শুক্রবার, ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

শয়তান উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনার পথ দেখায় – তারাবীহ ষষ্ঠ পাঠ

This entry is part 6 of 27 in the series দরসে তারাবীহ

 

Default Ad Content Here

আজ ষষ্ঠ তারাবিতে সূরা আরাফের ১২-২০৬ এবং সূরা আনফালের ১-৪০ আয়াত পর্যন্ত পড়া হবে। পারা হিসেবে আজ পড়া হবে অষ্টম পারার শেষার্ধ এবং নবম পারা।

৭. সূরা আরাফ: (মক্কায় অবতীর্ণ, আয়াত দুইশত ছয়, রুকু চব্বিশ) অন্যান্য মক্কি সূরার মতো এ সূরাটিতেও তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাত- আকিদার এ তিনটি মৌলিক বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে। সূরাটির প্রথম পর্বে নবী করিম (সা.) এর চিরন্তন মোজেজা আল কোরআনের আলোচনা রয়েছে। এরপর আদম-হাওয়া সৃষ্টির আদি ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচার নির্দেশ দিয়েছেন। আদমকে সিজদার নির্দেশ অমান্য করে ইবলিস মানুষের সঙ্গে শত্রুতার যে ধারা চালু করেছিল কেয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। ঈমানদার ব্যক্তিরাও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আদেশ পালনের মাধ্যমে শয়তানকে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করে যাবে।

সূরা আরাফের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এ সূরায় আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে চার-চারবার ‘হে আদম সন্তান!’ বলে সম্বোধন করেছেন। এর মধ্যে প্রথম তিনটি সম্বোধনের পর পরিধেয় বস্ত্র সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এ থেকে পরিধেয় বস্ত্রের গুরুত্ব অনুমেয়। ইবলিসের একটা বড় টার্গেট হলো, আদম সন্তানকে লজ্জা-শরমের পথ থেকে বঞ্চিত করে উলঙ্গপনা ও বেহায়াপনায় লিপ্ত করা।

এছাড়াও সূরা আরাফের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হল: মোশরেকরা বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করত উলঙ্গ হয়ে। তারা তাদের এ ধরনের নিকৃষ্ট কাজের দলিল দিতে গিয়ে বলত, আমাদের বাপ-দাদাদেরও আমরা এমন করতে দেখেছি, অথচ ‘আল্লাহ কখনও বেহায়াপনার নির্দেশ দেন না।’ (২৮-৩৩)।

জান্নাতী ও জাহান্নামিদের বিশেষ কথোপকথনের একটি প্রসঙ্গ সূরায় রয়েছে। আছে তৃতীয় আরেকটি দলের বিবরণও, তারা হলো ‘আরাফবাসী’। এরা মূলত মোমিন; কিন্তু তাদের ভাল কাজ ও মন্দ কাজের পাল্লা সমান হওয়ায় তারা অন্যান্য জান্নাতির চেয়ে পিছিয়ে থাকবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তবে একটু বিলম্বে। (৩৮-৫১)।

আল্লাহর অসীম কুদরত ও একত্ববাদের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হলো স্তরে স্তরে সাজানো খুঁটিবিহীন আকাশ, চাঁদ, তারা, সূর্য। (৫৪)।

এই দলিলগুলো বর্ণনার পর ছয়জন নবী ও তাদের জাতির আলোচনা সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা হলেন- নুহ, হুদ, সালেহ, লুত, শুআইব ও মুসা আলাইহিমুস সালাম। (৫৯-১৭১)। বিভিন্ন নবী-রাসুলের কাহিনি বর্ণনা প্রসঙ্গে বহু শিক্ষা ও নসীহতের কথাও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, অবিশ্বাসী লোকদের আল্লাহ তায়ালা দীর্ঘ সুযোগ দেন, এরপর একসময় হঠাৎ করেই ধরে বসেন। (৯৭-১০০)। নবীদের এসব ঘটনা-কাহিনি শুনিয়ে নবীজিকে এবং তাঁর উম্মতকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে। (১০১)।

যে ছয় নবীর কাহিনি সূরা আরাফে আলোচিত হয়েছে তাদের মধ্যে মুসা (আ.) এর কাহিনিটি সবচেয়ে বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে। মুসা নবীকে প্রদত্ত মোজেজাগুলোও ছিল সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট। বিশেষ করে লাঠি ও শুভ্র হাতের মোজেজা দুটি। এগুলোকে ফেরাউন ও তার লোকরা জাদু মনে করত। মুসার মোকাবিলার জন্য জাদুকররা এসেছিল সাপ নিয়ে। মুসা (আ.) এর হাতের লাঠিটি সাপ হয়ে সেগুলোকে গিলে ফেলে। এতে জাদুকররা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ঈমান আনে। ফেরাউন ঈমানের ‘অপরাধে’ এদের শূলে চড়ায়। (১০৪-১৩৬)।

ফেরাউন ও তার জাতি বনি ইসরাইলকে দাস বানিয়ে রেখেছিল। মুসা নবী তাদেরকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন। (১২৭-১২৯, ১৩৭-১৪১)। মুসা (আ.) এর দাওয়াতের প্রত্যুত্তরে ফেরাউন ও তার জাতি অহংকারের পথ বেছে নিয়েছিল। এক পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে শাস্তিতে নিপতিত করেন। তুফান, দুর্ভিক্ষ, ফল-ফসলে ঘাটতি, পঙ্গপাল, উকুন ও ব্যঙ্গের উপদ্রব এবং যাবতীয় পানিকে রক্তে পরিণত করে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেন। আজাব দেখলে এরা তওবা করত; কিন্তু আবার হঠকারী হয়ে যেত। (১৩০-১৩৬)।

বনি ইসরাইল ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা তাদের নবী মুসা (আ.) এর ওপর তাওরাত কিতাব নাজিল করেন। কিন্তু মুসা (আ.) তাওরাত আনতে তুর পাহাড়ে গেলে সামেরি এদের গো-পূজায় লিপ্ত করে। তাছাড়া তাদের শনিবারে মাছ ধরতে নিষেধ করা হলেও তারা হিলা বাহানা করে মাছ ধরত। এ কারণেও তারা শাস্তি পেয়েছিল। (১৪২-১৭১)।

রুহের জগতে সব মানুষ থেকে আল্লাহ তায়ালার বিধান পালনের ওয়াদা নেওয়া হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আলোচনা রয়েছে সূরার ২১তম রুকুতে।

এরপর সূরার শেষ পর্যন্ত যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে, সংক্ষেপে তা হলঃ ১. বালআম বিন বাওরার ঘটনা, তাকে ইলম দ্বারা সম্মানিত করা হয়েছিল; কিন্তু এ বদবখত আল্লাহ প্রদত্ত ইলমকে দুনিয়ার দু-পয়সার বিনিময়ে লুটিয়ে দেয়। (১৭৫-১৭৬)। ২. কাফেররা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, কেননা তারা তাদের অন্তর, চোখ ও কান কোন কাজে লাগায় না। ফলে তারা ঈমান থেকে বঞ্চিতই থেকে যায়। (১৭৯ ও ১৯৪-১৯৫)। ৩. আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের এ দুনিয়ায় ছাড় দিতে থাকেন, এমনকি একটা সময় এমন চলে আসে, যখন তাদের হঠাৎ ধরে বসেন। (১৮২)। ৪. কেয়ামতের নির্দিষ্ট জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া কারও কাছেই নেই। (১৮৭)। ৫. আল্লাহ তায়ালা নবীজিকে সৎচরিত্র অবলম্বনের নির্দেশ প্রদান করেছেন। (১৯৯)।

সূরা আরাফের সূচনা হয়েছিল কোরআনের আলোচনা দিয়ে, শেষও হয়েছে কোরআনের আজমত, বড়ত্ব এবং আদব ও সম্মানের আলোচনার মাধ্যমে। (২০৪)।

৮. সূরা আনফাল: (মদিনায় অবতীর্ণ, আয়াত ৭৫, রুকু ১০) অন্যান্য মাদানি সূরার মতো এ সূরাটিতেও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে শরিয়তের বিধিবিধান সংক্রান্ত আলোচনা। বিশেষ করে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর প্রসঙ্গটি এখানে মুখ্য। প্রথম আয়াতে গনিমতের সম্পদ বণ্টননীতি প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে। ঈমানদার ব্যক্তির কিছু বৈশিষ্ট্যের আলোচনার (২-৪) পর পরবর্তী আয়াতগুলোয় বদর যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। (৫-২৮)।

তৃতীয় রুকুতে নবীজির বিরুদ্ধে কাফেরদের ষড়যন্ত্র ও ঈমানের পথে বাধাদানের বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আল্লাহই তাদের চক্রান্তের সমুচিত জবাব দেন। আর তাদের ঠিকানা জাহান্নাম। আল্লাহর দ্বীনকে বুলন্দ করার জন্য কিতাল ও জিহাদের নির্দেশনার মাধ্যমে নবম পারা সমাপ্ত হয়েছে। (৩৯-৪০)।

লেখক:মাওলানা রাশেদুর রহমান ।। পেশ ইমাম ও খতীব, কেন্দ্রীয় মসজিদ, বুয়েট

Series Navigation<< জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্য – তারাবীহ ৫ম পাঠনুসরত, হিজরত ও জিহাদ – তারাবীহ ৭ম পাঠ >>

Archives

December 2024
S S M T W T F
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031