বৃহস্পতিবার, ২৮শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ই রমজান, ১৪৪৬ হিজরি
শতাব্দীর চিঠি
মুসা আল হাফিজ
( পূর্বপ্রকাশের পর)
আপনি, হ্যাঁ, নুর কুতুবুল অালম – আপনি তখন খানকায়।পাণ্ডুয়ায়, লাখ লাখ মানুষের ভাবের বাগানে। যে বাগান গড়েছেন বাংলার হৃদয়ের সুলতান অাখি সিরাজুদ্দীন ওসমান। তারই স্নেহের ছায়ায় বিকশিত হন সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। একজন অনুগত শাগরেদের মতোই ইলিয়াস শাহ আসতেন পাণ্ডুয়ায়। বসতেন সিরাজুদ্দীন আখির পায়ের কাছে। যে আখি ছিলেন নিজামুদ্দিন আওলিয়ার খলিফা আর তারই পক্ষ থেকে নিয়োজিত বাংলার প্রদীপ। আখি সিরাজের আগে বাংলার দরবেশ বলে কোনো দরবেশ ছিলেন না।শামসুদ্দীন ইলিয়াসের আগে বাংলার রাজা বলে কোনো রাজা ছিলেন না। এর আগে মূলত বাংলা বলতে কোনো সমন্বিত জনপদই ছিলো না। যে দিন আখি সিরাজ ইলিয়াস শাহকে বললেন,তুমি শুধু রাজা হবে না, তুমি হবে একটি জাতিরাষ্ট্রের স্থপতি, সেদিন কে জানতো অচিরেই বিচ্ছিন্ন রাঢ়,বরেন্দ্র, বঙ্গ,সমতট ইত্যাদি বিভিন্ন জনপদ একত্রিত করে ইলিয়াস শাহ তার নাম দেবেন ” বাঙ্গালাহ।” নিজে হবেন ” শাহে বাঙ্গালাহ” অথবা ” শাহে বাঙ্গালিয়ান।” ১৩৩৮ সালে তিনি ঘোষণা করলেন বাংলার স্বাধীনতা। ইলিয়াস শাহ হয়তো ভাবেন নি, বিচ্ছিন্ন জনপদসমূহকে একত্রিত করে তিনি যাকে বাঙ্গালাহ এবং অধিবাসীদের বাঙ্গালী বলে পরিচিত করলেন,সেই দেশ এবং তার অধিবাসীরা এ নামেই দুনিয়াময় পরিচিত হবে। কিন্তু তারা ভুলে যাবে ইলিয়াস শাহের নামটিও।স্মরণ করবে না একটি দিনের জন্যও!
যদিও ইতিহাস তার কীর্তিকে পারেনি ভুলে যেতে।
বাঙ্গালীর সেই উত্থানলগ্নে জড়িয়ে আছে পাণ্ডুয়ার খানকা, যা ছিলো ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সৃষ্টিসেবা কার্যক্রমের এমন কেন্দ্র, যা যে কোন জাতির জন্যে শ্লাঘার, মহিমার। সেই কেন্দ্রে ছিলো বাংলার সেরা গ্রন্থাগার, সেরা জ্ঞানতত্ত্বের আগার। আখি সিরাজুদ্দিনের ইন্তেকাল শেষে আপনার পিতা হন সেই খানকার কান্ডারি। আপনার দাদা ছিলেন লাহোরের মহান জ্ঞানসাধক। পিতা আলাউল হক আত্মার তৃষ্ণায় চলে এলেন বাংলায়- পাণ্ডুয়ায়। তিনি ছিলেন তত্তবাগীশ,শাস্ত্রবিদ। জ্ঞান ও মনীষার দ্যুতি বিচ্ছুরিত হতো তার ব্যক্তিত্বের আভায়।জ্ঞানচর্চা তাকে দিয়েছিলো উত্থানের মন্ত্র।এতো দিন শিখেছিলেন উপরে উঠা।আখির কাছে এসে শিখলেন, নিচে নামা,মানবতাকে উচ্চে তুলে নিজেকে মাটিতে পরিণত করা। অন্যকে মহান করে, আলোকিত করে, সবার জন্য বেচে থাকা।সবার জন্য বাচতে গিয়ে নিজে নাই হয়ে যাওয়া। বিপুল বিত্ত ছিলো তার। তা থেকে অবিরাম বিলিয়ে দিতেন অভাবিদের মাঝে। তিনি যখন পাণ্ডুয়ার প্রধান হলেন, অন্য রকম এক জাগৃতির জোয়ার এলো চারদিকে। বিশাল লঙ্গরখানা,দঃখী- অভাবিজনের বিপুল আনাগোনা। জাতপাত ও মনুবাদী বর্ণপ্রথায় নিপিষ্ট হাজার হাজার হিন্দু, মানব- মানবী,জমিদার, রাজা- উজির।সকলের পথ এসে পাণ্ডুয়ার পথে মিশে যেতে লাগলো।
বিনামূল্যে এখানে খাদ্য পেতো ক্ষুধার্তরা।চিকিৎসা পেতো রুগ্নরা।বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ও সেবা পেতো ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে গণনাতীত মানুষ।শেখ শরফুদ্দীন ইয়াহইয়া মানেরী আর শেখ আলাউল হক – বাংলার মুসলিম জীবন এ দুই সাধকের কক্ষপথে অাবর্তিত হচ্ছিলো। কিন্তু উভয়ের মধ্যে আলাউল হক ছিলেন অধিক প্রভাবশালী। আখি সিরাজের ইন্তিকালের পরে সুলতান ইলিয়াস শাহ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন মহান আলাউলের। ১৩৫৭ সালে তার ইন্তিকালের পরে সুলতান হন তার পুত্র সিকান্দার শাহ। তিনিও পান্ডুয়ার দরিবারে নিজেকে সেবক হিসেবে হাজির করেন।
আপনি তখন খানকার সামান্য এক কর্মী। যারা আসেন, তাদের খাদ্য তৈরী করেন, বিতরণ করেন,খাদ্য পাকানোর জন্য কাঠ সংগ্রহ করেন জংগল থেকে। আপনার হাত রক্তাক্ত হয়, আপনার শরীর শুকিয়ে যেত থাকে, হাজার জনের সেবায় আপনি দিন- রাত শ্রম দেন।অনেক সময় খাওয়া হয়ে উঠে না।ঘুমানো হয়ে উঠে না।
মহান আলাউলের পুত্র হিসেবে সবাই আপনাকে শ্রদ্ধা করতো। কিন্তু আপনি দরবারে করতেন মজুরের কাজ,কাঠুরিয়ার কাজ,ঝাড়ুদারের কাজ। রাতে আপনি মগ্ন থাকতেন গ্রন্থপাঠে। অজস্র গ্রন্থ, কত শত বিষয়ে কত বিপুল গ্রন্থ- আপনাকে পড়তে হতো আর পড়তে হতো।
আলাউল হক আপনার পরিশ্রমের খবরে খুশি হতেন।অপরিশ্রম, বিলাসিতা, বড়লোকি ঘৃণা করতেন।নিজের সন্তানকে মানুষের ভক্তির জায়গায় নয়,দেখতে চাইতেন সেবকের জায়গায়।
আপনি জানতেন, সুলতান সিকন্দর শাহ পাণ্ডুয়ার সেবকদের একজন। কিন্তু দেখেছেন,তিনিই আপনাদেরকে পাণ্ডুয়া থেকে বের করে দিলেন। আপনি কি জানতেন এর কারণ? হয়তো জানতেন মতবিরোধের কথা।কিন্তু আরো বড় হয়ে জেনে থাকবেন আসল কারণ। আপনার পিতা ছাত্র,এতিম, পথিক ও ভিক্ষুকদের জন্য এতো বেশি ব্যয় করতে লাগলেন,যার পরিমাণ সুলতানের ব্যয়ের অধিক হয়ে গেলো। সুলতানের দরবারে সাহায্যের জন্য যত মানুষ যেতো,আপনার পিতার কাছে আসতো তারও অধিক। সুলতানের জন্য এ ছিলো লজ্জার,অপমানের।তিনি আপনাদের সোনারগায়ে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে গেলো আরেক সেবা ও বিদ্যাকেন্দ্র। আপনার সাধনা গেলো আরো বেড়ে। আপনার পিতার দানের স্রোত বর্ষার নদীর মতো দুকূল উপচে বইতে লাগলো। আরো অধিক জনসমুদ্র আপনাদের ঘিরে তরঙ্গায়িত হতে থাকলো।
আপনি তখনই সমাজ,রাজনীতি ও জাতিয় সঙ্কটের প্রতি সজাগ। দেখেছেন সিকন্দর শাহের সিংহাসন ঘিরে ঘোরপাক খেতে থাকা সব বিবাদ।সুলতানের দুই স্ত্রীর ঝগড়া। বড় স্ত্রীর সতেরো সন্তান,ছোট স্ত্রীর সন্তান একজন। আর সেই একজনই সবচে যোগ্য, সবচে’ প্রজ্ঞাবান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ।বড় স্ত্রী তার সতেরো সন্তান দিয়ে আজম শাহের জীবনকে বিপদাপন্ন করে তুললেন।প্রাণের ভয়ে তিনি পালালেন গৌড় থেকে।চলে এলেন সোনার গায়ে। গড়ে তুললেন সেনাবাহিনী। এগিয়ে এলেন পিতার সিংহাসন ঘিরে ষড়যন্ত্র দমনে।কিন্তু হায়! পিতাই এগিয়ে এলেন প্রতিরোধে। পুত্রের তৎপরতা তার কাছে বিদ্রোহ। তিনি এর প্রতিবিধান করবেনই। যুদ্ধ হলো গৌড়ের বাহিনীর সাথে।পিতা- পুত্রের লড়াই। পুত্র নিষেধ করে দিলেন, কোনো যোদ্ধা আমার বাবা- সুলতান সিকন্দর শাহকে যেন আঘাত না করে।কিন্তু সব যোদ্ধা তো আর তাকে চিনে না। কোন এক অসতর্ক সৈনিকের বেপরোয়া আঘাতে ধূলিলুণ্ঠিত হলেন সিকন্দর শাহ। আজম শাহ খবর পেয়েই পিতার কাছে ছোটে গেলেন।আহত পিতার মাথা কোলের উপর রাখলেন। পিতা তার দিকে তাকালেন।তিনি মঙ্গল চান সন্তানের।তিনি খুশি,কারণ তার পুত্র বিজয়ী হতে জানে।নেতৃত্ব দিতে জানে। দেশকে,দেশের জনগকে সে পরিচালনার ক্ষমতা রাখে। সিকন্দর শাহ পুত্রকে জানালেন শুভাশিষ। তার সাফল্যের আনন্দে মৃদু হাসি মুখে নিয়ে তিনি বরণ করলেন মৃত্যুকে।জয়ী হলেন আজম শাহ। দখল করলেন পিতার সিংহাসন।
রাজনীতির এই অস্থির চক্র আপনি নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন খানকায় বসে বসে। মহান আলাউল হকের ইন্তেকালের পরে আপনিই হন খানকার প্রধান। গোটা জাতির অভিভাবক। আজম শাহ আপনার শরণ নিতেন রাষ্ট্র শাসনে। আপনি রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে দরবেশি থেকে আলাদা ভাবতেন না। খেদমতে খালক ছিলো আপনার পিতার প্রধান প্রবণতা, আপনি এর সাথে যুক্ত করলেন রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তা।
আপনার মতোই রাজনীতি সচেতন সাধক ছিলেন মুজাফফর শামস বলখী। আপনাদের বোঝাপড়া ছিলো, মতানৈক্য ছিলো না। প্রীতি ছিলো, প্রতিযোগিতা ছিলো না।সহযোগিতা ছিলো, দ্বন্দ্ব ছিলো না।ভাবি,আপনারা যদি এক ও যৌথ না হতেন, প্রতিরোধ করতে পারতেন না সেই কালোঝড়ের। মুসলিম বাংলার ভেতরে – বাইরে যে ঝড় বিনাশী চরিত্র নিয়ে হামলে পড়েছিলো।
রাজা গণেশ ছিলো তার আসল হোতা। তার মনুবাদ ও মহাভারতীয় সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ করলেন আপনি ও শামস বলখী।
ব্রাক্ষণ্যবাদী চক্রের দেশী- বিদেশী যে সংযোগ রাষ্ট্রকে ফোকলা করে দিচ্ছে,বার বার পরাজিত করছে সমরমাঠে,সেনাবাহ
িনীকে করে তুলছে ক্ষয়িষ্ণু – আপনি সেই সংযোগকে চিহ্নিত করতে লাগলেন। প্রশাসনের সর্বত্র ব্রাক্ষণ্যবাদের পরিকল্পিত অনুপ্রবেশের দরোজা আপনারা বন্ধ করে দিতে চাইলেন। শামস বলখী চিঠি লিখলেন গিয়াসুদ্দীন আজম শাহকে। অনেকগুলো চিঠি। কেমন ছিলো সেই সব সম্বোধন? কীভাবে তিনি প্রয়োগ করতেন পত্রভাষা?
আজকের সাধক হয়তো অবাক হবেন কিন্তু তিনি সুলতানকে লিখতেন এভাবেই – ” তুমি রাজা এবং যুবক।অতীতে একটা সময় সুখ ভোগ আর আমোদ- প্রমোদে মগ্ন ছিলে। এখন কামনা করছো পবিত্র জীবন, ধর্মনিষ্ঠ জীবন।”
এক পত্রে তিনি বলে দিলেন, প্রশাসনের সংখ্যালঘু কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ রাজা গণেশের অধিন।আর রাজা গণেশ চারপাশে ঘিরে থাকা শত্রুরাষ্ট্রের সহযোগী। তারা চায় মনুবাদের বিজয় অতএব সাধু সাবধান!
( অসমাপ্ত)