শনিবার, ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
মুসলিম উম্মাহর একজন দরদী মানুষ ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ.-কে যেমন দেখেছি
———– মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক দা.বা.
যদিও ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ.-এর সাথে আমার একাধিকবার মুলাকাত হয়েছে কিন্তু তার সম্পর্কে এত বিস্তারিত আমার জানা ছিল না। তার আখলাক-চরিত্র, কর্ম ও কীর্তি এবং বিভিন্ন দ্বীনী খেদমতের কথা জেনে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছি। আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমীন।
এক মজলিসে আমি সরাসরি তার কাছ থেকে শুনেছি যে, আমাদেরকে চলতে হবে সুন্নাহ ও উম্মাহকে সঙ্গে নিয়ে। অর্থাৎ শরীয়তের দলীল তো হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। এবং এই সুন্নাহ্ই উম্মতের জন্য উসওয়ায়ে হাসানা ও সর্বোত্তম আদর্শ। তবে যেহেতু অনেক মাসআলার ক্ষেত্রেই সুন্নাহ্র বিভিন্নতা রয়েছে আবার বহু মাসআলার মধ্যে সুন্নাহ অনুধাবনের ক্ষেত্রে বা তার আমলী রূপরেখা নির্ধারণের ক্ষেত্রে হাদীস ও সুন্নাহ-বিশেষজ্ঞ ফকীহদের মাঝে ইজতিহাদী ইখতিলাফ রয়েছে, এজন্য নিয়ম এটা হওয়া উচিত, যে এলাকায় উম্মাহর মধ্যে যে আমল চালু আছে যদি সুন্নাহ্য় তার কোনো নির্ভরযোগ্য দলীল বিদ্যমান থাকে তাহলে সাধারণ মানুষের সামনে ঐ সুন্নাহর মোকাবেলায় আরেক সুন্নাহর দাওয়াত দিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করা উচিত নয়। তার এই কথাটি আমার খুব ভাল লেগেছে। সত্য বলতে কী- সব যুগের মুহাক্কিক ও মুতাদিল উলামায়ে কেরামের নীতি এটাই ছিল। আমার বিশ্বাস, যদি তার উল্লেখ করা এই নীতি অনুযায়ী তিনি তার পুরানো কিতাব ‘ইহইয়াউস সুনান’-এর নযরে ছানি করার সুযোগ পেতেন তাহলে অনেক মাসআলার মধ্যে তার রায় পরিবর্তন হয়ে যেত। অন্তত এই প্রবন্ধ পাঠ করে আমার এটাই মনে হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে বলে রাখি, অনেক ভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তার অমুক কিতাবটি কেমন? আমি কি এ কিতাবটি পড়তে পারি? এধরনের প্রশ্ন আমার জন্য খুবই বিব্রতকর। কোনো কিতাবের উপর মতামত দিতে হলে সে কিতাবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে হয়। যদি কেউ এর সুযোগ না পায় তাহলে সে কীভাবে জবাব দেবে? তাছাড়া কে কোন কিতাব পড়বে তা বলার জন্যে তো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবস্থা জানতে হয়। এ জন্য সঠিক পন্থা এটাই যে, সকলেই আমরা নিজ নিজ দ্বীনী ও ইলমী মুশীরের সাথে মাশওয়ারা করেই মুতালাআর কিতাব নির্বাচন করব। যাই হোক, এই প্রবন্ধের জন্য আমরা মাওলানা যাকারিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞ। নযরে ছানীর সময় যেখানে খুব প্রয়োজন অনুভব হয়েছে, সেখানে টীকায় কিছু নোট লিখে দেওয়া হয়েছে। আশা করি, সম্মানিত পাঠক টীকাগুলোর দিকেও নযর বুলাবেন।
রবিউল আউয়াল ১৪৩৫ হি. ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর ‘আলফিকহুল আকবার’-এর বাংলা অনুবাদ ও ব্যাখ্যা প্রকাশ করেন। তার বড় একটা অংশ আমি মুতালাআ করেছিলাম। এবং সে বিষয়ে আমার মতামত তাকে জানিয়েছিলামও। সেই ব্যাখ্যাগ্রন্থে মাশাআল্লাহ কিছু উপকারী আলোচনা রয়েছে। তবে কিছু কিছু বিষয়ে আপত্তিও রয়েছে। প্রথম কথা তো এই যে, যে ‘আল ফিকহুল আকবার-এর অনুবাদ তিনি করেছেন তা নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণসিদ্ধ রায় মোতাবেক আবু হানীফা রাহ.-এর কিতাব নয়। যদিও মোল্লা আলী কারী রাহ. সেটাকে আবু হানীফা রাহ.-এর কিতাব মনে করে তার শরাহ্ও লিখে দিয়েছেন। এবং ইবনু আবীল ইয রাহ. ‘শরহুল আকিদাতিত তাহাবিয়ায়’ তাকে আবু হানীফা রাহ.-এর কিতাব বলে উল্লেখ করে তার থেকে হাওয়ালা উদ্ধৃত করেছেন। মনে হয়, আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেব তাদের অনুসরণ করেছেন। আসল ‘আল ফিকহুল আকবার’ সেটিই যেটি মিসরের প্রকাশকগণ ‘আল ফিকহুল আবসাত’ নামে ছাপিয়েছেন। এবং অনেক প্রকাশক এটিকে ‘আল ফিকহুল আকবার’ নামেই ছাপিয়েছেন। সে ব্যাপারে অন্য কোনো প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা আছে ইনশাআল্লাহ।
দ্বিতীয় কথা হল, জাহাঙ্গীর সাহেবের বাংলা ব্যাখ্যায় মাতুরিদী ও আশ‘আরীদের উপর ঢালাওভাবে কিছুটা কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে, যা মুনাসিব হয়নি। যদি তার পূর্ববর্তী মাতুরিদী ও আশ‘আরীদের কিতাবগুলো গভীরভাবে মুতালাআর সুযোগ হত তাহলে সম্ভবত এমন সমালোচনা করতেন না। অপর দিকে তিনি কট্টরপন্থী সালাফীদের ব্যাপারে (এমনকি এই যুগের এই এলাকার সালাফীদের ব্যাপারেও) কোনো বিশেষ সমালোচনা করেননি। এটাকে একটি ত্রুটিই বলতে হবে, যা সম্ভবত পর্যাপ্ত মুতালাআ ও মুযাকারার সুযোগ না হওয়ার কারণে ঘটেছে।
সিফাতে মুতাশাবিহাতের মধ্যে তিনি লম্বা আলোচনা করেছেন কিন্তু আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র আসল মাসলাক তার আলোচনা থেকে ফুটে উঠেনি। মোদ্দাকথা, এই কিতাবে নযরে ছানীর দরকার ছিল।
যাইহোক, কথা লম্বা হয়ে গেল। আমি বলতে চাচ্ছি, এতে কোনো সন্দেহ নেই, আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেবের জীবনীতে আমাদের জন্য অনুসরণীয় অনেক দিক আছে। ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ. সালাফী আলেম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমরা আশা করব, আমাদের দেশের সালাফী আলিমগণ অন্তত ফুরুয়ী ইখতিলাফের ক্ষেত্রে তার কর্মপন্থাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবেন।আল্লাহ তাআলা এই মুখলিস খাদেমে দ্বীন এবং অনেকাংশে মুতাদিল মেযাজ আলিম ও দায়ীকে, তার নেক খেদমতকে কবুল করুন এবং স্থায়ী করুন। আমীন।