শনিবার, ২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা রবিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
মসজিদ বনাম এনজিও স্কুল। আমাদের উদাসীনতাই তাদের সাফল্য।
******************************************************************
১. গত দু’দিন যাবত আমাদের কার্যক্রম চলছে কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের সর্বশেষ পাহাড়গুলোতে। মূল সড়ক থেকে প্রায় ৭ কি.মি. ভিতরে। পথিমধ্যে পুরাতন ক্যাম্প অতিক্রমকালে কয়েকজন হতাশাগ্রস্ত দ্বীনদার ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত হয়। তারা নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছেন। কথা বলে জানা যায়, আশপাশের কয়েক হাজার লোকের নামাজের জায়গা এটি। যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। অথচ গোঁছা পর্যন্ত কাঁদা থাকায় বুঝার কোন উপায় নেই। তারা একটি ট্রিপলের চালা টাঙানোর কথা ভাবছেন। নতুবা নামাজ পড়াই বন্ধ হয়ে যাবে। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে কয়েকজনকে একত্রিত করে বাঁশ ও ট্রিপলের ব্যবস্থা করা হলো। আলহামদু লিল্লাহ, আজ সকাল নাগাদ সেখানে চালা হয়ে গেছে। তবে গতকালের কাদা এখনো পুরোপুরি শুকায় নি। এত কষ্টের পরও নামাজে তাদের কোন অবহেলা নেই।
পক্ষান্তরে জরাজীর্ণ মসজিদটির ঠিক পশ্চিম পাশেই রয়েছে একটি এনজিও স্কুল। যেখানে বাচ্চাদেরকে নিজ নিজ ভাষায় গাণ ও নাচ শেখানো হচ্ছে। এনজিওদের তৎপরতায় নলকূপ প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে সব ধরণের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। যাতে অন্তত সুযোগ-সুবিধাগুলো পাওয়ার জন্য হলেও মুসলিম বাচ্চাদের আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। আরো ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, তারা শুধু বাচ্চাদেরকে নিয়েই ষড়যন্ত্রের ছঁক আকছে না। বড়রাও রয়েছে তাদের নীল নকশার শিকারগ্রস্ত। বড়দের মগজ ধোলাইয়ের জন্য তারা ‘প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র’ নামে খুলেছে খৃষ্টীয় প্রশিক্ষণশালা। আমরা কেন্দ্রে ঢুকে ভিতরের অবস্থা দেখতে চেয়েছিলাম। খুব কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। স্থানীয় দ্বীনদাররা স্কুলের চে’ও এই কেন্দ্রগুলো নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। বিস্তারিত দেখুন ১ম কমেন্টের ভিডিওটিতে। খেয়াল করুন, মসজিদের দক্ষিণ পাশের চিকিৎসাকেন্দ্রের সীমানা কতটুকু জায়গাজুড়ে কাঁটাতার দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। তারা নিরলসভাবে তাদের কাজ অবিরাম করে যাচ্ছে। সফলতাও পাচ্ছে। আর আমরা কাজের কাজ করতে রাজী নই। তবে সফলতার শতভাগ ভাগিদার হতে চাই। ‘ধরি মাছ, না ছুই পানি’ কি কভু সম্বব?
এরপরও কি আমরা এগিয়ে আসবো না?
২. আমাদের মূল কার্যক্ষেত্র আরো বহুদূর। প্রায় ২ ঘন্টা পাহাড়ী পথ পাড়িয়ে সেখানে পৌছতে হয়। পথিমধ্যে রয়েছে ৩টি ভগ্নপ্রায় ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকু। দ্বিতীয় কমেন্টের ভিডিওটিতে দেখুন, কত ঝুঁকি নিয়ে মানুষ এই ভগ্নদশা সাঁকুটা পার হচ্ছে। যেকোন সময় সাঁকু ভেঙ্গে দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় মায়েরা সন্তানদেরকে কোলে-কাঁখে নিয়ে কোঁমড়-পানি ভেঙ্গে পার হচ্ছেন। এমন দূর্গম এলাকায় কেবল রোহিঙ্গারাই বাধ্য হয়ে পারাপার করছেন। স্থানীয়দের বক্তব্য হলোঃ এনজিও কর্মী ছাড়া ত্রাণ কর্তাদের আর কেউ নাকি এখনো পর্যন্ত সেখানে যান নি। আমাদের টীম সাঁকুর ওপারের বাসিন্দাদের ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ নিতে লাগলেন। যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে তারা আছে তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। প্রতিদিনই কয়েক ডজন মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে। এক পরিবারে গিয়ে দেখা গেলো, পুরো পরিবার অসুস্থ হয়ে না খেয়ে পড়ে আছে। তাদের কোন পুরুষ সদস্য নেই। এভাবেই পড়ে থেকে মরে পঁচে মাটিতে মিশে যাবেন, ভাবছিলেন তারা। আমাদের টীম সেখানে তাদেরকে ঔষধসেবা ও সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছে, আলহামদু লিল্লাহ। বিস্তারিত দেখুন, ৩য় কমেন্টে।
আরেকটি পরিবারের খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেলো, তাদের একজন বৃদ্ধ সদস্য খাদ্যের অভাবে গতরাতে ইন্তিকাল করেছেন। ঘরের একপাশে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা লাশটি আমাদের টিম দেখেছেন। ভিডিও দেখুন ৪র্থ কমেন্টে।
আরেকটি ঘরে গিয়ে দেখা গেলো, একটি যুবক ছেলেও চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে। তার জানাযার প্রস্তুতি চলছে।জানাযা শেষে পাহাড়ের এক জায়গায় দাফন করা হবে। এভাবে প্রতিদিনই ১৫-২০জন মারা যাচ্ছেন। ভিডিও দেখুন, ৫ম কমেন্টে।
দৈনিক এত কোটি কোটি টাকার ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে। সেল্ফী, ব্যানারের বাজারও তূঙ্গে রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অসহায়দের পাশে কেউ নেই। “ত্রাণ দিতে দলবন্ধ হয়ে আমরাও গিয়েছিলাম” শুধু এতটুকু স্বান্তনাই কি ইহকালীন কিংবা পরকালীন প্রশ্নে যথেষ্ট হবে? তাই অনুরোধ করবো, তেলা মাথাগুলো সচেতনভাবে এড়িয়ে প্রকৃত অসহায়দের খুঁজে বের করুন। তবেই আপনার ত্রাণকার্য সফল।
দেখুন, আমরা কত অলস। একটু কষ্ট করে অসহায়দের কাছে না গিয়ে রাস্তার ধারে খাঁটি বাঙ্গালীদের হাতেই ত্রাণ বিতরণ করে চলে আসছি। ভিডিও ৬ষ্ট কমেন্টে।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকেও অতিমূল্যবান রসদপত্রসহ ত্রাণ পৌছেছে। ভিডিও ৭ম কমেন্টে। কেউ হাসবেন না প্লীজ।
৩. আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, এই দুর্গম এলাকায় দ্বীনদারীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা আমরাই করবো ইনশা আল্লাহ। যতটুকুই পারি, আল্লাহ তা’আলার অসীম কুদরতের দিকে তাকিয়ে বড় আশা করতে তো কোন অসুবিধা নেই। أنا عند ظن عبدي بي এর বাস্তবতা প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা অনুভব করছি আলহামদু লিল্লাহ। এই উদ্যোগ সামনে নিয়ে গতকাল আমরা তাদেরকে একত্রিত করেছিলাম। কিছু দ্বীনী আলোচনা হয়েছে। দ্বীনী ইলম ও দ্বীনী মেহনত শেখার ব্যপারে তাদেরকে ‘তাশকীল’ও করা হয়েছে। সবাই হাত তুলে ও দাঁড়িয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। একজন আরাকানী ভাই তরজমা করেছেন। তাদের উদ্দীপনা আমাদেরকে ভীষণ আশান্বিত করেছে। যখন তাদের এই জায়গায় মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হলো, তখন খুশিতে কেউ কেউ যেন সেজদাবনত হওয়ার অবস্থা। কয়েকজন মুসাফাহ করতে এসে কথা না বলে শুধু অশ্রুই ঝরিয়েছেন। আশ্চর্য হলাম, তাদের কেউ আমাদের কাছে অভাবের কথা জানিয়ে একটি টাকাও চায় নি। আমরা আসলে প্রকৃত আরাকানী ভাইদেরকে চিনতে অনেক দেরী করে ফেলেছি। রাস্তার ধারে কাড়াকাড়ি ও ধস্তাধস্তি দেখেই ভেবে নিয়েছি, এরা উশৃঙ্খল। অথচ তারা এই ‘সবক’টা আমাদের কাছ থেকেই শিখেছে। তাদের রক্তে এসব নেই। বিস্তারিত দেখুন, কমেন্ট ৯।
এই এলাকায় কিছু করতে হলে সর্বপ্রথম মেরামত করতে হবে সাঁকুটি। আজ সকাল থেকে মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে আলহামদু লিল্লাহ। পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখানে টিন দিয়ে একটু বড় করে মজবুত একটি মসজিদ নির্মাণ করা হবে ইনশা আল্লাহ। পাশেই থাকবে পাঁকা টয়লেট। নিচে থাকবে টিওবওয়েল। যেন আশপাশের পাহাড়গুলোর দ্বীনী মারকায হিসেবে এই মসজিদটি ব্যবহৃত হতে পারে।
আল্লাহ তা’আলা আমাদের এই ক্ষুদ্র কাজটুকু কবুল করুন। প্রতিটি পাহাড়েই বড় বড় দ্বীনী খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার তাউফীক দান করুন। আমীন।