শুক্রবার, ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
ইসলাম হলো মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। একজন তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির কাছে যেমন ঠান্ডা পানি অতীব প্রার্থনীয় একটি বিষয়। প্রতিটি মানুষের জন্য ইসলামও ঠিক তেমন। একজন তৃষ্ণার্ত মানুষ। তৃষ্ণায় তাঁর ঠোঁট-জিহ্বা-কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে। আপনি যদি তাঁর মুখের কাছে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি তুলে ধরেন তাহলে সে ঠেলে দিবে না, বরং টেনে নেবে। ঠিক তেমনিভাবে এখন প্রয়োজন হলো ইসলামকে তৃষ্ণার্তদের মুখের কাছে তুলে ধরা। পুরো পৃথিবী কুফুর-শিরকের জালে আটকে পড়ে আছে। পুরো পৃথিবী এখন শিরক ও কুফরের পাথরের নীচে চাপা পড়ে। আজ তাদের জন্য চাই মুক্তি। ইসলামের বিরুদ্ধে নানা প্রোপাগান্ডা হচ্ছে। আমাদের উচিত, এই প্রোপাগান্ডাকে উপেক্ষা করে পৃথিবীর সামনে ইসলামকে তুলে ধরা। আরমুগানের পাঠকদের কাছে এটাই আমার অনুরোধ।
আহমদ আওয়াহ: আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু!
মুহাম্মদ মুহসিন: ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু!
আহমদ আওয়াহ: মুহসিন সাহেব! আপনি একেবারে সময়মতো এসেছেন।
মুহাম্মদ মুহসিন: জি আহমদ সাহেব! এক মাস ধরে ফোনে হযরত মাওলানার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম। কোনোভাবেই পাচ্ছিলাম না আল্লাহর উপর ভরসা করে রওনা হয়ে গেলাম। ভাবলাম গিয়ে পড়ে থাকবো। যখন দেখা হওয়ার হবে। কিন্ত আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানী, ট্রেন থেকে নেমে খলিলুল্লাহ মসজিদে চলে গেলাম। ভেবেছিলাম হযরত যদি দিল্লি থাকেন তাহলে অবশ্যই মসজিদে দেখা হবে। আলহামদুলিল্লাহ! সাক্ষাৎ হয়েছে।
আহমদ আওয়াহ: আপনি তো আপনার স্বার্থের কথা বলছেন। আর আমি বলছি আমার স্বার্থের কথা। আজ মাসের ২২ তারিখ আরমুগানের আগামী সংখ্যার জন্যে এখনও পর্যন্ত কোনো ইন্টারভিউ সংগ্রহ করতে পারিনি। দুই দিনের মধ্যে পত্রিকা প্রেসে যাবে। গতকাল সন্ধ্যা থেকে চিন্তা করছিলাম। ফোনে কাকে ধরবো হঠাৎ করে আব্বু বললেন, আমাদের খুবই প্রিয় বন্ধু মুহসিন ভাই আসছেন তুমি তার সাথে দেখা করো। এ সংখ্যায় তার ইন্টারভিউ নাও।
মুহাম্মদ মুহসিন: হ্যাঁ, হ্যাঁ। হযরত আমাকেও বলে গেছেন। যাওয়ার সময় বলছিলেন সামান্য আপেক্ষা করুন। আহমদ আরমুগানের পক্ষ থেকে আপনার সাথে কিছু কথা বলবে।
আহমদ আওয়াহ: তো শুরুতেই আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানতে চাইবো।
মুহাম্মদ মুহসিন: আমি মধ্য প্রদেশের গোয়ালিয়র জেলার অধিবাসী। জন্মগ্রহণ করেছি ১৯৬২ সালের ১৯ এপ্রিল একটি ব্যবসায়ী পরিবারে। আমার বাবা খৈল-ভূষির বেপারী ছিলেন। তিনি জীবনে নানার ধরণের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছেন। তার ব্যবসা কয়েকবার মাটির সাথে মিশে গেছে। কিন্তু তিনি ছিলেন খুবই সাহসী এবং বীর চরিত্রের মানুষ। আমার ছোট দুই ভাই এবং একজন বোন আছে। আমি সায়েন্সে ইন্টারমিডিয়েট করার পর বি-ফার্মা করি। তারপর আমার বাবা আমাকে একটি মেডিকেল সেন্টার করে দেন। তারপর ঝাঁসিতে একটি শিক্ষিত পরিবারে আমার বিয়ে হয়। আমার স্ত্রী এমএসসি করার পর বিএও করে একটি কলেজে লেকচারার হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পর চাকরির কারণে নানা সমস্যা চলছিল। আল্লাহ তায়ালা সংকট অনেকটাই দূর করে দিয়েছেন। গোয়ালিয়রে তার বদলি হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ! এখন আমরা দুই পুত্র এবং এক কন্যার জননী।
আহমদ আওয়াহ: কিভাবে মুসলমান হলেন জানতে পারি?
মুহাম্মদ মুহসিন: আমার পাশেই একজন স্পেয়ার পার্টসের দোকানদার ছিলেন। তার নাম সাঈদ আহমদ। লোক যেমন চমৎকার তেমনি ধার্মিক মুসলমান। আমাদের মার্কেটে সাঈদ ভাই-ই ছিলেন একমাত্র মুসলমান দোকানদার। কেন যেন আমার সবচে’ বেশি ঘনিষ্ঠতা এবং সখ্যতা ছিল তার সাথে। তার শ্বশুরবাড়ির কেউ কখনও গোয়ালিয়র এলে আমার জন্য অবশ্যই কিছু না কিছু নিয়ে আসতো। একবার তার শ্বশুরবাড়িতে বিয়ের উৎসব হবে। তার শ্যালক আমাকে খুব জোর করে দাওয়াত করে। দিনটা ছিল আমাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সাঈদ ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে প্রোগ্রাম করলাম। সৌভাগ্যই বলতে হবে। আমরা যখন ভূপাল যাবো ঠিক তখনই সেখানে আপনার আব্বু মাওলানা কালিম সাহেবের একটি প্রোগ্রাম হওয়ার কথা। সাঈদ ভাই মাওলানাকে আগে থেকেই জানতেন। সেখানকার এক হাজী সাহেব যার হাতে এ পর্যন্ত শত শত মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে মূলত তার মাধ্যমেই সাঈদ ভাইয়ের আপনার বাবার সাথে পরিচয়। আপনার বাবার সাথে সাক্ষাতের জন্য সাঈদ ভাই ব্যাকুল ছিলেন। মাঝে মধ্যেই আমার কাছে তার কথা বলতেন। বার বার বলতেন চলুন একবার ফুলাত যাই। ভূপাল যাওয়ার পর সাঈদ ভাই বিয়ের উৎসব রেখে মাওলানা সাহেবের সাথে সাক্ষাতের জন্য ছোটাছুটি শুরু করলেন।
তার অন্তরে এখলাস ছিল। আলহামদুলিল্লাহ! সকালে এক ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মাওলানা সাহেবকে নাশতার দাওয়াত করেছিলেন। তার সাথে আসারও অনেক মাওলানা সাহেব ছিলেন। আমি এবং সাঈদ ভাই সেখানে পৌঁছলাম। সুযোগ বুঝে সাঈদ ভাই মাওলানাকে বললেন, এ হচ্ছে রমেশ সেন সাহেব। আমার খুবই চমৎকার প্রতিবেশী। শুধু প্রতিবেশী নন, আমার বড় ভাই। আমরা ফুলাত গিয়ে আপনার সাথে সাক্ষাৎ করবো ভাবছিলাম। আমাদের সৌভাগ্য, গোয়ালিয়র থেকে আজই একটি বিয়ে উপলক্ষে ভূপালে এসেছি। এখানে এসে জানতে পারলাম, আপনার প্রোগ্রাম রয়েছে। তারপর বিয়ে শাদীর কথা ভুলে গেছি। গতকাল সকাল থেকে ছোটাছুটি শুরু করেছি। আজ আল্লাহ তায়ালা আমাদের উদ্দেশ্য সফল করেছেন। আপনি তার সাথে একটু কথা বলুন।
মাওলানা সাহেব সাঈদ ভাইয়ের কথা শুনে খুবই খুশি হলেন। বললেন, ফুলাত তো অবশ্যই আপনাদের আসতে হবে। আর রমেশ সাহেব কেবল আপনার ভাই হবেন কেন, তিনি আমাদেরও ভাই। আমাদের রক্তের ভাই। আমাকে বললেন- কী বলেন রমেশ সাহেব! আমরা কি এক মাতা-পিতার সন্তান নই? আমি বললাম, জি হ্যাঁ, কোনো সন্দেহ নেই।
মাওলানা সাহেব বললেন- এক মাতা-পিতার সন্তানকেই তো রক্তের সম্পর্কের ভাই বলা হয়। তারপর মাওলানা সাহেব বাড়ির মালিক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে আলাদা কোনো একটি ঘরে একটু জায়গা করে দিতে বললেন। উপস্থিত সকলেই তখন সমস্বরে বলে উঠলো আপনি এখানেই কথা বলুন। আমরা বাইরে চলে যাচ্ছি। তারা সকলেই চলে গেলো।
মাওলানা সাহেব আমাকে বললেন, রমেশ সেন সাহেব! আপনি আমাদের রক্তের ভাই। আপনি আমাকে একজন ভালো মানুষ মনে করে ভালোবেসেই আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। এখন আমার কর্তব্য হলো আপনার জন্য সবচে’ বড় প্রয়োজন এবং সবচে’ কল্যাণকর যে কথাটি সেটা আপানাকে অবশ্যই বলবো। তাছাড়া আপনার জন্য সবচে’ বড় ভয়ের বিষয়টি সম্পর্কেও আপনাকে সতর্ক করে দেয়া আমার কর্তব্য। দেখুন, কোনো ব্যক্তি যখন কোনো দেশে বসবাস করে অথচ সে দেশের শাসক মানে না, সেখানকার সংবিধান মানে না, সেখানকার আইন মানে না, তখন তাকে বিদ্রোহী এবং গাদ্দার বলা হয়। এ কারণেই কোনো দেশের কোনো পদে যখন কেউ আসীন হতে চায়, তখন তাকে সে দেশের শাহী ফরমান এবং সংবিধানের প্রতি বরং সংবিধানের প্রতিটি ধারার প্রতি পূর্ণ আস্থা এবং তা মেনে চলার শপথ নিতে হয়। আমাদের সামনে বিশাল পৃথিবী, এই বিশাল সৃষ্টিজগতের একমাত্র মালিক ও বাদশাহ হলেন এক অদ্বিতীয় আল্লাহ। তাঁর চূড়ান্ত ও সর্বশেষ এবং অন্তিম পয়গম্বরের মাধ্যমে এই সংবিধান পাঠিয়েছেন।
প্রতিটি মানুষের জীবনে সবচে’ বড় কর্তব্য হলো মহান সেই একক ও অদ্বিতীয় সত্তা প্রেরিত সর্বশেষ সংবিধানকে মেনে নেয়ার শপথ গ্রহণ করা। যদি কেউ এই শপথ না নেয়, তাহলে সে বিদ্রোহী এবং গাদ্দার। মালিকের জমিনে থাকার, জমিনে চলাচল করার, তাঁর সৃষ্টিজগতের কোনো কিছু ভোগ করার অধিকার এই বিদ্রোহীর নেই। এমনকি তার বাতাসে শ্বাস গ্রহণের অধিকারও নেই। যে বিদ্রোহী ও গাদ্দার এই শপথ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাবে তার এই বিদ্রোহের কারণে তাকে মৃত্যুর পর অনন্তকাল নরকে থাকতে হবে। সুতরাং রমেশ ভাই! এই যে শপথ একেই বলা হয় কালেমায়ে শাহাদাত। আমি আপনাকে এখন কালেমায়ে শাহাদাত পড়াতে চাই। মালিককে হাজির নাজির মনে করে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অপরাধ থেকে তওবা করে তাঁর পাঠানো সর্বশেষ সংবিধান মেনে চলার অঙ্গীকার হিসেবে খাঁটি মনে দুই লাইনের এ কালেমাটি পড়ে নিন।
তারপর তিনি আমাকে কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করান। আমি কালেমা পাঠ করলাম। কালেমা পাঠ করার পর বললেন- যে ব্যক্তি খাঁটি মনে এই কালেমা পাঠ করে তাকেই মুসলমান বলা হয়। আল্লাহর শোকর! আপনি এখন মুসলমান। এখন আপনাকে পবিত্রতা অর্জনের নিয়ম শিখতে হবে, নামায শিখতে হবে এবং ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হবে। আপনি যখন ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করবেন তখন জানতে পারবেন সাইদ সাহেব আপনার প্রতি কী অনুগ্রহ করেছেন। তিনি ভাই হিসেবে তার যথার্থ হক আদায় করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মূল্য তো এই পৃথিবীতে উপলদ্ধি করা সম্ভব নয়। এর যথার্থ উপলদ্ধি হবে মৃত্যুর পর।
নাস্তার ব্যস্ততা ছিল। সকলকে ডাকা হলো। নাস্তার ফাঁকেই মাওলানা সাহেব কিছু বইপত্রের নাম লিখে দিলেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে ‘আপকি আমানত’ পুস্তিকাটি দিলেন। নিয়মিত পাঠ করার জন্য ‘ইয়া হাদী ইয়া রহীম’ এবং আরও কিছু শব্দ লিখে দিলেন। আমি মাওলানা সাহেবকে বললাম, যে দুই লাইন আমাকে পাঠ করালেন সেটাও কি কোথাও পাওয়া যাবে? তারপর আমি বললাম, কালেমা পাঠ করার পর আমার কাছে মনে হয়েছে যেন আমি কোনো শৃঙ্খলে বাঁধা ছিলাম। আমি বাঁধনমুক্ত হয়েছি, আমার মাথার উপর হাজার মণের একটা বোঝা ছিল। বোঝাটি সরে গেছে। নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছিল। আমি নিজেকে তখন পরিপূর্ণ স্বাধীন অনুভব করছিলাম।
আহমদ আওয়াহ: আব্বুই কি আপনার নাম মুহাম্মদ মুহসিন রেখেছেন?
মুহাম্মদ মুহসিন: না, মাওলানা সাহেব আমাকে নাম বদলাতে বলেননি। তবে আইনি কাগজপত্র কিভাবে তৈরি করতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। অনেক দিন পর মুহসিনে ইনসানিয়ত বইটি পড়ে আমি খুবই আলোড়িত হয়েছিলাম। তারপর আমি নিজেই আমার নাম মুহসিন রাখবো বলে আগ্রহ প্রকাশ করি। তখন সাঈদ ভাই আমার নাম রেখে দেন মুহাম্মদ মুহসিন।
আহমদ আওয়াহ: তারপর বাড়ি ফিরে পরিবারের লোকদের এই কাহিনী বলেছেন?
মুহাম্মদ মুহসিন: ভূপাল থেকে আমরা গোয়ালিয়র গেলাম। আমি ভেবেছিলাম, গাদ্দারী এবং বিদ্রোহের অভিশাপ থেকে বেরিয়ে এসে মালিককে মেনে চলার শপথ নেয়া প্রতিটি মানুষেরই কর্তব্য। গোয়ালিয়র ফেরামাত্র আমি আমার স্ত্রীকে বিষয়টি জানাই। তাকেও কালেমা পড়তে বলি। আমি চিন্তা করিনি, আমার এই কথায় সে এতটা চটে যাবে। সে সঙ্গে সঙ্গে পুরো পরিবারকে ডেকে আনে। সে এতটাই ক্ষুব্ধ হবে আমি তা কখনও কল্পনা করিনি। বাধ্য হয়ে আমি পুরো পরিবারের সামনে ক্ষমা চাই। কথা দেই, তোমাদের সাথে হিন্দুধর্ম নিয়েই থাকবো। কিন্তু তারপর যখনই আমি একাকী হতাম, আমার অন্তর আমাকে চেপে ধরতো। আমার মন আমাকে চাবকাতে থাকতো। বলতো সারা জাহানের মালিকের বিদ্রোহী হয়ে কাফের এবং মুশরিক হয়ে মালিকের পৃথিবীতে নির্ভয়ে বসবাস করছো। আর তুমি কত ভীতু! এরচেয়ে বরং মরে যাওয়া ভালো। মনে হতো, কেউ যেন ভেতর থেকে আমাকে প্রশ্ন করছে একমাত্র আল্লাহই কি এই সমগ্র জাহানের মালিক নন? কুরআন কি আল্লাহর সত্য বাণী নয়; হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মতো সত্য ও আদর্শ মানুষ কি এই পৃথিবীতে আরেকজন সৃষ্টি হয়েছে? বেহেশত দোযখ কি সত্য নয়? আচ্ছা দেবদেবী কি কোনো পূজার উপযুক্ত? মূর্তিশালার সবগুলো দেবতা মিলে কি একটি মাছি বানাতে পারবে? কুফর ও শিরকের পরিণতি কি চিরস্থায়ী জাহান্নাম নয়? প্রশ্নগুলো সবসময় আমাকে তাড়া করে ফিরতো, আমার ভেতরে অগ্নিলাভার সৃষ্টি হতো। মাঝে মধ্যে মনে হতো, পৃথিবীর সকল পূজারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।
আহমদ আওয়াহ: এই সময়টাতে ইসলাম সম্পর্কে আপনার পড়াশোনা চালু ছিল?
মুহাম্মদ মুহসিন: প্রতিদিন আমি ইসলামকে জানার জন্যে একটি করে বই পড়তাম। যতই পড়তাম ততই আমার তৃষ্ণা বেড়ে যেতো। মূলত এই পড়াশোনাই আমার ভেতরে প্রশ্নগুলো জন্ম দিয়েছিলো।
আহমদ আওয়াহ: তারপর কী হলো?
মুহাম্মদ মুহসিন: যা হওয়ার কথা তাই হলো। আমার ভেতরটাই আমাকে বিদ্রোহী করে তুললো। আমি সকল ভগবান এবং সকল পূজারীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়ে বসলাম। অঙ্গীকার করলাম এক খোদা এবং তাঁর আনুগত্যেই জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে যাবো। আমি আমার স্ত্রী এবং পরিবারকে জানিয়ে দিলাম, আমি মুসলমান। মুসলমান হিসেবেই বেঁচে থাকবো। মুসলমান হিসেবেই মৃত্যুবরণ করবো। আমি তোমাদের চাপে আত্মীয়তার টানে ইসলামের ক্ষুদ্র কোনো বিধানকেও ছাড়তে পারবো না।
আহমদ আওয়াহ: আপনার এ কথায় তারা ক্ষেপে যায়নি?
মুহাম্মদ মুহসিন: ক্ষেপবে না কেনো? খুব ক্ষেপেছে। প্রতিদিনই খান্দানের লোকজন জমা হতো। আমাকে ডাকা হতো। বুঝানোর চেষ্টা হতো। বিরক্ত হতো, ক্ষুব্ধ হতো। প্রথম দিকে ডাকার সাথে সাথেই আমি চলে যেতাম। অবশেষে জানিয়ে দিলাম, আমি আর পঞ্চায়েতের ডাকে কোথাও যাবো না। পরিবারের লোকেরা আমার বিরুদ্ধে নানা স্কীম তৈরি করলো। আমি আদালত থেকে ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কিত কাগজপত্র সংগ্রহ করলাম। আমার বিরুদ্ধে অনেক মামলা হলো, ছয়বার আমাকে বিষ খাওয়ানোর চেষ্টা হলো। কয়েকজন গুন্ডা দিয়ে হত্যা করার চেষ্টা হলো। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। ফোনে হযরত মাওলানার সাথে পরামর্শ করলাম। তিনি বললেন, এই পরিস্থিতিতে আপনাকে গোয়ালিয়র ছেড়ে দেয়াই ভালো। দীনের জন্য দেশ ত্যাগ করাও একটি মহৎ আমল। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তায়ালা আপনাকে এর প্রতিদান দিবেন। কয়েক দিনের জন্য আমি দিল্লি চলে এলাম। এখানে এসে সাময়িক বিরোধিতার হাত থেকে রক্ষা পেলাম। কিন্তু এখানে অন্য ধরনের কিছু প্রতিকূলতার মুখোমুখি হলাম। গোয়ালিয়র থেকে যে পরিমাণ অর্থকড়ি সাথে এনেছিলাম তা ফুরিয়ে গেলো। এখানে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে পারলাম না। একটি কোম্পানীতে এমআর এর চাকরি পেলাম। কিছুটা স্বস্তি পেলম। তারপর হযরতের এক বন্ধু আমাকে রাজস্থান নিয়ে গেলেন। এখন রাজস্থানেই আছি। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
আহমদ আওয়াহ: এই যে একের পর এক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হলেন এতে কি ভেঙ্গে পড়েন নি?
মুহাম্মদ মুহসিন: আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। তিনিই ধরে রেখেছেন। তবে পরিবার এবং অমুসলিমদের পক্ষ থেকে যে সব নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছি, তাতে সাহস বেড়েছে। কখনোই ভেঙ্গে পড়িনি। অবশ্য খান্দানী মুসলমানদের পক্ষ থেকে চারপাঁচ বার এমন এমন কষ্টের শিকার হয়েছি, শয়তান একেবারে ধর্ম ত্যাগের দিকেই ঠেলে দিয়েছিল। তারপরও আল্লাহর শোকরিয়া! হযরত মাওলানার মতো আল্লাহর রহমতের জীবন্ত নমুনা কুফরের হাত থেকে বেঁচে থাকার উপর ফেরেশতা হিসেবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। সত্যকথা হলো, আমি তো ঈমান এবং ইসলামের উপযুক্ত ছিলাম না। আল্লাহ তায়ালা দয়া করেছেন। সাঈদ ভাইকে হেদায়েতের ফেরেশতা বানিয়ে আমাদের প্রতিবেশী হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনিই দয়া করে মূলত আমাকে হেদায়েত দান করেছেন। জীবনে এত বেশি ও কঠিন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছি যদি আমি আমার শক্তি দিয়ে এর মোকাবেলা করতে চেষ্টা করতাম, তাহলে অবশ্যই আমাকে ইসলাম ছেড়ে চলে যেতে হতো। সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার রহমত ছিল। বছরের পর বছর তিনিই দীনের উপর অবিচল রেখেছেন।
আহমদ আওয়াহ: এ সম্পর্কে বিশেষ কোনো ঘটনা শোনাবেন?
মুহাম্মদ মুহসিন: মাওলানা আহমদ সাহেব! ঈমানের মতো মূল্যবান ধন আল্লাহ তায়ালা যেভাবে দয়া করে আমাকে দান করেছেন, এর বিপরীতে এসব কষ্ট কিছুই না। মাওলানা সাহেব আমাকে যখন কালেমা পড়িয়েছিলেন তখন কিন্তু আমি ধর্ম পরিবর্তনের নিয়তে কালেমা পড়িনি। কালেমা পড়ার পর আমি যখন অনুভব করলাম, আমি যেন এক কঠোর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছি এখন আমি এ পথে যেসব মুসিবতের মুখোমুখি হয়েছি তা যদি বলে বেড়াই আমার কাছে মনে হয় কি এটা যেন আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা। তাই এসব ঘটনা বলতে লজ্জা হয়। তাছাড়া এসব বিপদ আমার ঈমানকে শক্তিশালী করেছে এবং উজ্জ্বল করেছে।
আহমদ আওয়াহ: তারপরও এক আধটা বলুন।
মুহাম্মদ মুহসিন: এ বিষয়ে আমাকে মাফ করবেন। এসব ঘটনা ছিল আমার জন্য নিয়ামত। আলমহামদুলিল্লাহ! এখন আল্লাহ তায়ালা আমাকে শান্তি ও নিরাপত্তার নেয়ামতের মধ্যে রেখেছেন। । আমার স্ত্রী এখন আয়েশা হয়ে আমার সাথে জীবন-যাপন করছে। আমার দুই ছেলে এখন মুহাম্মদ হাসান এবং মুহাম্মদ হোসাইন। আমার কন্যা এখন ফাতেমা। আল্লাহ তায়ালা আমার পুরো পরিবারকে হেদায়েত দিয়েছেন। এ পথে আমি যে কষ্ট পেয়েছি তা কি এই নেয়ামতের তুলনায় অতি তুচ্ছ নয়! তারপরও যেসব কষ্টে আমি ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছি তা এখন কষ্ট হিসেবে আলোচনা করা চরম ক্ষুদ্রতা এবং অকৃতজ্ঞতার পরিচায়ক নয়?
আহমদ আওয়াহ: শুনেছি, এ বছর ওমরায় গিয়েছিলেন?
মুহাম্মদ মুহসিন: আলহামদুলিল্লাহ। আমি আমার স্ত্রী এবং সন্তানদেরসহ ওমরা করেছি।
সেখানে গিয়েই মূলত পরিবারের সবাই যেন মুসলমান হয় এর পূর্ণ যন্ত্রণা মনের সধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া ওমরা পালন করার পর নিজেদের মধ্যে দীনের প্রতি আগ্রহও বেড়েছে।
আহমদ আওয়াহ: আপনার খান্দানের সাথে যোগাযোগ আছে?
মুহাম্মদ মুহসিন: ওমরার পর যোগযোগ শুরু করেছি। মনে হচ্ছে হারামাইন শরীফাইনে যে দুআ করেছি তা কবুল হতে শুরু করেছে। আমার এক চাচাতো ভাই আমার সাথে দেখা করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জুলাইয়ের দিকে আসতে বলেছি। সে একজন সরকারি বড় কর্মকর্তা। সে যদি মুসলমান হয়ে যায় তাহলে আমাদের পুরো পরিবারকেই ভাবতে হবে। আমি আমার এই ভাইকে আপকি আমানত এবং ইসলাম এর পরিচয় বই দুটি দিয়েছি। সে পড়েছে।
আহমদ আওয়াহ: আরমুগানের পাঠকদের উদ্দেশ্য কিছু বলুন!
মুহাম্মদ মুহসিন: ইসলাম হলো মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। একজন তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির কাছে যেমন ঠান্ডা পানি অতীব প্রার্থনীয় একটি বিষয়। প্রতিটি মানুষের জন্য ইসলামও ঠিক তেমন। একজন তৃষ্ণার্ত মানুষ। তৃষ্ণায় তাঁর ঠোঁট-জিহ্বা-কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে। আপনি যদি তাঁর মুখের কাছে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি তুলে ধরেন তাহলে সে ঠেলে দিবে না। বরং টেনে নেবে। ঠিক তেমনিভাবে এখন প্রয়োজন হলো ইসলামকে তৃষ্ণার্তদের মুখের কাছে তুলে ধরা। পুরো পৃথিবী কুফুর-শিরকের জালে আটকে পড়ে আছে। পুরো পৃথিবী এখন শিরক ও কুফরের পাথরের নীচে চাপা পড়ে। আজ তাদের জন্য চাই মুক্তি। ইসলামের বিরুদ্ধে নানা প্রোপাগান্ডা হচ্ছে। আমাদের উচিত, এই প্রোপাগান্ডাকে উপেক্ষা করে পৃথিবীর সামনে ইসলামকে তুলে ধরা। আরমুগানের পাঠকদের কাছে এটাই আমার অনুরোধ।
আহমদ আওয়াহ: মুহসিন ভাই! আপনাকে অনেক শোকরিয়া ভেবেছিলাম আজ আপনার কাছ থেকে যে সব কষ্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন তার বিবরণ শুনবো। সে যাক, পরে কখনও শুনবো ইনশাআল্লাহ!
মুহাম্মদ মুহসিন: আহমদ ভাই আমাকে মাফ করুন। এখন আমি যে অবস্থায় আছি, সত্যি বলতে কী, আমি যদি সে সব প্রতিকূলতার কথা বলি যে প্রতিকূলতা আজ আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে- তাহলে সেটা হবে অকৃতজ্ঞতা। দুআ করুন, আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদেরকে ইসলামের মতো মহান নেয়ামতের মর্যাদা বোঝার তাওফিক দান করেন। আমাদের যেন দীনের উপর অটল ও অবিচল রাখেন।
আহমদ আওয়াহ: দীনি শিক্ষা অর্জনের জন্য কোনো চেষ্টা করেছেন?
মুহাম্মদ মুহসিন: আলহামদুলিল্লাহ! প্রথম দিন থেকেই ইসলাম সম্পর্কে জানার একটা আগ্রহ আমার মধ্যে উপলদ্ধি করে আসছি। এরই মধ্যে কুরআন শরীফ পড়া শিখেছি। উর্দু মোটামুটি ভালোই শিখেছি। কিছুটা লিখতে পারি। আমার পরিবারের সকলেই এখন কুরআন শরীফ পড়ছে। আমরা অঙ্গীকার করেছি, প্রথম ধাপেই আমাদের এতটুকু কুরআন শরীফ পড়া শিখতে হবে যেন হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণে প্রতিদিন এক মানযিল করে পড়তে পারি। তাবলীগে গিয়ে শুনেছিলাম আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অভ্যাস ছিল, তিনি সাত দিনে একবার কুরআন শরীফ খতম করতেন। সেই থেকেই আমি আমার স্ত্রী এবং আমার সন্তানরা এক সাথে শপথ নিয়েছি আমরাও একই পদ্ধতিতে প্রতি পাঁচ কি সাত দিনে একবার কুরআন শরীফ অবশ্যই খতম করবো। আশা করছি চলতি বছরের শেষ নাগাদ অথবা জানুয়ারি পর্যন্ত অবশ্যই আমরা প্রতিদিন এক মনযিল করে তেলাওয়াত করার উপযুক্ত হয়ে যাবো। এখনও প্রতিদিন ফরজ নামাযের পর আমরা পাঁচজন যত্মসহ কুরআন তেলাওয়াত করি। তারপর কুরআন শরীফের কিছু তরজমাও মুখস্থ করি।
আহমদ আওয়াহ: মাশাআল্লাহ! খুবই চমৎকার। আল্লাহ তায়ালা বরকত দান করুন। আব্বুর কাছে শুনেছি, আপনি একজন মুস্তাজাবুদ দাওয়াত। আল্লাহ তায়ালা আপনার সব দুআই কুবল করেন। এ সম্পর্কে কোনো ঘটনা বলবেন কি?
মুহাম্মদ মুহসিন: ভাই আহমদ সাহেব! আল্লাহ তায়ালা তো প্রতিটি মুসলমান বরং প্রতিটি মানুষের সাথেই এ ওয়াদা করেছেন, সুতরাং প্রতিটি মানুষই তো মুস্তাজাবুদ দাওয়াত। প্রয়োজন শুধু আল্লাহ তায়ালাকে সব কিছুর নিয়ন্ত্রক ও একমাত্র মালিক মনে করে তাঁর কাছে হাত পাতা। এটা ভিন্ন কথা যে, কারও ক্ষেত্রে হয়তো এসব কথা মানুষের মধ্যে প্রচার পায়, আবার কারও ক্ষেত্রে পায় না। আমার ধারণা দুনিয়াতে এমন মানুষ নেই যার দুআ আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন নি। কেউ যদি আল্লাহ তায়ালার কাছে পূর্ণ একীন ও বিশ্বাসের সাথে দুআ করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তা কবুল করবেন। আল্লাহর কোনো বান্দা যদি আল্লাহ তায়ালার কাছে পূর্ব থেকে নয়, পশ্চিম দিক থেকে সূর্য ওঠনোর আবদারও করে দয়াময় মালিক তার কথাও রাখবেন। প্রয়োজন হলো পূর্ণ আস্থার সাথে তাঁর কাছে হাত পাতা। হ্যাঁ, আল্লাহ তায়ালার দেয়া নিয়মের বাইরে কোনো কিছু চাওয়া সঙ্গত নয়। এটা ভিন্ন কথা। তবে আমার বিশ্বাস বান্দা যদি চায়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা বান্দার কথা ফেলবেন না। এই যে আমার স্ত্রী মুসলমান হলো, আমার সন্তানরা আমার কোলে ফিরে এলোÑ যে নারী আমাকে কয়েকবার বিষ পান করাতে চেয়েছে সে পাক্কা মুসলমান হয়ে আমার ঘরে ফিরে আসাটা কি পশ্চিম দিক দিয়ে সূর্য ওঠার চাইতে কম?
অসহায় বান্দা যখন পরম বিনয়ের সাথে মহান মালিকের কাছে ভিখারির মতো শূন্য হাত তুলে বসে, মালিক তখন সেই হাত অবশ্যই পূর্ণ করে দেন।
আহমদ আওয়াহ: হ্যাঁ, বিষয় তো তাই। আসলে চাওয়ার লোক নেই। আপনি বলেছেন, খান্দানী মুসলমানদের দ্বারা।
মুহাম্মদ মুহসিন: ভাই আহমদ সাহেব! সে একই কথা হলো। এসব কথা আলোচনা করা মালিকের প্রতি অকৃতজ্ঞতা মনে হয়। মানুষ খুবই দুর্বল। মুখ থেকে একটা কথা বেরিয়ে গেছে। আমাকে মাফ করবেন। আমি তো আমার মালিকের অপার অনুগ্রহের মধ্যে ডুবে আছি। ঈমান যখন নসীব হয়েছে, তখন আর কিসের কষ্ট কিসের প্রতিকূলতা? আমি আমার আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ। দুআ করুন, আল্লাহ তায়ালা যেন আমাকে অকৃতজ্ঞতা থেকে রক্ষা করেন। আমীন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে
মাও. আহমদ আওয়াহ নদভী
মাসিক আরমুগান, জুলাই- ২০০৯