বুধবার, ৯ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ই মহর্রম, ১৪৪৬ হিজরি
অতি উৎসাহ আর অপরিণামদর্শী আবেগ নির্ভর বক্তব্যে একটি ঘটনার মোটিভ ও গতিপথ পাল্টে যেতে পারে। যেমনটি হয়েছে গত ১১ অক্টোবর শুক্রবার উত্তরা ১৩ নং সেক্টর গাউসুল আজম মসজিদে সংঘটিত একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। অনেকেই প্রকৃত বিষয়টি না জেনে আবেগ এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন, যেগুলো বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।
বিষয়টির সূত্রপাত কিছুদিন আগে মসজিদ সভাপতি কর্তৃক সূরাতুল বাকারার ৬২ নাম্বার আয়াতের জঘন্য অপব্যাখ্যা করে দেয়া একটি ভিডিও বক্তব্যকে কেন্দ্র করে।
এই ফিজিক্স পড়ুয়া ‘স্বশিক্ষিত দ্বীন বিশেষজ্ঞ’ ভদ্রলোক ‘কোরআন বিশেষজ্ঞ সুধীজন’ নামক ব্যানারে আয়োজিত সেমিনারে আলেমদের পরিচয় প্রসঙ্গে বিষোদগার করে বলেন,
“আলেম শব্দটিকে কিছু মানুষ পকেটস্থ করে ঘুরে বেড়ায়। অথচ তারা শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানী। দুনিয়াবী ও ধর্মীয় উভয়বিধ জ্ঞান না থাকার কারণে তাদেরকে আলেম বলা যায় না।”
প্রোগ্রামে উপস্থিত শ্রোতাদের লক্ষ্য করে তিনি আরো বলেন,
“এখানে আপনারা সবাই শিক্ষিত মানুষ। প্রফেসর, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। এখানে সব কথা বলা যায়। মসজিদে এত মেধাবী লোক আসে না, সেখানে সব কথা বলা যায় না।”
প্রোগ্রামে তিনি সবচেয়ে ভয়ানক যে কথাটি বলেন তা হচ্ছে,
“জান্নাত লাভের জন্য মুসলমান হওয়াকে আল্লাহ কুরআনে কারীমে শর্ত করেননি।”
এ প্রসঙ্গে তিনি সূরাতুল বাকারার ৬২ নং আয়াত
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالنَّصَارَىٰ وَالصَّابِئِينَ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ.
দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে বলেন, “আল্লাহ এখানে কাউকে মুসলমান হবার শর্ত আরোপ করেননি।”
তিনি আরো বলেন, “এই আয়াত দ্বারা বুঝা যায় কোনো ইহুদি, খ্রিস্টান অথবা সাবেয়ী আল্লাহকে বিশ্বাস করলে এবং ভালো কাজ করলে জান্নাত লাভ করবে।”
এই ভিডিও ক্লিপটি ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। তারা গাউসুল আজম মসজিদের খতিব মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী এবং ইমাম মুফতি জুনায়েদ কাসেমী সাহেবের কাছে তাওহীদ ও শিরক এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা তুলে ধরার আহ্বান জানায়।
একজন আলেম এবং মসজিদের খতিব হিসাবে নিজের দায়িত্বের জায়গা থেকেই মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী গত ৪ অক্টোবর জুমার বয়ানে সূরাতুল বাকারার ৬২ নং আয়াত সামনে রেখে তাওহীদ এবং শিরক বিষয়ে আলোচনা করেন।
মসজিদ সভাপতি সেই বয়ানের সাথে দ্বিমত পোষণ করে জুমার পর মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবীকে ফোন করে বলেন,
“আপনার বয়ানে অনেকে কষ্ট পেয়েছে। আপনি সামনের জুমায় মুসল্লিদের সামনে দুঃখ প্রকাশ করবেন।”
মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী শিরক-বিদআত এবং ইসলামের ছদ্মাবরণে ভ্রান্ত গোষ্ঠী কর্তৃক ঈমান বিনষ্টের নানাবিধ অপতৎপরতার বিরুদ্ধে মসজিদে এবং মাহফিলে নিঃসংকোচে, সাহস করে কথা বলেন।
জুমার দিন নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই দূরদূরান্ত এমনকি ঢাকার বাইর থেকে আইয়ুবী সাহেবের ভক্ত, অনুরাগীদের ভিড়ে মসজিদ ভরে যায়। তিনি মুসল্লিদের অগাধ সম্মান, ভালোবাসা এবং আস্থা অর্জন করেছেন। তার হৃদয়স্পর্শী বয়ানে উদ্বুদ্ধ মুসল্লিদের স্বতঃস্ফূর্ত আর্থিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্তমানে গাউসুল আজম মসজিদটি দুই তলা থেকে পাঁচ তলা হয়েছে। জুমার দিন মসজিদের আশপাশের রাস্তাঘাট এমনকি বাসাবাড়ির গাড়ির গ্যারেজগুলো পর্যন্ত মুসল্লিতে গিজগিজ করে।
গত ১১ অক্টোবর জুমার বয়ানে তিনি পুনরায় তাওহীদ এবং শিরকের বয়ান করেন এবং তাওহীদ সম্পর্কে ভ্রান্ত আকিদা পোষণের পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সতর্কবাণীগুলো আলোচনা করে শেষ পর্যায়ে বলেন, গত সপ্তাহে আমি তাওহিদ এবং শিরক এর বয়ান করার পর মসজিদের সভাপতি সাহেব আমাকে ফোন করে বলেছেন, “আমার বয়ানে অনেক কষ্ট পেয়েছে। এই জুমার বয়ানে আমি যেন দুঃখ প্রকাশ করি।”
এরপর মসজিদের সভাপতি মাইক নিয়ে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলে মসজিদে উপস্থিত হাজার হাজার মুসল্লী তার বিরুদ্ধে ক্ষেপে যায় এবং নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে।
তখন পুনরায় মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী মাইকে বলেন, যিনি ঈমান এবং তাওহীদ সম্পর্কে ভ্রান্ত আকীদা পোষণ করেন, এমনকি আমিও যদি সে হই, মসজিদের খতিব হবার উপযুক্ত নই। যদি সভাপতি সাহেব এমন আকীদা পোষণ করেন, তাহলে তিনিও মসজিদের সভাপতি থাকার উপযুক্ত নন। মসজিদে দ্বীনের যথাযথ চর্চা হওয়া উচিত।’
এরপর তিনি মুসল্লিদের শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানান এবং খুতবা দিয়ে নামাজ সম্পন্ন করেন। নামাজ শেষে পুনরায় মুসল্লিরা সভাপতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকলে মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী মাইক নিয়ে বলেন, ‘মসজিদ কমিটি রয়েছে, স্থানীয় কাউন্সিলর সাহেব আছেন। তারা এর সমাধান করবেন, আপনারা নিজ নিজ বাসায় চলে যান।’
তখনো মসজিদ সভাপতি নিজেকে রক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন। তার ভ্রান্ত আকীদা প্রকাশ পাওয়ার পর তিনি সেটি ব্যাখ্যা করতে গেলে উপস্থিত মুসল্লিরা তার উপরে দুই কারণে ক্ষেপে যায়। প্রথমত তিনি ভ্রান্ত আকীদায় বিশ্বাসী। দ্বিতীয়ত তিনি খতিব সাহেবকে অন্যায়ভাবে প্রেসার দিয়েছেন। মুসল্লিদের ক্ষোভ থেকে আইয়ুবী সাহেব বরং সভাপতিকে রক্ষা করেন।
এই হচ্ছে ঘটনার পূর্বাপর সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
কিন্তু অপরিণামদর্শী আর অতিউৎসাহী ফেসবুকার ভাইদের কল্যাণে গোটা ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টোভাবে আলোচনায় এসেছে।
ফেসবুক একটি হুজুগে প্ল্যাটফর্ম। বাস্তবতার ধারে কাছে না গিয়ে অনেক সময় আমরা স্রোতের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে অনুমানের ভিত্তিতে তিলকে তাল বানিয়ে ফেলি। এরকম স্পর্শকাতর’ ইস্যুতে কিছু লেখার আগে অবশ্যই আমাদের সর্তকতা এবং সচেতনতা বজায় রাখা উচিত।
(দ্বিতীয় কমেন্টে সভাপতির বিভ্রান্তিকর ভিডিও বক্তব্য রয়েছে। এটা একটা ভয়াবহ বিষয় যে, এরকম কুফরী আকীদা বিশ্বাসের মুসলিম নামধারীরা বিভিন্ন মসজিদের সভাপতি সেক্রেটারির পদ আঁকড়ে বসে আছে)
– ওয়ালিউল্লাহ আরমান