শুক্রবার, ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
আ জার্নি টু রাজারবাগ
একটি মজার ঘটনা দিয়েই জার্নিটা শুরু করি।
২০০৫ সালের এক সূর্যডোবা সন্ধ্যায় এক ব্যক্তি কয়েকজন বোরকাপরা মেয়ে নিয়ে কক্সবাজারের একটি নামিদামি হোটেল উঠে। তবে হােটেল কর্তৃপক্ষের কাছে সেই ব্যক্তির সাথে থাকা মেয়েদের মাহরাম হওয়ার কোনা পরিচয় সে দিতে পারেনি। তাই কর্তৃপক্ষ তাদেরকে থাকার অনুমতি দিলেও নিরাপত্তার খাতিরে পুলিশকেও জানিয়ে রাখে।
পুলিশের মন তো প্রেমিকার মনের চেয়ে কোনো অংশেই কম না; এই ব্যক্তির রহস্যজট খুলতে তারা তৎপর হয় ওঠে। হানা দেয় সেই হােটেলে; সেই সন্দেহভাজন ব্যক্তির রুমে। সেই ব্যক্তিকে পুলিশ প্রথমে রেইড করে। সে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তাড়াতাড়ি বােরকা পড়ে নেয়! মিশে যায় বোরকাপরা মেয়েগুলোর মাঝেই! অতঃপর কেউ কেউ বলছে, পুলিশ লজ্জিত হয়ে ফিরে যায়। আবার কেউ বলছে, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সেই লােকটি।
তবে কে এই রহস্যজনক লোকটি? আবিস্কৃত হলা ঢাকা রাজারবাগ দরবারের ভণ্ডপীর দিল্লুর রহমান!
আহ! এই ‘ইমামুল উমাম’ যদি এহেন নারী কেলেঙ্কারিতে ধরা না পড়তেন! ‘মুজাদ্দেদে জমান’ বলে কথা! পর্দার সংস্কারমূলক কাজ আরকি! কেউ মনে করতে পারেন, আমি ‘মুর্শিদ ক্বেবলা’র চরিত্রহননের ‘চেরেষ্টা’ চালাচ্ছি। নাহ, মোটও নয়। বিশ্বাস না হলে ইন্টারনেটে চার্চ করে দেখতে পারেন।
এবার আসি রাজারবাগে।
৫ নং আউটার সার্কুলার রোড, রাজারবাগ, ঢাকা-১২১৭। মুহাম্মদিয়া জামিয়া শরীফ ও কথিত সুন্নতী জামে মসজিদকে ঘিরেই চলছে রমরমা এক ব্যবসা। ব্যবসায়ীর নাম দিল্লুর রহমান। বাবা সুতা ব্যবসায়ী মোখলেছুর রহমান মিঞার ৩য় পুত্র। গ্রামের বাড়ি নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজার থানার প্রভাকরদী। কলেজেই লেখাপড়া করেছেন। ধর্মীয় জ্ঞানের কােনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই।
ব্যবসার যোগ্যতাটা পৈতৃক সূত্রেই পেয়েছেন বলে আমার প্রবল ধারণা। তবে উভয়ের ব্যবসার ধরনে ভিন্নতা আছে ব্যাপক। দিল্লুর রহমান বাবার মতো অতো বেকুব নন। তিনি বিনা পুঁজির ব্যবসায় বিশ্বাসী। পৃথিবীর বুঁকে পুঁজিহীন ব্যবসার অন্যতম হলো মাজার ও দরবার ব্যবসা। তিনি খুলে বসলেন রাজারবাগ দরবার শরীফ।
অনেক কষ্ট-মেহনত করে ব্যবসা জমিয়ে তােলেন। পাগলপারা মুরিদরা আসে টাকার বস্তা নিয়ে। ব্যবসায়ী ও তার বিবি ছাহেবাকে কদমবুচি আর সেজদা করে বরকত নিয়ে যায়। ক্বেবলার ‘খেদমতে’ পেশ করে আরাে কতো কী! তার হাত ধরে জান্নাতে যাওয়ার আশায় দামি দামি জমি দিয়ে দিতেও তারা কুণ্ঠাবােধ করে না। সুন্নতি মসজিদ যে ভবনের চতুর্থ তলায় অবস্থিত, এখন আমরা সে ভবনটির একটু খবর নেবো।
১৯৯১ সালে জেডআর এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি দিল্লুর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। এর ৩৭৮ টি শেয়ারের মধ্যে ৫০ টি শেয়ার দিল্লুর এবং তিনি এর পরিচালকও বটে। এ কােম্পানি সােনালী ব্যাংক থেকে সুদি লোন নিয়ে রাজারবাগ জেডআর ভবন নির্মাণ করে। তার বিরুদ্ধে ভাইবােনদের শেয়ার কুক্ষিগত করার তুমুল অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে সােনালী ব্যাংক উক্ত ভবনের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলাও করেছে। এই ভবনের চতুর্থ তলাতে তার ব্যবসার প্রধান কার্যালয় ‘সুন্নতি মসজিদ’ অবস্থিত। মসজিদ স্থাপনের জন্য জায়গা ওয়াকফকৃত হওয়া শর্ত। অথচ এই কথিত মসজিদ এখনো দিল্লুর পরিচালনাধীন কােম্পানির নামেই রেজিস্ট্রিকৃত।
সুদের ব্যাপারে দিল্লু সাহেব প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও তার বিরুদ্ধে আরো সুদি কেলেঙ্কারির অভিযােগ আছে। একটি অভিযোগ পাঠকের আদালতে পেশ করছি।
চট্টগ্রামের জনৈক রাজনৈতিক নেতার ভাই ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে ‘কর্ণফুলি এক্সপ্রেস’ রেলটি সরকার থেকে লীজ নেন। লােকসানের কারণে এক মাসের মধ্যেই থেমে গেল রেলের চাকা। হাত বাড়িয়ে দিলেন ধনী ভণ্ডপীর দিল্লুর রহমান। মাসিক ৩০ হাজার টাকা সুদে ১০ লক্ষ টাকা দিতে তিনি প্রস্তুত। ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পরও নাকি পীর দিল্লু মূল টাকা ফেরত পাওয়ার আগ পর্যন্ত মাসিক ৩০ হাজার টাকা আদায় করত। এর বিস্তারিত প্রমাণ সংশ্লিষ্ট আইনজীবির কাছে সংরক্ষিত আছে।
সাপ্তাহিক ২০০০ এ দিল্লুর রহমানের একটি সাক্ষাতকার নেওয়া হয়। তাতে তিনি হজের জন্য ছবি তােলাও হারাম ঘােষণা করেন। শুধু তাই নয়, তিনি মুরিদদেরক কঠোরভাবে হজ ও ওমরায় যাওয়া নিষেধ করেন। তাদের শ্লোগান দেখুন, ‘যে কর ওমরাহ সে হয় গোমরাহ’। বরং সেই অর্থ দরবারে দান করলে আরো বেশি সওয়াব হবে বলে ঘোষণা দেন। রসুলুল্লাহ স. এর রওজা জিয়ারত করার চাইতে রাজারবাগ আখড়া জিয়ারতের ফজিলত বেশি বলেও বেয়াদবি করেন।
যারা ছবির কারণে হজকে নিষিদ্ধ করে তাদের কুফুরি সুস্পষ্ট। তবে আশ্চর্যজনক কথা হলা, সেই ফতোয়াদানকারী দিল্লুই নিজ ছবি তুলে আল-ইহসান, আল-বাইয়্যিনাতসহ বিভিন্ন পত্রিকার সরকারি ডিক্লারেশন বের করেছেন। বিশেষজ্ঞ আলেমরা বলেছেন, দাজ্জাল মক্কা-মদিনায় ঢুকতে পারবে না। যুগের দাজ্জাল রাজারবাগের দিল্লুও মক্কা-মদিনায় ঢুকতে পারব না। নিরেট সত্য কথা!
দাজ্জাল রাজারবাগী তার নামের শুরুতে উপাধির দীর্ঘ বহর যুক্ত করেন। সাধারণত তার নাম লিখা হয় এভাবে- খলিফাতুল্লাহ, খলিফাতু রসুলিল্লাহ, হাবিবুল্লাহ, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত তরীকত, ইমামুল আইম্মাহ, মুহিউস সুনাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আযম, হুজ্জাতুল ইসলাম, ছাহিবু সুলত্বানিন নাছীর, আওলাদে রসুল, মুফতিয়ে আজম, বাহরুল উলুম ওয়াল হিকাম, হাফিজুল হাদীস, হাকিমুল হাদীস, তাজুল মুফাসসিরিন, রইসুল মুহাদ্দিসীন, আমীরুল মুমিনীন ফী উলুমিল ফিকহ ওয়াত তাসাওউফ, মাখযানুল মারিফাত, ইমামুস সিদ্দীকীন, গাউসুল আজম, সায়্যিদুল আউলিয়া, আফজালুল আউলিয়া, সুলতানুূল আরেফীন, শাইখুশ শুয়ুখ ওয়াল মাশায়েখ, মুজাদ্দিদ ফিদ্দীন, সায়্যিদুল মুজতাহিদীন, কাইউমুয যামান মাওলানা হযরত ইমামুল উমাম আলাইহিস সালাম আল-হাসানী ওয়াল হাসাইনী ওয়াল কারাইশী।
‘গাঁয়ে মানে না আপনি মােড়ল’ কথাটির যথার্থতা দিল্লুর ভেতর দৃশ্যমান। তাঁর বিশাল উপাধিবহরের পেছনে একমাত্র যুক্তি হলো, তিনি নাকি ‘ইলম লাদুনি’ লাভ করেছেন। তার নিজের সম্পর্কে বিভিন্ন দাবির যেন শেষ নেই। কয়েটটা উদ্ভট দাবি ধৈর্যসহ শুনুন।
এক. ‘আমি এক রাতে স্বপ্নে দেখি, একটি কাচের ঘর, যাতে কোনো দরজা বা জানালা কিছুই ছিলো না। সেই ঘরে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ চারজন অলীকে বসানোর জন্যে চার কোণে চারখানা আসন রাখা হলো। সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ আউলিয়া ওই ঘরের চারপাশে ঘোরাঘুরি করছিলেন। সবাই বলাবলি করছিলেন, এই চারটি আসন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ চারজন অলীকে বসানো হবে। সকলে ভাবছেন কাকে বসানাে হবে?? এ অবস্থায় বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী রহ., খাজা মাঈনুদ্দীন চিশতী রহ. ও মুজাদ্দেদে আলফসানী রহ. একে একে তিনটি আসনে বসে পড়েন। এবার লক্ষ লক্ষ আউলিয়ার মাঝে বলাবলি হচ্ছিল যে, চতুর্থ আসনে চার তরীকার চারজনর চতুর্থজন বাহাউদ্দীন নকশবন্দী রহ. কে বসানাে হবে। দেখা গেল, একজন ফেরেশতা এসে আমাকে উক্ত চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। আর এ চারজন ছাড়া কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।’
দুই. ‘আমার এক মুরিদ ভাই স্বপ্বে রসুল স. কে দেখেছেন। তিনি নবীজি স. কে চার তালিঅলা টুপি পরিহিত দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর টুপি নিয়ে দ্বিধাদ্বদ্ব চলছে, কোন টুপি আপনার খাছ সুন্নত? উত্তরে নবী স. বললেন, টুপি, সম্পর্কে মাসায়েল যা কিছু জানত হয় তা রাজারবাগের দিল্লুর কাছ থেকে জেনে নিও।’
মনে হয় পাঠক বিরক্ত হচ্ছেন! একটি মজার কথা বলেই রাজারবাগ-জার্নি শেষ করছি। দিল্লু সাহেব নিজেকে সাইয়েদ, হাসানী, হোসাইনী, কোরাইশী দাবি করেন। অথচ তার পিতা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন সকলেই সাইয়েদ দাবি তাে দূরের কথা; বরং প্রকাশ্যে তা অস্বীকার করেন। এখান থেকে হয়ত কিছুটা আঁচ করতে পারছেন তার ভণ্ডমি!
এবার ফিরে আসি বনপুরে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঁচহাজার একর জমি কিনলেন কীভাবে? এত টাকা আসে কােত্থেকে? বাংলাদশী টাকা দিয়ে তা কি আদৌ সম্ভব, নাকি ডলার-টলারের গোপন হাত আছ? র্যান্ড কর্পোরেশনের টাকা যে সুফিজম জিন্দা রাখার কাজেই সবচেয়ে বেশি ব্যয়িত হয় -এটা সবাই জানে। এদের ভণ্ডামি সরকারের কাছেও সুস্পষ্ট; কিন্তু একটি দরবারও যদি বন্ধ করা হয়, মিডিয়াতে পশ্চিমা লাল শকুনদের চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা হয়ে যাবে।
আ জার্নি টু রাজারবাগ / ইযাযুল হক
(মিশন বনপুর থেকে নির্বাচিত অংশ)