রবিবার, ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

যে পরিমাণ মসজিদ-মাদরাসা বেড়েছে সে পরিমাণ দ্বীনি দাওয়াতের প্রসার হয়নি


মুফতি যুবায়ের আহমদ। একজন আলেম ও দাঈ। দ্বীনি দাওয়াতের ক্ষেত্রে যে ক’জন নিবিষ্টচিত্ত আলেম রয়েছেন তিনি তাদের অন্যতম। বিশেষত তিনি অমুসলিমদের মাঝে দ্বীনি দাওয়াত পৌঁছে দিতে বিশেষভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে ইসলামি দাওয়াত ও তাবলিগের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে অনুলিখন করেছেন আবরার আবদুল্লাহ।

Default Ad Content Here

অনেকেই প্রশ্ন করেন, সমাজে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান বাড়ছে; মসজিদ বাড়ছে, মাদরাসা বাড়ছে এবং মাদরাসায়পড়ুয়াদের সংখ্যা বাড়ছে। তাহলে দ্বীনি দাওয়াতের প্রয়োজন বাড়ছে না কমছে? আমি বলবো, বাড়ছে। কারণ, সমাজে যে হারে মানুষকে দ্বীনবিমুখ করার আয়োজন হচ্ছে সে পরিমাণে কিন্তু মসজিদ, মাদরাসা ও আলেম বাড়ছে না। দ্বিতীয়ত মসজিদ, মাদরাসা ও আলেমদের সংখ্যা বাড়ায় মুসলিমদের মধ্যে দ্বীনি কার্যক্রম বেড়েছে। অমুসলিমদের মধ্যে দাওয়াতি কাজের প্রসার ঘটেনি। তারা মসজিদ-মাদরাসায় আসে না। অথচ তাদের পর্যন্ত দ্বীন পৌঁছানো আমাদের দায়িত্ব।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, অমুসলিমদের কাছেও তো দাওয়াত পৌঁছে গেছে; ইন্টারনেটের মাধ্যমে, বই-পুস্তকের মাধ্যমে, ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে। তাহলে তাদের আমরা দাওয়াত দেবো কেন? না, তাদেরও দাওয়াত দিতে হবে। যেমন, আপনার কোনো প্রতিবেশীর বাড়িতে যখন বিয়ে হয়, তখন স্বভাবতই আপনি সংবাদ পেয়ে যান। কিন্তু আলাদা দাওয়াত ছাড়া সেখানে অংশগ্রহণ করেন না। অমুসলিমদেরও পৃথকভাবে দাওয়াত না দিলে তারা আসবে না এবং আসছেও না।

সমাজের অনেক মানুষ মনে করেন, দ্বীনি দাওয়াতের কাজ আলেম-উলামার দায়িত্ব। অথবা যারা করছে শুধু তারা করলেই হবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সুরা আলে ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে দাওয়াতের কাজ সম্পর্কে বলেছেন, (অর্থ) ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদের বের করা হয়েছে মানুষের জন্য। তোমরা মানুষকে সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে।’

এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সাধারণভাবে সব মুসলিমের উপর দাওয়াতের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। দাওয়াত মুসলিম জীবনের মৌলিক কাজ। তবে হ্যাঁ, কাজের ক্ষেত্র ভাগ হতে পারে। যেমন, উলামায়ে কেরামের কাছে মুসলিমদের যাতায়াত বেশি তাই মুসলিমদের মধ্যে কাজ করা তাদের জন্য সহজ। অন্যদিকে তরুণ ও যুবক মুসলিম–যারা স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে পড়েন-তাদের জন্য অমুসলিমদের মধ্যে কাজ করা সহজ। কারণ অমুসলিমদের সঙ্গে তাদের উঠ-বস বেশি হয়।

দাওয়াতি কাজের ক্ষেত্রে আমি অমুসলিমদের মধ্যে দ্বীনি দাওয়াতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিই। কারণ, বর্তমান সমাজে দ্বীনি কাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে যে পরিমাণ লোক পাওয়া যায় (আল হামদুলিল্লাহ) অমুসলিমদের মধ্যে দ্বীনি দাওয়াতের জন্য সে পরিমাণ লোক পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে তরুণরা, বিশেষ করে তরুণ আলেমরা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

তরুণ বয়সে যে স্পৃহা ও উদ্যম মানুষের মধ্যে কাজ করে তা বার্ধক্যে থাকে না। তরুণ আলেমরা যদি নিয়ত করে আমরা যুগের খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতি রহ. হবো, শাহ জালাল ইয়ামেনি রহ. হবো তাহলে সমাজের চিত্র পাল্টে যাবে।

দ্বীনের দাওয়াতে যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে
ধরুন, কোনো তরুণ যদি এভাবে পরিকল্পনা করে- পৃথিবীর বুকে অমুক দেশে দ্বীনের দাওয়াত নেই। সুতরাং আমি সেখানে যাবো এবং আমার জীবন সেখানে কাটিয়ে দেবো। সেখানে আমি ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেবো। তাহলে ভাবুন, কতো মানুষ ইসলামের আলো পাবে! কুরআনেও এমন একটি দলের কথা বলা হয়েছে যারা মানুষকে কল্যাণের পথে আহবান করবে। সেটার সর্বোত্তম ব্যক্তি হতে পারে যুবক মুসলিম ও তরুণ আলেমরা।

হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, কালেমা পাঠ করলে মানুষ কোনো এক দিন জান্নাতে প্রবেশ করবে। সুতরাং মানুষকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন। রাসুল সা.-এর জীবনী ও হাদিসের বিবরণ থেকে বোঝা যায় অমুসলিমদের জন্য রাসুলের ব্যথা ও দরদ অনেক বেশি। কুরআনে রাসুলে আকরাম সা.-এর বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা হয়েছে (অর্থ) ‘কেন তারা ঈমান আনছে না এজন্য আফসোস করে আপনি আপনার জীবন ধ্বংস করে দেবেন না।’

অভিজ্ঞতা বলছে, সমাজের লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত শ্রেণির মানুষই ইসলামের মাহাত্ম্য সহজে বোঝে এবং ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করে। দাওয়াতের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

আর যদি আমরা দাওয়াতের কাজ না করি তাহলে কী হবে? দাওয়াতের কাজ না করলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের শাস্তি দেবেন। আল্লাহ পৃথিবীর বুকে আমাদের লাঞ্ছিত করবেন। আল্লাহ তায়ালা সুরা মুনাফিকুনের ৮ নং আয়াতে বলেছেন, (অর্থ) ‘সম্মান আল্লাহ, তার রাসুল ও মুমিনের জন্য।’

লাঞ্ছনা সম্পর্কে সুরা বাকারার ৬১ নং আয়াতে বনি ইসরাইল সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে লাঞ্ছনা, অপমান ও দারিদ্র্য।’

আজ পৃথিবীতে মুসলমানের অবস্থা দেখলে সহজেই বুঝবো মুসলমান লাঞ্ছিত। এটা আল্লাহর এক প্রকার শাস্তি। পূর্ববর্তী উম্মতকে আল্লাহ এ শাস্তি দিয়েছেন। অতীত উম্মতদের শাস্তি প্রদানের পেছনে ৩টি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। যা আমাদের মধ্যেও বিদ্যমান। তা হলো:

  • ১. অন্যায় কাজে বাধা না দেয়। সুরা মায়েদার ৭৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, (অর্থ) ‘তারা অন্যায় কাজে বাধা দিতো না।’ আমরাও অন্যায় কাজ দেখে চুপ থাকি।
  • ২. তারা সত্য গোপন করতো। আল্লাহর নাজিলকৃত সত্য তারা গোপন করে রাখতো। অর্থাৎ মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। আমরাও কুরআন ও হাদিসের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছি না। যেমন, মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে অমুসলিমদের ধারণা তিনি মুসলমানের নবী। আমরাও বলি তিনি আমাদের নবী। আর কুরআন বলে তিনি সবার নবী।
  • ৩. আল্লাহ প্রদত্ত বিধিবিধান পালনে উদাসীন হওয়া। এটাও আমাদের মধ্যে খুব প্রবলভাবে রয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে তিন ধরনের শাস্তির কথা বলেছেন। তাহলো, আসমানি শাস্তি, জমিনের শাস্তি এবং পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। এ তিনটি শাস্তির মধ্যে আমাদের জন্য রয়েছে ১টি। মুসনাদের আহমদের হাদিস থেকে বোঝা যায়, আল্লাহর রাসুলের দোয়ার কারণে আসমানি ও জমিনি শাস্তি রহিত করা হয়েছে। কিন্তু পারস্পরিক বিবাদের শাস্তি রহিত হয়নি। সমাজে তাকালে দেখি পারস্পরিক কলহ-ঝগড়া প্রকট হচ্ছে।

আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারার ১৬০ নং আয়াতে শাস্তি থেকে বাঁচার উপায়ও বলে দিয়েছেন। তাহলো, তওবা করা, সংশোধন হওয়া ও সত্যের প্রচার করা।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের দ্বীনি দাওয়াতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার তাওফিক দিন এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচার যে উপায়গুলো বলেছেন তা অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Archives

December 2024
S S M T W T F
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031