। হযরতজী বললেন, তুমি তার কাছেই কেন কালেমা পড়ে নিলে না? আশা পীড়াপীড়ি করল, না জনাব, আমি আপনার নিকটই কালিমা পড়তে চাই। মাওলানা সাহেব বললেন, আমার নিকট পড়তে চাও তো এখনই ফোনে পড়ে নাও। আশা বলল, না, আমি আপনার নিকট হাজির হয়েই কালিমা পড়তে চাই। মাওলানা সাহেব বললেন, বোন! জীবন-মরণের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া তুমি তো অসুস্থও বটে। সুস্থ ব্যক্তিরই এক নিঃশ্বাসের ভরসা নেই, পরবর্তী শ্বাস সে নিতে পারবে কিনা তারও কোনো ভরসা নেই। তাই ফোনেই কালিমা পড়ে নাও। এখানে যখন আসবে তখন আবার নতুন করে পড়িয়ে দেবো। মাওলানা সাহেবের এ কথায় আশা বলল, ঠিক আছে পড়িয়ে দিন কিন্তু আসলটা আমি এসেই পড়বো।

মাওলানা সাহেব বললেন, আসলটা এখনই পড়ে নাও। নকলটা এখানে এসে পড়ো। আশা রাজী হয়ে গেল। মাওলানা সাহেব তাকে কালিমা পড়ালেন। ইসলামের মোটা মোটা কথাগুলো বোঝালেন। বললেন, এখন তোমাকে নামায শিখতে হবে এবং সব ধরনের অনৈসলামী উৎসব, পূজা এবং রুসুম থেকে বেঁচে থাকতে হবে। নাম জিজ্ঞেস করে মাওলানা সাহেব বললেন, আশার পরিবর্তে তোমার ইসলামী নাম রাখা হল ‘আয়েশা’, আর এটা আমাদের রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবি সাহেবার নাম। ফোন শেষ হলে সে তার ইসলাম গ্রহণের কথা খুশীতে পরিবারের সবাইকে জানিয়ে দেয়। স্বামীকেও সে একথা জানায়। আমিও জলন্ধর থেকে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। আমাকেও সে এ সংবাদ শোনায়।

আমার কিছুটা খারাপও লেগেছিল যে, ধর্ম বদল করে কিসের খুশি উদযাপিত হচ্ছে! মাওলানা সাহেবের সঙ্গে ফোনে কথা বলে এবং কালিমা পড়ে না জানি সে কি পেয়ে গিয়েছিল। আমি বারবার তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। মুখ নয় যেন ফুল ফুটে আছে। এক আশ্চর্য ধরনের নূর তার চেহারা থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছিল। ওকে বললাম, আশা! আজ তোমার চেহারা কেমন ঝলমল করছে। সে বলল, আমার চেহারায় ঈমানের নূর চমকাচ্ছে। সারাটি দিন সে এতই খুশি ছিল, সম্ভবত ঘরের লোকজন দশ বছরের মধ্যে এই প্রথমবার তাকে এত খুশি ও সুস্থ দেখল। কয়েক বছর পর সে নিজ হাতে খানা রান্না করল এবং সবাইকে জোর জবরদস্তি করে খাওয়ালো। ঘুমানোর পূর্বে সে গোসল করল এবং কালিমা পড়া আরম্ভ করল। কালিমাটি সে একটি কাগজে লিখে রেখেছিল। প্রথমে সে এটাকে ভালো করে মুখস্থ করল তারপর জোরে জোরে পড়তে লাগল।
হঠাৎ সে অসংলগ্ন ও এলোমেলো কথাবার্তা শুরু করে দিল। বলতে লাগল, ‘স্বর্ণের এই মহল কতই না মনোরোম। এটা কার মহল?’ যেন সে কারও সঙ্গে কথা বলছে। তারপর অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বলল, ‘এটা আমার। এটা আমার। এটা জান্নাতের মহল। সে খুব খুশী হল, আচ্ছা! আমি তাহলে জান্নাতে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর বলতে লাগল, ফুলের এই সুন্দর তোড়া কার জন্য এনেছো? আহা! এটা কতই না প্রিয় ফুল। আচ্ছা তোমরা আমাকে নিতে এসেছো। একটু পর হেসে দিয়ে বলল, আমি তোমাদের জেল থেকে মুক্ত হয়ে জান্নাতের দিকে চললাম। তারপর তিন বার জোরে জোরে কালিমা পড়ল এবং বসে বসেই বিছানার উপর একদিকে কাত হয়ে গেল। আমরা সকলেই ঘাবড়ে গেলাম। তাকে সোজা করে শুইয়ে দিলাম। ভাই সাহেব ডাক্তার ডাকতে গেলেন।

ডাক্তার এসে বলল, এ তো মারা গেছে। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে হাসতে হাসতে ঘুমিয়ে গেছে। ঘরের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে গেল। পরামর্শ হল, এÑতো মুসলমান হয়ে মারা গেছে। এখন আমরা যদি নিজেদের ধর্মানুসারে তাকে জ্বালিয়ে দেই তাহলে আমাদের কোনো বিপদও হতে পারে। সকাল বেলা ভগ্নিপতি মালির কোটলার আপাকে ফোন করে জানালেন, আশা গতরাতে ইন্তেকাল করেছে। আমাদের এখানে কোনো মুসলমান নেই। লাশের কাফন দাফনের জন্য মালির কোটলা থেকে কিছু লোক আসলে ভালো হয়। সকাল দশটায় একগাড়ী পুরুষ মহিলা আসল এবং তাকে ইসলামী রীতি অনুসারে দাফন করল। ১৯৪৭ সালের পর এই প্রথম এই শহরে কোনো মানুষের দাফন হল। আশার (আয়েশার) কবর আজও সেখানে বিদ্যমান।

প্রশ্ন : আপনি আপনার বোনের মুসলমান হওয়ার ঘটনা শোনালেন। সত্যিই ঘটনাটি খুবই বিস্ময়কর। আর মৃত্যুও কেমন ঈর্ষণীয়। জীবনে না কোনো নামায পড়েছেন, না রোযা রেখেছেন আর না কোনো ইসলামী আমল করেছেন কিন্তু কেমন পবিত্র হয়ে গোনাহের গ্লানি ধুয়ে মুছে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। কত সুন্দর, কত কাক্সিক্ষত মৃত্যু। এবার আপনার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি শোনান।
উত্তর : আসলে আমার ইসলাম গ্রহণ আয়েশার ইসলাম গ্রহণের সঙ্গে জড়িত। আশা এবং আমার মধ্যে সীমাহীন মহব্বত ছিল। তার হঠাৎ মৃত্যু আমাকে একেবারে ভেঙ্গে ফেলেছিল। কিন্তু তার মৃত্যু এবং ইসলাম গ্রহণপরবর্তী একদিনের জীবন আমাকে বারবার ভাবতে বাধ্য করেছিল, দুনিয়ার এই জেলখানা থেকে সে মাত্র একটি কালিমার বরকতে জান্নাতী মহলে পৌঁছে গেল। কেমন হাসিমুখে সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিল। আমি আমার বাপের বাড়ি এবং শ্বশুর বাড়িতে কয়েকজন লোককে মরতে দেখেছি। কেমন তড়পাতে তড়পাতে এবং কত কষ্টে তাদের প্রাণবায়ু বের হয়েছিল। আমি চিন্তা করতাম, আশা এমন কী পেয়েছিল যার ফলে এই কঠিন সময়টা এমন সহজে পার হয়ে গেল। এক রাতে স্বপ্ন দেখলাম, আশা অতীব সুন্দর হীরা জহরত খঁচিত কাপড় পরিধান করে সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার মাথায় মূল্যবান মুকুট শোভা পাচ্ছে। যেন সে রানী কিংবা শাহজাদী। জিজ্ঞেস করলাম, আশা! এমন সহজ মৃত্যু কীভাবে লাভ করলে? বলল, ঈমানের বদৌলতে। ঈমানের সঙ্গে একদিন বেঁচে থাকায় যে স্বাদ, শত-সহস্র বছর বেঈমান হয়ে বেঁচে থাকায়ও সে স্বাদ নেই। বিশ্বাস না হলে কিছু সময়ের জন্য মুসলমান হয়ে দেখে নাও। ব্যস, আমার চোখ খুলে গেল এবং হৃদয়ে তীব্র এক বাসনা জাগল, আমাকেও কিছুদিনের জন্য মুসলমান হয়ে দেখতে হবে। আমি স্বামীর নিকট আমার এই ইচ্ছার কথা জানালাম, আমি এক-দুই সপ্তাহের জন্য মুসলমান হতে চাই এবং দেখতে চাই, ঈমান কী জিনিস? আশার মৃত্যুর পর আমি যেহেতু সব সময়ই দুঃখিত থাকতাম এবং রুম বন্ধ করে চুুপি চুপি কাঁদতাম এজন্য আমার স্বামী অনুমতি দিয়ে দিলেন যাতে আমি কিছুটা সান্ত¡না লাভ করি। আর বললেন, ইসলাম গ্রহণ করে দেখতে পার। কিন্তু ভেবে দেখো তুমিও না আবার আশার মত একদিন পরে মরে যাও। আমি বললাম, আমি মরে গেলে সম্ভবত আমিও আশার মত জান্নাতে চলে যাবো। তারপর আপনি ভালো দেখে আরেকটা বিবাহ করে নিবেন। তবে খেয়াল রাখবেন আমার সন্তানদের আপনার নতুন স্ত্রী যেন কষ্ট না দেয়।

দুদিন পর আমি আমার ভগ্নিপতির নিকট থেকে মালির কোটলার আপার ফোন নাম্বার সংগ্রহ করলাম। তারপর আপার নিকট থেকে হযরতজীর (মাওলানা কালীম সিদ্দিকী সাহেব) ফোন নাম্বার নিলাম এবং আপাকে বললাম, আমি হযরতের সঙ্গে সাক্ষাত করতে চাই; উদ্দেশ্য মাত্র এক সপ্তাহের জন্য মুসলমান হওয়া। তিনি খুব হাসলেন। তারপর বললেন, মুসলমান হওয়া নাটক কিংবা অভিনয় নয় যে, সামান্য সময়ের জন্য নিজের রূপ বদলে নিবেন। এরপরও তিনি খুশী প্রকাশ করে বললেন, আপনি হযরতজীর নিকট গেলে তিনি আপনাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিবেন। তারপর আমি হযরতজীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। কয়েকদিন চেষ্টার পর তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হল। আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। তিনি আমার সাক্ষাতের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। হয়তো ফোনেই এর সমাধান করা যাবে। আমার খেয়াল হল, না জানি ফোনেই আমাকে কালিমা পড়িয়ে দেয় এবং মুসলমান হয়ে যেতে বলে। এজন্য বললাম, না জনাব! সেটা সাক্ষাতেই বলতে হবে। মাওলানা সাহেব আমাকে বললেন, বোন! আমি একেবারেই অকর্ম একজন মানুষ। আপনি যদি হাত দেখাতে চান কিংবা যাদু-টোনার চিকিৎসা করাতে চান অথবা তাবীয-তুমার লিখে নিতে চান তাহলে আমাদের বাপ-দাদারাও একাজ জানতো না। কাজেই আপনি আপনার সাক্ষাতের উদ্দেশ্যটি বলুন। যদি এখানে এসে তার সমাধান সম্ভব হয় তবেই কেবল আপনার সফর করা উচিত। অন্যথায় এত দীর্ঘ সফর করে পেরেশান হওয়ার কী লাভ হবে?

মাওলানা সাহেব যখন খুব জোর দিলেন তখন বলতেই হল, আমি এক সপ্তাহের জন্য মুসলমান হতে চাই। আমি আশার বড় বোন। যাকে আপনি ফোনে কালিমা পড়িয়েছিলেন। ঐ রাতেই সে ইন্তেকাল করেছিল। আশার নাম শুনে মাওলানা সাহেব বড় মহব্বতের সঙ্গে বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা, আপনি অবশ্যই আসুন। আপনার যখন সুবিধা তখনই আসবেন। বাকী আজকেই সময়টা জানিয়ে দিবেন। আপনার জন্য আমার সফর মুলতবী করব। মাওলানা সাহেব আমাকে জলন্ধর থেকে যাওয়ার পথ বাতলে দিলেন। সফরের তারিখ ধার্য হল। উপযুক্ত কোনো ব্যক্তি আমার সঙ্গে যাওয়ার ছিল না। তাই আমার নানী শাশুড়িকে প্রস্তুত করলাম। ঘরের কাজের মেয়েটি, নানী শাশুড়ী আর আমি এই তিনজন মিলে ১৪ই নভেম্বর সকাল নয়টায় খাতুলী পৌঁছলাম। নেমে দেখি মাওলানা সাহেবের গাড়ী আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে হাজির। সেই গাড়িতেই ফুলাত পৌঁছলাম। মাওলানা সাহেব তখন ফুলাতে ছিলেন না। কিন্তু আপনার আম্মুজান আমাকে জানালেন, হযরতজী দুপুর নাগাদ ফুলাত পৌঁছে যাবেন ইনশাআল্লাহ। আমরা গোসল সেরে নাশতা করে কিছুক্ষণ আরাম করলাম। তারপর আপনাদের বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে সাক্ষাত হল। আমি তাদের আমার সফরের উদ্দেশ্য বললাম। মুনীরা দিদি এবং আপনার আম্মুজান আমাকে বোঝালেন, এক সপ্তাহের জন্য কেউ মুসলমান হতে পারে না। বরং শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সময়ের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম, আমাকে নিজ ধর্ম একেবারেই ত্যাগ করতে হবে, এটা কী করে সম্ভব?

দুপুর দু’টোর সময় মাওলানা সাহেব এলেন। বাইরে অনেক মেহমান এসেছিলেন। মাওলানা সাহেব দুই মিনিটের জন্য আমাদের নিকট আসলেন। আমাকে সান্ত¡না দিলেন, আর খুব খুশি প্রকাশ করলেন, আপনি মরহুমা আয়েশার কারণে এখানে এসেছেন। আপনার গোটা পরিবারের সঙ্গেই আমার সুসম্পর্ক হয়ে গেছে। তারপর আমার ফিরে যাওয়ার প্রোগ্রাম জিজ্ঞেস করলেন। যখন বললাম, আমি তিনদিনের জন্য এসেছি তখন বললেন, বাইরে অনেক মেহমান এসেছেন। তাদের কয়েকজন আবার দু-তিন দিন ধরে আমার অপেক্ষা করছেন। রাতের বেলা ইনশাআল্লাহ আপনাদের সঙ্গে নিড়িবিলি আলোচনা করব।
বোন আসমা! আপনার মনে থাকবে হয়তো, আপনি আমাকে হযরতজীর কিতাব ‘আপ কি আমানত আপ কি সেবা মে’ এনে দিয়েছিলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি সেটা তিন তিন বার পড়ি। আমার অন্তর স্থায়ীভাবে ঈমান কবুল করার ব্যাপারে পরিষ্কার হয়ে গেল। মাগরিবের নামায পড়ে মাওলানা সাহেব আমাদের কাছে এলেন। আমাকে ঈমানের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বোঝালেন। মৃত্যু পরবর্তী জান্নাত-জাহান্নাম এবং আপন সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করার কথা বললেন। ‘আপকি আমানত’ পড়ে আমার দিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য ইসলাম গ্রহণের খেয়াল শেষ হয়ে গেল। আমি তাঁর নিকট আমার ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছা পেশ করলে তিনি আমাকে কালিমা পড়িয়ে দিলেন। ঘরের সকল মহিলা সমবেত ছিল। আমি বললাম, আপনি কি আমার জন্য আয়েশা নামটিই রাখতে পারেন? বললেন, কেন নয়? আপনার নামও আমি আয়েশাই রাখছি। আর আয়েশা ছিলেন আমাদের নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অত্যন্ত প্রিয় সহধর্মিনী।

আসমা! আপনার মনে থাকবে হয়তো, আমি মাওলানা সাহেবকে দুটি প্রশ্ন করেছিলাম। আমি লক্ষ করছিলাম, মাওলানা সাহেব আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল পরিবারের মহিলাদের দিকে নিবদ্ধ। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলেছেন কেন? তিনি বলেছিলেন, ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে পর্দার নির্দেশ দিয়েছে। যে সকল মহিলার সঙ্গে ইসলামের বিধি মোতাবেক একজন পুরুষের বিবাহ হতে পারে তারা সকলেই সে পুরুষের জন্য ‘নাÑ মাহরাম’। ইসলাম এদের সঙ্গে পর্দা করার নির্দেশ দেয়। সত্যকথা হল, আপনাদের সঙ্গে আমার পর্দার আড়াল থেকেই কথা বলা উচিত, কিন্তু এতে আপনাদের কাছে পর পর মনে হতে পারে ভেবে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে ইসলামের বিধানের উপর আমল করছি। কেননা ঈমানের দাওয়াতের মত এত বড় ইবাদতের মধ্যে কোনো নাÑমাহরামের প্রতি দৃষ্টিপাতের গুনাহ হলে তাতে প্রভাব থাকে না। আমি বললাম, আমার বোন আশা ঈমান গ্রহণের কথা বলেছিল এত অস্বীকারের পরেও আপনি তাকে ফোনেই কালিমা পড়িয়েছেন। ঠিক এ কারণেই আমি আপনাকে আসার উদ্দেশ্য বলতে চাইনি , না জানি আমাকেও আবার ফোনেই কালিমা পড়িয়ে দেন। কিন্তু তবুও আপনি আমাকে ফোনে কালিমা পড়ার কথা বলেন নি কেন?

হযরতজী জবাব দিলেন, ফোনে কালিমা পড়ানোটা কোনো প্রতারণা নয় বরং ক্ষণস্থায়ী পানির মত ক্ষয়শীল জীবনের দিকে লক্ষ করে এবং সত্যিকার সহমর্মিতার ভিত্তিতে করে থাকি। সত্যিই আপনার ব্যাপারে কেন জানি একথাটা মনে ছিল না। আমার ভুল হয়ে গেছে। আল্লাহ না করুন, যদি পথিমধ্যে কিংবা এই সময়ের মধ্যে আপনার ইন্তেকাল হয়ে যেতো তাহলে কী অবস্থা হতো! কিংবা আমারই যদি ইন্তেকাল হয়ে যেতো, তাহলে আমার জন্যও এটা বড় বঞ্চনার কাজ হতো। জানি না কোন্ বে-খয়ালে আমার এই ভুল হয়েছিল। ফলে আপনি চার-পাঁচটি দিন ইসলাম থেকে বঞ্চিত রইলেন এবং এত বড় কল্যাণময় কাজে বিলম্ব ঘটে গেল। আল্লাহ তাআলা আমাকে ক্ষমা করুন। সত্যিই আমার বড় ভুল হয়ে গেছে। আসলে আল্লাহ তাআলাই কাজ করনেওয়ালাদের অন্তরে বিভিন্ন অবস্থা সৃষ্টি করে দেন। আপনি এক সপ্তাহের জন্য ইসলাম গ্রহণ করতে চাচ্ছিলেন। স্পষ্ট যে, এটা কোনো খেলাধূলা নয়। ইকবাল একজন বিখ্যাত কবি বলেছেন,

শহীদী এই ঈদগাহে খুব ভেবে চিন্তে হাজির হও
যেমন ভাবছো, এত সহজ নয় মুসলমান হওয়া।

ইসলাম গ্রহণ করা মানে নিজের চাওয়া ও আমিত্বকে বিলিন করে দেয়া। এজন্য আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলা যথেষ্ট ছিল না। কাজেই ফোনে কালিমা পড়ানোর কথা তিনি আমার অন্তরে ঢালেন নি। কিন্তু আশার সঙ্গে কথা বলার সময় আমি অনুভব করছিলাম, একে যদি এক্ষুণি কালিমা না পড়াই তাহলে দু একদিনের মধ্যেই হয়তো তার ইন্তেকাল হয়ে যাবে। হযরতজী আমাকে বোঝালেন, এখন সর্বপ্রকার কুরবানী পেশ করে এই ঈমানকে কবর পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। এতে আপনার উপর বহু রকমের কষ্ট আসতে পারে। বিভিন্ন ধরনের কুরবানী দিতে হতে পারে। সামান্য মাটির হাঁড়িও ভালো কিনা বাজিয়ে দেখা হয়। তাহলে এমন মহামূল্য ঈমানের গ্রহীতাকেও পরীক্ষা করা হতে পারে। আপনি যদি ঈমানের ওপর জমে থাকতে পারেন তাহলে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে অনুভব করবেন, কত সস্তায় আপনি কত দামী নেয়ামত অর্জন করেছেন। হযরতজী তাঁর পরিবারের মহিলাদের আমাকে নামায, খানা-পিনা ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে বললেন আর আমার নানী এবং বুয়ার ব্যাপারেও খোঁজ-খবর নিলেন। আম্মুজান আর মুনীরা দিদি তাদের দুজনকে বুঝাতে লাগলেন। পরদিন হযরতজী সফরে চলে গেলেন। আমাদের ফিরে আসার দুই ঘণ্টা পূর্বে প্রত্যাবর্তন করলেন। তিনি নানী শাশুড়ী আর বুয়াকে বোঝালেন, আপনারা কেন এই দৌলত থেকে বঞ্চিত থাকবেন? তারা আগে থেকেই বেশ কিছুটা প্রস্তুত ছিলেন হযরতজীর কথায় তারাও এবার কালিমা পড়তে রাজী হয়ে গেলেন। তিনি তাদের কালিমা পড়ালেন। বুয়ার নাম মারিয়াম আর নানীর নাম আমিনা রাখলেন। আমরা খুশি মনে সাফল্যের সঙ্গে বিদায় নিলাম। ঘরের সকলে আমাদের এমন মহব্বতের সঙ্গে বিদায় দিল যেন আমরা এই পরিবারেই জন্ম গ্রহণ করেছি এবং এই পরিবারেরই একজন সদস্য। কেন জানি এখনও আমি যখন ফুলাত অথবা দিল্লী আসি, মনে হয় আমি যেন বাপের বাড়ি এসেছি।

প্রশ্ন : শুনেছি বাড়িতে যাওয়ার পর আপনার স্বামীর ইন্তেকাল হয়ে গিয়েছিল. তখন আপনার অবস্থা কী ছিল? আর তার ইন্তেকালই বা কিভাবে হয়েছিল?
উত্তর : হযরতজী আমাকে বলেছিলেন, এখন আপনার আত্মীয়দের সঙ্গে আপনার ভালোবাসার দাবী হল, তাদের সবাইকে আপনি দোযখের আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন। আপনার স্বামীকেও ইসলামের দিকে নিয়ে আসবেন আর সন্তানদেরও মুসলমান বানাবেন। আমাকে এ-ও বলেছিলেন, ইসলামের জন্য আপনাকে অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। আমার মনে হচ্ছিল, তিনি যেন সব দেখে আমাকে বলছেন। আমি গিয়ে আমার স্বামীকে সব অবস্থা খুলে বলি, আমি তো আজীবনের জন্য মুসলমান হয়ে গিয়েছি এবং তাকে জোর দিয়ে বলি যে, আপনিও মুসলমান হয়ে যান। তিনি আমাকে অনেক ভালোবাসতেন।

প্রথম প্রথম আমার কথাকে হালকাভাবে নিতেন কিন্তু যখন জোর দেয়া শুরু করলাম তখন বিরোধিতা শুরু করলেন এবং আমাকে ইসলাম থেকে বিরত রাখতে চাইলেন। আমি আমার আল্লাহর কাছে দুআ করতাম। আমি হযরতজীর কাছে ফোন করে জানতে চাইলাম, একজন মুসলমান এবং একজন শিখ কি স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে পারে? হযরত বললেন, সত্যকথা হল, মুসলমান হওয়ার পর আপনার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আর বাকী নেই। আপনাদের বিবাহ ভেঙে গেছে। তবে আপনি সতর্কতার সঙ্গে এই আশায় তার সাথে অবস্থান করুন যে, তিনিও ঈমান কবুল করে নেন এবং সন্তানদের জীবন, ঈমান এবং ভবিষ্যতের সমস্যারও সমাধান হয়ে যায়।
একথা জানার পর তার সঙ্গে থাকতে আমার খুবই সংকোচবোধ হল। প্রতি রাতেই আমাদের মধ্যে ঝগড়া হতো। কখনো এতে অর্ধেক রাতও পার হয়ে যেতো। হযরতজী আমাকে আল্লাহ তাআলার নিকট দু’আ করতে বললেন যে, তাহাজ্জুদ নামায পড়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করো। একবার সারারাত নামায পড়ে এবং কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দিলাম, আয় আমার মাওলা আপনার ভান্ডারে তো কোনো কিছুর কমতি নেই; আপনি আমার স্বামীকে কেন হেদায়াত দিচ্ছেন না। আমার আল্লাহ আমার দুআ শুনলেন। পরবর্তী রাতে আমি যখন তাকে মুসলমান হওয়ার জন্য চাপ দেই তখন সে বিরোধিতা করল না। বলল, রোজ রোজ ঝগড়া করে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। যদি এতেই তুমি সন্তুষ্ট হও তাহলে চল আমিও মুসলমান হয়ে যাই। আমাকে মুসলমান বানাও। আমি বললাম, আমার সন্তুষ্টির জন্য মুসলমান হওয়াকে মুসলমান হওয়া বলে না; বরং সৃষ্টিকর্তা, অন্তর্জামি মালিককে সন্তুষ্ট করার জন্য মুসলমান হতে হয়।

আমি তাকে হযরতজীর লেখা ‘আপকি আমানত আপকি সেবা মে’ বইটি পড়তে দিলাম। আগেও আমি তাকে এটি পড়তে দিয়েছিলাম। তিনি ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু আজ তিনি কিতাবটি গ্রহণ করলেন এবং পড়তে লাগলেন। পুরো কিতাবটি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। তিনি কিতাব পড়ছিলেন আর আমি তার চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ করছিলাম। অবশেষে তিনি ঐ কিতাব থেকেই জোরে জোরে তিনবার কালিমায়ে শাহাদাত পড়লেন। বললেন, এখন এই কালিমা তোমার খুশির জন্য নয়, বরং আমার খুশি এবং আমার প্রতিপালকের খুশির জন্য পড়ছি। আমি অজান্তেই তাকে জড়িয়ে ধরলাম। বলে বোঝাতে পারব না, দুই মাস ঝগড়া-ঝাটি আর কান্নাকাটির পর সেদিনই প্রথম আমার ঘরে খুশির বন্যা বইছিল। পরদিন জানা গেল, ‘রৌপড়’ এলাকায় তার ট্রান্সফার হয়েছে। তিনি সেখানে চলে গেলেন। এক সপ্তাহ পর সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সফর হল। প্রোগ্রামের কাজে তিনি খুবই ব্যস্ত ছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় এক জায়গায় নিরাপত্তা পরিদর্শনে গেলেন। কলেজের বাউন্ডারীর নীচে দাঁড়িয়ে কাজ পরিদর্শন করছিলেন। হঠাৎ প্রবল বেগে বাতাস বইতে লাগল। বাতাসের একটা ঝাপটা এমনই প্রচন্ড ছিল যে, বাউন্ডারীর যে অংশের নীচে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, সোজা তার উপর ভেঙে পড়ল এবং মুহূর্তেই তার ইন্তেকাল হয়ে গেল।
বোন আসমা! বলে বুঝানো সম্ভব নয়, এই দুর্ঘটনা আমার জন্য কত বড় আঘাত ছিল। কিন্তু আমার আল্লাহ আমাকে সাহস যুগিয়েছেন। আমার ঈমানের উপর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েনি। আমার এই অনুভূতি আমাকে স্থির রেখেছিল, তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং জান্নাতে চলে গেছেন। ইনশাআল্লাহ কিছু দিন পরে আমি সেখানে পৌঁছে যাবো। তাঁর শেষকৃত্যের (কাফন-দাফন) ব্যাপারে খুব হাঙ্গামা হয়েছিল। আমি বললাম, কিছুতেই আমি তাকে পোড়াতে দিব না। আমি তার লাশের উত্তরাধিকারী। আইনত সে আমারই অধিকার। কিন্তু পরিবারের লোকজন জেদ ধরেছিল, এ আমাদেরই বংশের সদস্য। ডি.জি.পি, এ.ডি.জি.পি, আই.জি,ডি.আই.জি সবাই উপস্থিত ছিলেন। বহু চেষ্টা প্রচেষ্টার পর সিদ্ধান্ত হল তার সমাধি রচনা করা হবে। অবশেষে তার সমাধি রচনা করা হল। সমাধি রচনার পর আমি এক মাওলানা সাহেবকে ডেকে তার জানাযা পড়িয়ে দেই।

প্রশ্ন : তার পর কী হল?
উত্তর : আমি রৌপড় থেকে জলন্ধর চলে আসি। হযরতজী বলার পর ইদ্দত পূর্ণ করি। আমার এক ভাই লন্ডনে থাকেন। তিনি আমাকে ইংল্যান্ডে চলে যেতে বললেন। আমি পাসপোর্ট বানালাম। ইতোমধ্যে স্বপ্নে একদিন কাবা ঘর দেখি। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে আমি হযরতজীকে বৃত্তান্ত জানালাম। তিনি বললেন, আপনার ওপর সম্ভবত হজ্জ ফরয হয়েছে। আর এজন্য একজন মাহরাম সঙ্গী থাকা জরুরী। কিন্তু আপনার কোনো মাহরাম নেই। এক কাজ করুন, আপনি কাউকে বিয়ে করে নিন। আমি আমার সন্তানদের ভবিষ্যত চিন্তা করে হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও নিজেকে রাজী করতে পারিনি। কিন্তু কেন যেন হজ্জে যাওয়ার জন্য আমি পাগলপারা হয়ে উঠলাম। এজন্য বারবার দিল্লী, ফুলাত সফর করলাম। কিন্তু এজেন্টদের সঙ্গে বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও কোনো উপায় বের হচ্ছিল না। আমি কেবল তড়পাতে লাগলাম। হজ্জ থেকে বঞ্চিত হওয়াও আমার জন্য একটা বিরাট পরীক্ষা ছিল। আমি খুব কাঁদতাম। আমার আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ জানাতাম। আমার মনে হতো, এখনও আমার হজ্জে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কুরবানীর ঈদের তিনদিন পূর্বে মনে পড়ল, হজ্জের মাত্র তিনদিন বাকী আছে। কারণ, আমার জানা ছিল ঈদের দিনই হজ্জ হয়। তাহাজ্জুদ নামাযে কাঁদতে কাঁদতে বেঁহুশ হয়ে গেলাম। আমি আধো ঘুম আধো জাগরণে দেখি, আমার মাথায় ইহরামের স্কার্ফ বাঁধা। আমি মীনার দিকে চলছি। মোটকথা, হজ্জ পূর্ণ করছি। আমার চোখ খুলে গেল। বেঁহুশী উড়ে গেল। বলা সম্ভব নয়, এতে আমি কতটা খুশী হয়েছিলাম। আমি অনেক চেষ্টা করে হযরতজীর মক্কা মুকাররমার ফোন নাম্বার সংগ্রহ করি এবং খুশিতে প্রায় পঁচিশ মিনিট ধরে তাকে হজ্জের বিস্তারিত বিবরণ শোনাই। হযরতজী তো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন।

প্রশ্ন : আব্বু বলেছেন, আপনি গত বছর হজ্জ করছেন। এ বছর তো আমরা হজ্জের মধ্যে আপনাকে বারবার স্মরণ করেছি এবং আফসোস করেছি।
উত্তর : আমার আল্লাহর প্রতি আমি কুরবান হই, তিনি আমার হজ্জের আবদার কবুল করেছেন। প্রথম বছর তো তিনি আমাকে না নিয়েই হজ্জ করিয়েছেন। পরের বছর আমি আমার এক ভাইয়ের ওপর মেহনত করে তাকে বিদেশে সফর করানোর অর্থাৎ, হজ্জ করানোর লোভ দেখিয়ে মুসলমান হওয়ার জন্য জোর দেই। তাকে বলি যে, গুরু নানকজীও হজ্জে গিয়েছিলেন। চেষ্টা ফিকিরের পর সে মুসলমান হয়ে যায়। এভাবে গত বছর আমাদের হজ্জের সৌভাগ্য লাভ হয়।

প্রশ্ন : আরমুগানের মাধ্যমে মুসলমানদের কোনো পয়গাম দিতে চান কি।
উত্তর : আমি আমার বোন আয়েশার (আশা) কথারই পুনরাবৃত্তি করছি, ঈমানের নেয়ামতের মূল্যায়ন করুণ। ঈমানের সঙ্গে এক দিন, ঈমান বিহীন হাজার বছর বেঁচে থাকার চেয়েও শ্রেয়। আর গোটা জগতের প্রতি রহমতস্বরূপ প্রেরিত নবীর উম্মত হওয়ার কারণে গোটা পৃথিবীর মানুষকে দুনিয়ার এই কয়েদখানা থেকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার ফিকির করুন। আমার এবং আমার পরিবারের জন্য দুআ করুন। যেন সবার শেষ নিঃশ্বাস ঈমানের উপর হয়।

সাক্ষাৎকার গ্রহণে
আসমা যাতুল ফাওযাইন
মাসিক আরমুগান, সেপ্টেম্বর ২০০৬

Series Navigation

Archives

March 2024
S S M T W T F
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031