শুক্রবার, ১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১লা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

‘এপ্রিল ফুল’ কেন বর্জন করবো? আল্লামা তকী উসমানী


বুঝে না বুঝে পশ্চিমাদের অনুকরণ আমাদের মাঝে যেসকল প্রথার জন্ম দিয়েছে, তার একটি হলো ‘এপ্রিল ফুল’ পালনের অপসংস্কৃতি। পয়লা এপ্রিলের দিন এপ্রিল ফুল পালনের নামে মিথ্যা বলে, কাউকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোকে বৈধতা তো দেয়া হয়েইছে, সেই সাথে এটি চরমোৎকর্ষ কাজ হিসেবে পরিণত করা হয়েছে। যে যত নৈপুণ্য ও চতুরতার সাথে কাউকে বেশি বোকা বানাতে পারে, সে তত বেশি বাহবা পায় এবং দিবসটির উদ্দেশ্য পূরণে সফল হয়।

Default Ad Content Here

এই মজা করাকে (মূলত বদমাইশি) কেন্দ্র করে না-জানি কত লোক শারীরিক-মানসিক-আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কখনো কখনো তো অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। এমন ঘটনা ঘটেছে যে, কাউকে এমন মিথ্যা সংবাদ শোনানো হয়েছে, যা শোনার জন্যে তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না, শুনে সহ্য করতে না পেরে দুনিয়া ছেড়েছেন।

এ কুপ্রথার ভিত্তি মিথ্যা, প্রতারণা ও কোনো বেচারাকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানো। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে কতটা নিম্নমানের তা তো প্রকাশ্য। কিন্তু এর ঐতিহাসিক ভিত্তিও এসকল লোকদের জন্যে চূড়ান্ত লজ্জার। এ ঘটনার একটি কোনোভাবে হযরত ইসা আলাইহিস সালামের ইজ্জত, সম্মান ও মর্যাদার সাথে সম্পর্কযুক্ত।

এ প্রথার উৎপত্তি কীভাবে হলো?—এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কিছু ঐতিহাসিকের বক্তব্য, ফ্রান্সে সপ্তম শতাব্দীর আগে বছরের শুরু জানুয়ারির পরিবর্তে এপ্রিল মাসে হতো। এ মাসটিকে রোমানরা তাদের দেবী ‘ভেনাসে’র সাথে সম্পর্কিত করে সম্মানিত মনে করতো। ভেনাসকে গ্রিক ভাষায় ‘আফ্রোদিতি’ বা ‘আফ্রোডাইটি’ (Aphrodite) বলে। সম্ভবত এই গ্রিক নাম থেকেই এপ্রিল মাসের নামকরণ হয়েছে।

[এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকা, ১৫তম এডিশন, খ. ৮, পৃ. ২৯২]

অপর লেখকদের মতে, যেহেতু পয়লা এপ্রিল বছরের প্রথম দিন ছিল, সেই সাথে একটি ধর্মীয় মর্যাদা ছিল, সেহেতু দিনটিকে লোকেরা একটি উৎসবের দিন হিসেবে পালন করতো। এ উৎসবের অংশ ছিল মশকরা, হাসি, ঠাট্টা ইত্যাদি। যা কালের বিবর্তনে আজকের এপ্রিল ফুলে রূপ নিয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এ উৎসবের দিনে একে অপরকে উপহার দিতো। একবার কেউ উপহার দেয়ার নামে মজা করে, তা অবশেষে সকলের মাঝে ছেয়ে যায় এবং প্রথায় রূপ নেয়।

ব্রিটেনিকায় এর আরেকটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। মার্চের ১২ তারিখ থেকে ঋতুতে পরিবর্তন আসতে থাকে। এ পরিবর্তনকে কিছু লোক এভাবে ব্যাখ্যা করে যে, (মাআযাল্লাহ) ঈশ্বর আমাদের সাথে মশকরা করে আমাদের বোকা বানাচ্ছেন! সেসময় লোকেরা একে অন্যকে বোকা বানানো শুরু করে দিলো।

[ব্রিটেনিকা, খ ১, পৃ. ৪৯২]

প্রশ্ন দাঁড়ায়, এই কথিত ‘মশকরা’র প্রথার দ্বারা ‘ঈশ্বরে’র আনুগত্য উদ্দেশ্য না কি ‘ঈশ্বরে’র সাথে প্রতিযোগিতা বা প্রতিশোধ উদ্দেশ্য?

তৃতীয় আরেকটি কারণ খ্রিস্টীয় বিংশ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ এনসাইক্লোপেডিয়া ‘লারৌসে’ (Grand Larousse encyclopédique) বর্ণিত হয়েছে। সেখানে তৃতীয় কারণটিকে সঠিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সঠিক হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সেখানে উল্লিখিত ঘটনাটি ইহুদি ও খ্রিস্টান জগতের সকল নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী সন্নিবেশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পয়লা এপ্রিল সেই দিন, যেদিন রোমান ও ইহুদিরা হযরত ইসা আ.-কে নিয়ে উপহাস ও বিদ্রূপ করেছিল। বাইবেলে এটি বর্ণিত হয়েছে :

“সেই ব্যক্তি যে তাকে (যীশু খ্রিস্টকে) গ্রেফতার করেছিল, সে তাকে আড়াল থেকে মারতো, তার চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে মুখে মারতো এবং বলতো, তোমার ক্ষমতা দিয়ে বলো, তোমায় কে মেরেছে? এছাড়াও তাকে গালি দিতো এবং নানাভাবে বিদ্রূপ করতো।”

[লুক, ২২:২৩ থেকে ২৫]

বাইবেল থেকে জানা যায়, প্রথমে যীশু খ্রিস্টকে ইহুদি সরদার ও বিচারকদের উচ্চ আদালতে নেয়া হয়। সেখান থেকে তাঁর বিচারের জন্য তাঁকে পিলাতসের (ইংরেজিতে পাইলেট; Pontius Pilate) বিচারালয়ে নেয়া হলো। পিলাতস তাঁকে হেরডেসের (ইংরেজিতে হেরেড; Herod Antipas) বিচারালয়ে পাঠালো। হেরডেস পুনরায় তাঁকে পিলাতসের নিকট পাঠালো।

লারৌসের বক্তব্য হলো, যীশু খ্রিস্টকে এক আদালত থেকে অপর আদালতে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল তাঁর সাথে ঠাট্টা-মশকরা করা এবং কষ্ট দেয়া। আর এ ঘটনা ছিল এপ্রিলের প্রথম দিনকার। আর সেখান থেকেই এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি। যা এমন লজ্জাকর ঘটনার স্মৃতি।

এপ্রিল ফুল হিসেবে যাকে বোকা বানানো হয়, তাকে ফরাসি (ফ্রেঞ্চ) ভাষায় Poisson d’avril বলা হয়। যার ইংরেজি April Fish অর্থাৎ এপ্রিলের মাছ। [ব্রিটেনিকা, খ. ১, পৃ. ৪৯৬]। এর অর্থ হলো, যে ব্যক্তিকে বোকা বানানো হলো, সে এপ্রিলের প্রথম শিকার করা মাছ। কিন্তু লারৌসের মতে, ফ্রেঞ্চ শব্দ Poisson যার অর্থ ‘মাছ’, যা কিনা ফ্রেঞ্চে এর মতোই আরেকটি শব্দ— Posion এর বিকৃত রূপ। যার অর্থ, ‘কষ্ট দেয়া’, ‘অত্যাচার করা’। এজন্য যে এই প্রথা সেই কষ্ট ও অত্যাচারের কথা স্মরণ করায়, যা কিনা খ্রিস্টীয় বর্ণানা মতে, যীশু খ্রিস্টকে করা হয়েছিল।

অপর এক ফরাসি গবেষকের বক্তব্য হলো, মূলত Poisson শব্দটি নিজ রূপেই রয়েছে। তবে এটি পাঁচটি শব্দের মিলিত রূপ। শব্দগুলোর অর্থ, ফ্রেঞ্চ ভাষায় যথাক্রমে ‘যীশু’, ‘খ্রিস্ট’, ;ঈশ্বর’, ‘পুত্র’ এবং‘প্রিয়’। এই লেখকের মতেও এপ্রিল ফুলের গোড়ার কথা হলো, এটি যীশু খ্রিস্টের সাথে করা ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও তাঁকে কষ্ট দেয়ার ইতিহাস।

যদি এগুলো সত্য হয়ে থাকে (লরৌস এবং অন্যান্যরা খুব জোর দিয়েই এটিকে সঠিক বলেছে এবং রেফারেন্সও দিয়েছে) তো পরিষ্কার ধারনা এটিই যে, এটি হয়তো ইহুদিরা চালু করেছিল, আর তাদের উদ্দেশ্য যীশু খ্রিস্টকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, যদিও এটি ইহুদিরা চালু করেছে যীশু খ্রিস্টকে বিদ্রূপ করে, তবু খ্রিস্টানরা কোনোভাবে খুবই উৎসাহের সাথে এটিকে গ্রহণ তো করেই নিয়েছে, সেই সাথে এটি পালন করা ছাড়াও, এটিকে প্রথা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে নিজেদের সমাজে। এর একটি কারণ এও হতে পারে যে খ্রিস্টানরা এর সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। ভাবনা চিন্তা না করেই তারা এ প্রথা পালন শুরু করে দিয়েছে। এও হতে পারে যে খ্রিস্টানদের এ ব্যাপারে চিন্তাধারা আলাদা কিংবা অদ্ভুত। যেমন—তাদের মতে যে ক্রুশে ঝুলিয়ে যীশু খ্রিস্টকে হত্যা করা হয়েছে, বিবেকের কথা তো এ-ই যে, তাদের নিকট এ ক্রুশ খুব ঘৃণার বস্তু হবে। কেননা এতে চড়িয়েই যীশু খ্রিস্টকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ তাদের কাছে এ ক্রুশই হলো গিয়ে পবিত্র জিনিস! এখন এটি খ্রিস্টান ধর্মের সবচেয়ে বড় চিহ্ন।

যাই হোক, উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝা গেলো, এপ্রিল ফুল ‘ভেনাস’ নামি দেবীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। অথবা (মাআযাল্লাহ) এটিকে ঈশ্বরের মশকরা ও তাঁর সাথে প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য থেকে শুরু হয়েছে। অথবা ঈসা আ.-কে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করার উদ্দেশ্য থেকে শুরু হয়েছে। সর্বাবস্থায় এ কুপ্রথা আমাদের কোনো না কোনো জঘন্য চিন্তাধারার সাথে সম্পর্কযুক্ত করছে। আর মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গিতে এ প্রথা নিম্নোক্ত গুনাহসমূহের সমগ্র :

১। মিথ্যা বলা;

২। ধোঁকা দেয়া;

৩। অপরকে কষ্ট দেয়া;

৪। এমন একটি ঘটনার সাথে সম্পর্কিত যে, হয় এটি মূর্তি-পূজার, অথবা ব্যক্তি-পূজার, অথবা একজন নবীর ব্যাপারে বেআদবি ও ঠাট্টার উদ্দেশ।

এখন মুসলিমদের নিজে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, এ কুপ্রথাকে পালন করে তা নিজেদের সামাজিকতার অন্তর্ভুক্ত করবে কি না?

আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া যে, আমাদের সমাজে এপ্রিল ফুল পালনের প্রবণতা খুব বেশি নয়। কিন্তু প্রতিবছর কিছু খবর পাওয়া যায় যে, কিছু লোক এপ্রিল ফুল পালন করছে। যারা না বুঝে এটি পালন করেন, তারা যদি এর মূল ইতিহাস ও উদ্দেশ্য গভীরভাবে চিন্তা করেন, তবে অবশ্যই এটি থেকে বিরত থাকার মর্মোদ্‌ঘাটনে সক্ষম হবেন।

১৪ শাওয়াল, ১৪১৪ হি.
২৭ মার্চ, ১৯৯৪ ইং.

মূল : আল্লামা তকী উসমানী
অনুবাদ : সামীউর রহমান শামীম
মুফতি তাকী উসমানীর ‘যিকর ও ফিকর’ গ্রন্থের ৬৬—৭০ নম্বর পৃষ্ঠার ‘এপ্রিল ফুল’ শীর্ষক প্রবন্ধ হতে।

Archives

October 2024
S S M T W T F
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031