শনিবার, ২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
সবুজ বাংলার পথেপ্রান্তরে… /৩৭
শাহপরীর দ্বীপে যাওয়ার পর স্থানীয় যাদের সাথে পরিচয় হয়েছিল, তাদের কারো কারো কাছ থেকে এমন আহ্বান পেলাম যে, টাকার অভাবে ওপারে আটকে থাকা কিছু মানুষকে ট্রলার ভাড়া দিয়ে পার করে আনা যেতে পারে এটা অনেক বড় একটা খেদমত হবে। মানুষের করুণ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে নিজেদের যৎসামান্য সামর্থ্যরে আলোকে আমরা এমন একটা উদ্যোগ নিলাম। তবে কার মাধ্যমে ট্রলার ভাড়া করা হবে, এটা ছিল একটা অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়। তাছাড়া আমাদের ভাড়ায় যাদেরকে পার করে আনা হবে, সেটাও কতটুকু অভাব ও দারিদ্রের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করা হবে, সে বিষয়ে পরিপূর্ণ এতমিনানের কোনো সুযোগ ছিল না। তবুও হুসনেজন(সুধারণা)র ভিত্তিতে আমরা একটি ট্রলারে দুই ট্রিপে বেশ কিছু আটকে থাকা অভাবী রোহিঙ্গাকে পার করিয়ে আনার উদ্যোগ নিলাম। আমাদের সাথে ট্রলার মালিকের চুক্তি ছিল, প্রতি ট্রিপে বিশজন করে বড় মানুষ আর সমপরিমাণ দশ-বারো বছরের কম বয়সী শিশুদেরকে পার করে আনবে এবং অবশ্যই তাদের কাছ থেকে কোনো ভাড়া রাখবে না। একটা ট্রলার এপার থেকে ওপারে গিয়ে যাত্রী নিয়ে ফিরে আসতে বড়জোর ঘণ্টাখানেক লাগে। এতটুকু সময়ের ট্রলার প্রতি আমাদের ভাড়া গুণতে হলো পঞ্চাশ হাজার টাকা। স্বাভাবিক নিয়মে এতটুকু সময়ের জন্য দুই থেকে তিন হাজার টাকা ভাড়া হতে পারে। অথচ সেখানে আমরা পঞ্চাশ হাজার টাকা ট্রিপ প্রতি পরিশোধ করলাম। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, এটা বেশ সস্তা হয়েছে। নাফ নদী পাড়ি দিতে জনপ্রতি আড়াই হাজার টাকা আর সঙ্গে থাকা শিশুর ভাড়া মাফ, এটা বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম। এটা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সীমান্তে শিথিলতা আনয়নেরর পরের অবস্থা। প্রথম দিকে নাকি নাফ নদী পার করিয়ে দেওয়ার জন্য জনপ্রতি বিশ/ত্রিশ হাজার টাকা করে উসুল করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে, বিশজন যাত্রী পার করতে যেখানে ট্রলার ভাড়া হতে পারত দুই/তিন হাজার টাকা, সেখানে তিন/চার লক্ষ টাকা আদায় করা কতটা যুক্তিসঙ্গত? আবার এমন অভিযোগও চাউর আছে যে, নির্বাসিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ পূর্ণ বা আংশিক ভাড়া পরিশোধে ব্যর্থ হলে ট্রলার মাঝিরা তাদেরকে আটকে রেখেছে, মূল্যবান সম্পদ কেড়ে নিয়েছে, নারীদের কাছ থেকে তাদের যৎসামান্য স্বর্ণালংকার পর্যন্ত ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এত বেশি ভাড়া উসুলের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে জবাবে তারা হিসেব বুঝিয়ে দেয় যে, কোথায় কোথায় কী পরিমাণ মাশোহারা তাদেরকে ট্রলার প্রতি গুণতে হয়। মোটকথা, সব মিলিয়ে একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, যারা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
আমরা যখন নাফ নদীর জেটিতে গিয়েছিলাম, তখন নদীর তীরে বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েকটি আগুনে পোড়া ট্রলার দেখতে পেয়েছি। পোড়ানোর কারণ অনুসন্ধান করে পরস্পরবিরোধী দুই রকম তথ্য পেয়েছি। কেউ কেউ বলছে অবৈধপথে যাত্রী পারাপার করার অপরাধে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমান্তরক্ষী কোষ্টগার্ডের সদস্যরা এগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝেই তারা এমন করে। আর তখনই পারাপারের খরচ বেড়ে যায়। আমরা শুনলাম, আগের রাতে নয়টা ট্রলার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সীমান্ত এখন গরম। ট্রলার পোড়ানো সম্পর্কে দ্বিতীয় যে তথ্যটি পেলাম তা হলো, অসহায় রোহিঙ্গাদের ওপর দস্যুমাঝিদের অত্যাচার, তাদেরকে আটকে রেখে নির্যাতন আর তাদের মূল্যবান সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ। সীমান্তরক্ষীদের কাছে দায়েরকৃত এই জাতীয় অভিযোগের সত্যতা পেয়েই তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে। আসলে ভালো-মন্দ মিলিয়েই যেমন মানুষ, তেমনি মাঝিদের মাঝেও ভালো-মন্দ আছে। আবার সীমান্তরক্ষীদের মধ্যেও অনুরূপ। আমরা শাহপরীর দ্বীপসহ সীমান্ত এলাকায় বিচরণ করে উপলব্ধি করেছি যে, নির্যাতিত নির্বাসিত রোহিঙ্গাদেরকে বুকে জড়িয়ে ভালোবেসে কাছে টেনে নেওয়ার যেমন মানুষের অভাব নেই, তেমনি সুযোগ বুঝে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার মানবরূপী দানবেরও অভাব নেই।
ট্রলার মালিকের সাথে চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের পার করিয়ে আনলে আমাদেরকে সংবাদ দেয়া হলো তাদেরকে এস্তেকবাল করার জন্য। প্রথম ট্রিপের লোকদেরকে গ্রহণ করতে স্থানীয় একজনকে সঙ্গে করে আমি গেলাম। নদীর তীরে নয়, সমুদ্রের তীরে। অর্থাৎ সোজা পথে নদী পার না হয়ে অনেকটা ঘুরে গিয়ে সমুদ্রের তীরে এসে নোঙ্গর করল ট্রলার। একে একে নেমে এল রোহিঙ্গা মুহাজিরদের যাত্রীদল। মৃত্যুপুরী থেকে জীবনটুকু নিয়ে সদ্য হিজরত করে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখা মানুষগুলোকে কাছ থেকে দেখলাম। পুর্বপুরুষের ভিটেমাটি, নিজের জীবনের তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার সব পেছনে ফেলে পরদেশে পরবাসে এল যে মানুষগুলো, পরদেশে তাদের পয়লা কদম রাখার মুহূর্তটুকু হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে চাইলাম। তাদের মুখের দিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। মনে হলো, পরিস্থিতির ভয়াবহতায় তারা অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে। জীবনের কঠিন যুদ্ধ মানুষকে কতটা ভাবলেশহীন করে দিতে পারে, পারে আবেগশূন্য করে দিতে, বঙ্গোপসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে আমি অনুভব করেছি তা। যৎসামান্য ঘরোয়া তৈজসপত্র নিয়ে দেশের মাটি ছেড়ে এসেছে তারা। সমুদ্রতীরের হাটু পানিতে নেমে হেঁটে হেঁটে আসছিল নারী শিশু আবাল বৃদ্ধ। সর্বশেষে নামল শশ্রুমন্ডিত এক যুবক। গতর তার খালি। নিজের বৃদ্ধা মাকে কোলে করে ধীরকদমে নেমে এল যুবক। কোলে-কাখে চড়তেও বৃদ্ধার কষ্টে মুখ কুঁকড়ে আসছিল। যুবক তার মাকে সমুদ্রতীরের বালুর উপর রেখে আবার ফিলে গেল মাল-সামানা আনতে। এতটুকু সময় নিজের শরীরের ভার বইতে পারল না বৃদ্ধা মা। শুয়ে পড়ল ভেজা বালুর সমুদ্র সৈকতে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের এ বালুতে কত মানুষ শুয়ে থাকে রৌদ্রস্নান করতে! তবে বৃদ্ধার এ শয়নের ভঙ্গি ছিল বড় করুণ! শরীরে এতটুকু শক্তি নেই। হাসপাতালের কোমল বিছানায় হওয়ার কথা যার আশ্রয়, হিংস্র হায়েনাদের তাণ্ডবে আজ সে দেশান্তরের পথিক!
ট্রলারের মাঝি আমাদের শুনিয়ে শুনিয়েই মুহাজির যাত্রীদেরকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোঁয়ারার কাছ থন কোনো টাকা পয়সা লাইয়ি?’ তারা জবাব দিল ‘ন, ন’। মুহাজিরদেরকে বহন করার জন্য গাড়ি ঠিক করা ছিল পূর্ব থেকেই। নির্ধারিত গাড়িতে গিয়ে তারা উঠল। আমার সঙ্গী আমাকে বলল, চলুন আমরা ভিন্ন দিকে চলে যাই। এদের সঙ্গে যাওয়া যাবে না। কারণ? কারণ হলো, আপনার প্রতি নজর পড়ে যাবে। আপনাকে আবার আদমপাচারকারী হিসেবে হয়রানীর শিকার হওয়া লাগতে পারে। প্রাচীন আমলের জিপগাড়িকে মোডিফাই করে তৈরি করা টেম্পু রোহিঙ্গা মুহাজিরদের নিয়ে ভট ভট করে চলে গেল আমাদের দৃষ্টির আড়ালে। আর আমরা চললাম পায়ে হেঁটে। বেশ অনেক দূর পথ। শাহপরীর দ্বীপটাকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার সুযোগ হলো। সকালের নাস্তা করেছিলাম না বিধায় বাজারের পথ ধরে চলছিলামÑ বাজারে গিয়ে নাস্তা করব বলে। পথে নজরে পড়ল একটি ছোট্ট মক্তব-মাদরাসা। দেখলাম, সেখানেও রাত্রে আগমনকারী অনেক রোহিঙ্গা মুহাজির আশ্রয় পেয়েছে। আর দেখলাম সরকারিভাবে নির্মিত দুর্গত আশ্রয় কেন্দ্রেও কিছু মুহাজির উঠেছে। এগুলো দেখতে দেখতে বাজারে এসে পৌঁছে গেলাম। নাস্তার জন্য ঢুকে পড়লাম এক হোটেলে। গ্রামীণ পরিবেশের ছিমছাম হোটেলে আগে থেকেই কিছু মানুষ বসা ছিল। নাস্তার টেবিলের আলোচ্য বিষয় ছিল রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রসঙ্গ। জানলাম এক বিস্ময়কর তথ্য। শাহপরীর দ্বীপের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই নাকি আশ্রয় পেয়েছে রোহিঙ্গারা। বিভিন্ন পরিচয়, ব্যবসায়িক সম্পর্ক, আত্মিয়তাসহ নানা বন্ধনে তারা পরস্পর আবদ্ধ। তাছাড়া মানুষের প্রতি নিখাঁদ মমত্ব আর দায়িত্ববোধ তো আছেই। তবে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আর নজরদারীর কারণে সেখানে স্থায়ী হতে পারছে না রোহিঙ্গারা। কিছুদিন থাকার পর অধিকাংশ রোহিঙ্গাদেরকে শরণার্থীক্যাম্পের পথই ধরতে হচ্ছে। বাড়তি জনবলের চাপ এই দ্বীপাঞ্চলের সব কিছুর ওপরই পড়েছে। দোকান-পাটে বেচা-কেনা বেড়েছে বহুগুণ। সকালবেলা হোটেলগুলোতে পরাটার জন্য দীর্ঘ লাইন লেগে যাচ্ছে। কথাগুলো শুনে ভালো লাগল… চলবে ৷
সৌজন্যে:
মাসিক রাহমানী পয়গাম