শনিবার, ৪ঠা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ই রজব, ১৪৪৬ হিজরি
Admin | ১,০৪০ views | এপ্রিল ৩০, ২০২০ | দরসে তারাবীহ,নির্বাচিত,Quran | No | ৭:৫৬ অপরাহ্ণ |
আজ সপ্তম তারাবিতে সূরা আনফাল (৪১-৭৫) এবং সূরা তওবা (১-৯৩) পড়া হবে। পারা হিসেবে আজ পড়া হবে দশম পারা।
Default Ad Content Here
৮. সূরা আনফাল: (৪১-৭৫) দশম পারার শুরুতে গনিমতের সম্পদ বণ্টননীতি প্রসঙ্গে আলোচনার পর বদর যুদ্ধের আলোচনা করা হয়েছে। বদর যুদ্ধের কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বদর যুদ্ধে শয়তানের ভূমিকা এবং কাফেরদেরকে ফেরেশতাদের পিটুনি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। জিহাদের জন্য আত্মিক বল ও রুহানি শক্তি অর্জনের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহর সাহায্য লাভের জন্য যুদ্ধের ময়দানে অটল অবস্থান, বেশি বেশি আল্লাহর জিকির, আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য, মতভেদ ও অহংকার পরিহার এবং ধৈর্যধারণের আদেশ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় জীবনে উত্থান-পতনের মূলনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। বদর যুদ্ধের বন্দি সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। আনসার, মুহাজির এবং মুজাহিদদের পুরস্কার ও মর্যাদার আলোচনা করে সূরাটির সমাপ্তি ঘটেছে।
এ সূরার সূচনা হয়েছিল জিহাদ ও গনিমতের আলোচনা দিয়ে, আর সমাপ্তও হয়েছে হিজরত ও জিহাদের আলোচনার মাধ্যমে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সূরাটিতে জিহাদের আলোচনাই ছিল প্রধান বিষয়। (৪১-৭৫)।
৯. সূরা তওবা: (মদিনায় অবতীর্ণ, আয়াত ১২৯, রুকু ১৬) আলোচ্য সূরার প্রথম শব্দটি হলো ‘বারাআত’, অর্থ নিঃসম্পর্ক হওয়া। সূরাটি নবম হিজরির ওই সময় অবতীর্ণ হয়েছে, যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোমানদেরকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিলেন। এই অভিযানটি ইতিহাসের পাতায় গাজওয়া তাবুক নামে পরিচিত।
সূরা তওবায় মৌলিকভাবে দুটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে : ১. মোশরেক ও আহলে কিতাবদের বিরুদ্ধে জিহাদের বিধানাবলী বর্ণনা এবং ২. গাজওয়া তাবুকের প্রেক্ষাপটে মোনাফেকদের মুখোশ উন্মোচন।
জিহাদের বিধান বর্ণনার আগে ভূমিকাস্বরূপ বিশেষ কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, অমুসলিমদের সঙ্গে মুসলমানদের সব সম্পর্ক ও চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। মোশরেকদের কাবা শরিফ ঘিরে হজ-ওমরা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ তারা অপবিত্র, কয়েকবার তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে, ইসলামের অব্যাহত অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য ইহুদিদের সঙ্গে তারা জোট করেছিল। মুসলমানদের কাছে আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রাসুল ও জিহাদের চেয়ে কোনো কিছু যেন বেশি প্রিয় না হয়- এ ব্যাপারে খুব তাগিদ প্রদান করা হয়েছে।
মোশরেকদের থেকে সম্পর্কোচ্ছেদের পাশাপাশি আহলে কিতাব তথা ইহুদি খ্রিষ্টানদের কূটচক্রান্ত, ধোঁকা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, কপটতা, মিথ্যাসহ তাদের যাবতীয় মন্দ দোষের ব্যাপারে মুসলমানদের সতর্ক করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘লড়াই করো ওদের বিরুদ্ধে, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না, শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে না, হারামকে হারাম মনে করে না এবং সত্য ধর্মের অনুসরণ করে না; তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাও, যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে নিজ হাতে জিজিয়া প্রদান করে।’ (২৯-৪৯)।
সূরাটির অন্যতম একটি বিষয় হলো, মোনাফেকদের মুখোশ উন্মোচন করে দেওয়া। সে হিসেবে এ সূরার আরেকটি নাম ‘সূরাতুল ফাজিহাহ’ তথা লাঞ্ছনাকারী সূরা। এ সূরা নাজিল হওয়ার আগে মোনাফেকরা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করত; কিন্তু আড়ালে কুফর গোপন রাখত। যাদের মনে কুফর আছে তাদের গোপন অবস্থা এ সূরা এমনভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে যে, কারও আর অজানা থাকেনি, কে মোনাফেক আর কে মুখলিস মোমিন। তাবুক যুদ্ধে মোনাফেকদের দুর্বলতা ও গোপন দোষগুলো সবার সামনে প্রকাশ পেয়ে যায়।
স্বভাবতই জিহাদ প্রাণের ঝুঁকিসংকুল ইবাদত। গাজওয়া তাবুক ছিল বস্তুগত বিচারে সময়ের সবচেয়ে বড় শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলা, তা-ও আবার প্রচণ্ড গরম ও অভাব-দারিদ্র্যের দিনে। এ গাজওয়ার প্রেক্ষাপটে মোনাফেকদের আসল চেহারা প্রকাশ পেয়ে যায়। সে সময় মোনাফেকদের যে আচরণ প্রকাশ পেয়েছিল, তা সব যুগের, সব মোনাফেকের চিত্র। আমি খাঁটি মুসলমান কি না যাচাইয়ের পথ হলো, আমার মধ্যে মোনাফেকদের এ দোষগুলো নেই তো!
গাজওয়া তাবুকের প্রেক্ষাপটে মোনাফেকদের যে দোষগুলো প্রকাশ পেয়েছিল, সেগুলো হলো- মিথ্যা অজুহাত পেশ করা (৪২), হিলা-বাহনা (৪৪-৪৬), হাস্যকর বিভিন্ন আপত্তি ও ওযরের কথা বলে নিজেদের জন্য জিহাদে না যাওয়ার অনুমতি আদায় (৪৯), মুসলিম সমাজে অনিষ্ট ছড়ানো (৪৭), মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা ও বিদ্বেষ, মুসলমানদের বিপদে আনন্দ প্রকাশ (৫০), মিথ্যা শপথ (৫৬), সম্পদ পেলে আনন্দ, না পেলে ক্ষোভ (৫৮), আল্লাহর মহব্বত, আল্লাহর জিকির ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ শূন্য অন্তর (৫৯), নবীজিকে গালমন্দ করা (৬১), একে অপরকে মন্দকাজের আদেশ দেওয়া, ভালো কাজ থেকে নিষেধ করা, কৃপণতা (৬৭)। এসব ছিল মোনাফেকদের প্রকাশ্য দোষগুলোর অন্যতম। মূলত মোনাফেকদের এসব দোষ আর কার্যকলাপ পূর্বেকার কাফেরদের চরিত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে। (৬৯)।
কাফেরদের সঙ্গে মোনাফেকদের সাদৃশ্যের কথা বলতে গিয়ে কওমে নুহ, আদ, সামুদ, কওমে ইবরাহিম, আসহাবে মাদয়ান ও কওমে লুতের কথা বলা হয়েছে। তাদের পরিণাম জানা সত্ত্বেও এরূপ আচরণ সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
দশম পারার শেষ পর্যন্ত মোনাফেকদের আলোচনাই রয়েছে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা এ ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন, ‘হে আমার রাসুল, যদি আপনি তাদের জন্য সত্তরবারও ইস্তেগফার করেন; তবু আল্লাহ কিছুতেই তাদের মাফ করবেন না।’ এ কথাও বলেছেন যে, ‘যদি তাদের কারও মৃত্যু হয় তাহলে আপনি তার জানাজার নামাজ পড়াবেন না।’ (৮০-৮৪)।
দশম পারার শেষে আল্লাহ তায়ালা ওই একনিষ্ঠ মুসলমানদের কথাও আলোচনা করেছেন, যারা বার্ধক্য, প্রচণ্ড অসুস্থতা বা সরঞ্জাম না পাওয়ার কারণে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারেনি ঠিক; কিন্তু তাদের আগ্রহ এত বেশি ছিল যে, জিহাদে অংশগ্রহণ করতে না পারার দুঃখে তাদের চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল। এ কারণেই বলা হয়েছে, এ একনিষ্ঠ মাজুর মুসলমানদের জিহাদে অংশ না নেওয়ায় কোনো গোনাহ হবে না। (৯১-৯২)।
লেখক:মাওলানা রাশেদুর রহমান ।। পেশ ইমাম ও খতীব, কেন্দ্রীয় মসজিদ, বুয়েট