শনিবার, ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
Admin | ১,৩০০ views | ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯ | নির্বাচিত,মনীষীদের জীবনী | No | ১২:২৬ পূর্বাহ্ণ |
মুহাম্মদ মামুনুর রশীদ ।।
সবুজ বাংলাদেশে এমন কতক মহামনীষীর জন্ম হয়েছে যাদের কৃতিত্বপূর্ণ জীবন-কর্ম ও অবদানের কাছে গোটা দেশ ও দেশের মানুষ ঋণী হয়ে আছে। তাদেরই একজন হলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমেদ্বীন, কালজয়ী মহা-পুরুষ আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী রহ.।
তিনি ছিলেন একাধারে একজন তুখোড় মেধাবী ছাত্র, সর্বজনপ্রিয় শিক্ষক, কর্মদক্ষ পরিচালক, বহু ভাষায় বিজ্ঞ প্রথিতযশা সাহিত্যিক, শ্রোতামুগ্ধকারী বক্তা, প্রতিভাবান লেখক-অনুবাদক, সচেতন সংগঠক, ভালো পুরাতন ও উপকারি নতুনের মাঝে সমন্বয়কারী, চিত্তে-বিত্তে দরিয়া-উদার দানশীল, শরীয়তশোভন সংস্কারে দৃঢ় বিশ্বাসী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, শাহী পোশাকে আবৃত বুজর্গ-কলব ব্যক্তিত্ব।
আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী রহ. ছিলেন আমাদের ইতিহাসের এক আলোকোজ্জ্বল প্রদীপ। এদেশে যারা ইসলামের খেদমত করে নিজেদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখতে সক্ষম হয়েছেন, তিনি তাদের মাঝে অন্যতম।
ক্ষণজন্ম এই মহা-পুরুষ ১৯৩৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর শরতের স্নিগ্ধ সকালে চট্টগ্রামস্থ পটিয়া থানার আশিয়া ইউনিয়নের মির্জাপাড়া গ্রামে এক ধার্মিক ও অভিজাত পরিবারে জন্ম লাভ করেন। তার পিতামহ মাওলানা গোলাম মোস্তফা রহ. ছিলেন একজন প্রতিথযশা আলেম ও বুযর্গ। তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম ইসলামী ব্যক্তিত্ব, যিনি কলকাতা আলিয়ার স্বর্ণপদক অর্জন করেন। পিতা ইসমাঈল সাহেব রহ. ছিলেন একজন বিজ্ঞ আলেম ও মুফতি। মাতা উম্মে হাবিবা ছিলেন ধর্মানুরাগী রমনী।
পরিবারের বড়দের কাছে কোরআন শরীফ বিশুদ্ধরূপে পড়া শেষ হলে পিতা ইসমাঈল সাহেব তাকে ভাটিখাইন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। এখানে ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যায়নের পর ১৩৬৭ হিজরিতে পাড়াস্থ দ্বীনী দরসগাহ এমদাদুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সাথে দাহুম পর্যন্ত পড়ালেখা চালিয়ে যান। এরপর নাজিরহাট নাসিরুল উলুম মাদরাসায় তিন বছর অধ্যায়ন শেষ করে বড় ভাই ইসহাক গাজী সাহেবের তত্বাবধানে পটিয়া জমীরিয়া কাছেমুল উলুম মাদরাসায় জামাতে নাহুমে ভর্তি হন।
নিরবচ্ছিন্ন অধ্যাবসায় ও জ্ঞান সাধনার কারণে ছাত্রজীবনেও উস্তাদকূল ও সহপাঠীদের প্রিয় পাত্র ছিলেন তিনি। পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করা যেন তার নিত্তনৈমিত্তিক রীতিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
১৯৬০ সালে পটিয়া মাদরাসায় দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে আরো উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি জামিয়াতুল আযহারে গমণের লক্ষে তৎকালীন পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী জনাব হাবিবুর রহমানের মাধ্যমে সব ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করেন। ঠিক তখনই মুরব্বিদের পক্ষ থেকে আপত্তি আসে। তুমি মিশরে যেও না। ব্যাস, সাথে সাথেই গৃহিত সিদ্ধান্ত পত্যাহার করলেন। আনুগত্যের এই অতুলনীয় দৃষ্টান্তের কারণেই হয়তো তিনি এত বড় হয়েছিলেন।
এরপর ১৯৬১ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ গিয়ে পুনরায় দাওরায়ে হাদীসে ভর্তি হন। কিন্তু বিশেষ কারণে সেখান থেকে আবার লাহোরে জামিয়া আশরাফিয়ায় গিয়ে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। তারপর ১৯৬২ সালে লাহোরে জামিয়া মাদানিয়ায় দু’জন দার্শনিক উস্তাদের কাছে ফুনূনাতে আলিয়ার (উচ্চতার ইসলামী শিক্ষা) ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬৩ সালে পাকিস্তান থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর মাসিক মদীনার সম্পাদক বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও ভাষাবিদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবের সান্নিধ্যে মাতৃভাষায় লেখালেখিতে দক্ষতা অর্জন করেন।
১৯৬৩ সনে দেশে ফেরার পর তদান্তিন পূর্ব পাকিস্তান হতে প্রকাশিত একমাত্র উর্দূ পত্রিকা দৈনিক পাসবান-এর বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর হিতাখাঙ্খিদের পরামর্শে ঢাকার ফরিদাবাদে ‘এদারাতুল মাআরিফ’ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। এটি ছিল একটি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট। ভাষা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও বিষয়ভিত্তিক গবেষণার উপর মাদরাসা পড়ুয়া ছাত্রদের দক্ষতা অর্জনই ছিল উক্ত ইনস্টিটিউটের লক্ষ ও উদ্দেশ্য। যাতে দেশের প্রত্যত্ত অঞ্চলে দ্বীনের পয়গাম পৌঁছানো যায় এবং দ্বীনের কান্ডারী আলেম সমাজ সর্বপ্রকার বাতিলের মোকাবেলা করতে পারদর্শি হয়ে উঠে।
১৯৭২ সালে ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে আসেন তিনি। অতপর বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষক নিযুক্ত হন। পাশাপাশি হযরত হাজি সাহেব হুযুরের নির্দেশক্রমে পটিয়া মাদরাসার মুখপত্র মাসিক আত-তাওহীদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৭৫ সালে ১৯ ডিসেম্বরে বহু ভাষায় মুগ্ধকর দক্ষতার কারণে আবুদাবীস্থ বাংলাদেশের দূতাবাসে আরবী-ইংরেজী-বাংলা অনুবাদকের সহকারীর দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭৭ সালের ১লা মার্চ সুপ্রিম শরীয়া কোর্ট আবুধাবীর অনুবাদক পদে নিয়োজিত হন। ১৯৮৫ সালে আবুদাবীর বেতারে ইসলাম ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রযোজক ও উপস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে অনুবাদ বিভাগীয় প্রধান পদে উন্নীত হন। আবুধাবীতে কিছুকাল তিনি বিচারকের সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯০ সালে রাবতায়ে আলম আল ইসলামির পক্ষ থেকে তাকে বাংলাদেশ শাখার পরিচালক পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
পটিয়া মাদরাসায় তার গুন-জ্ঞান, কর্মদক্ষতা, দীনদরদ, মুসলিম জাগরণের আন্তরিক অনুভুতি ও কালজয়ী যোগ্যতার সমাহার দেখে হাজী ইউনুস সাহেব হুজুর রহ.-এর অন্তরে নিজের পরবর্তি স্থলাভিষিক্ত করার ইচ্ছা জেগে উঠে। তাই তাকে জামিয়ার উপ-পরিচালক পদে নিয়োগ দেন। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ ইংরেজী দিবাগত রাতে হযরত হাজী সাহেব হুজুর রহ. ইহকাল ত্যাগ করলে জামিয়ার মজলিশে শুরার সকল সদস্যের সম্মতিক্রমে তার কাঁধে অর্পিত হয় পটিয়া জামিয়ার মহাপরিচালকের গুরুদায়িত্ব।
তার যোগ্যতা, দক্ষতা, সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা, তাকওয়া ও ইখলাছের বদৌলতে তিনি জামিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যান সফলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে। জামিয়ার সুষ্ঠু পরিচালনার পাশাপাশি তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে আলেম সমাজের জাতীয় নেতৃত্বের ময়দানে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
কওমী মাদরাসা সমূহের প্রধান বোর্ড ও সংগঠন বেফাকুল মাদারিসের চেয়ারম্যান হিসেবে সারা দেশের কওমী মাদরাসাসমূহের অভিভাবক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন কয়েক বছর।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে দেশের শীর্ষ আলেমদের নিয়ে ‘সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ’ গঠন করে ইসলামি অঙ্গনে একটি সর্বব্যপি কার্যকর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠান নির্মাণে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে ঢাকায় বেশ কয়েকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মসজিদ, মাদরাসা, নলকূপ ও বাসস্থান ইত্যাদি নির্মাণ করতেন ব্যাক্তিগতভাবে এবং বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে। সাথে সাথে অনেক অসহায় গরিব পরিবারের খরচ, বিধবা ভাতা, দরিদ্র ছাত্রদের পড়ালেখার খরচ ইত্যাদি চালিয়ে যেতেন তিনি। ১৯৮৮ সালে বন্যাকবলিত দূর্গত এলাকায় গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করেন।
একটি সূত্র জানায়, পটিয়া মাদরাসার মোহতামিমের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে জামিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগি করার পদক্ষেপ নেন। এটা বাস্তবায়নের জন্য আল্লামা মুফতি আবদুল হালীম বুখারী দা.বা., মুফতি শামসুদ্দীন জিয়া ও মাওলানা রহমাতুল্লাহ কাউছার নেজামীকে নিয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল ভারত-পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাব্যবস্থাকে সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করতে পাঠান। তারা ফিরে এসে একটা রিপোর্ট পেশ করেন। সে অনুযায়ী জামিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করেন তিনি।
ফিকাহর জটিল মাসআলা ও যুগের নতুন সম্যাবলীর সমাধান করার জন্য বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামগণনকে নিয়ে ১৯৯২ সালে ইসলামী গবেষণা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া জামিয়ার কেন্দ্রীয় তোরণ নির্মাণ, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের জমি লীজ নেওয়া, নওমুসলিম পাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইসলামী কিন্ডার গার্ডেন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে ধর্মীয় ও সামাজিক খিদমাত আঞ্জাম দেন তিনি।
এত কিছুর পরও তিনি পরিবারের প্রতি পূর্ণ মনোযোগী ছিলেন। হুজুরের মেঝো ছেলে আইইউটির শিক্ষক ড. শাহেদ হারুন আযহারী ইসলাম টাইমসকে বলেন, আব্বা সবসময় আমাদের ব্যাপারে খুব সতর্ক মনোযোগ রাখতেন। প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। লেখাপড়ার খোঁজখবর নিতেন। আমাদের চাল-চলন, চলা-ফেরা, উঠা-বসা সবকিছুতেই লক্ষ রাখতেন। আমাদের জীবন যেন দ্বীনের পথে পরিচালিত হয় এ নিয়ে তার চেষ্টা ও মনোযোগের কথাগুলো খুব মনে পড়ে।
ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান। পটিয়ার মাকবারায়ে আযীযীতে হযরত হাজী সাহেব হুযুরের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। #