চুল দাড়িতে কালো খেজাব লাগানোর হুকুম কী?
এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের এলাকার দু’জন আলেমের মধ্যে প্রবল মতভেদ দেখা দিয়েছে। একজন বলছেন যে, যে কালো খেযাব ব্যবহার করে সে ফাসিক। তার পিছনে ইমামতী শুদ্ধ হবে না।
আরেক মুফতী সাহেব বললেন, স্ত্রীকে খুশি করতে কেউ যদি কালো খেযাব ব্যবহার করে তাহলে তা মাকরূহ বা হারাম হবে না। সেই হিসেবে উক্ত ব্যক্তিকে ফাসিক বলা যাবে না। তাকে ইমাম বানাতেও কোন সমস্যা নেই।
উপর্যুক্ত পরিবেশে মুফতী সাহেবের কাছে নিবেদন হল, বিষয়টি বিস্তারিত দলীলসহ জানালে উপকৃত হতাম।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
লাল ও হরিদ্রা বর্ণের খেজাব লাগানো সর্বসম্মত মতানুসারে জায়েজ।
জিহাদের ময়দানে কালো খেজাব ব্যবহার করা জায়েজ। এটিও সর্বসম্মত মত।
কিন্তু অন্য সময় কালো খেজাব ব্যবহার করা যাবে কি না? এ বিষয়ে ফুক্বাহায়ে কেরামের মাঝে মতভেদ আছে।
আমভাবে ফুক্বাহাদের মতে তা মাকরূহ। কিন্তু ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ এর মতে স্ত্রীকে খুশি করতে মাকরূহ হওয়া ছাড়াই জায়েজ।
হযরত থানবী রহঃ তার “ইমদাদুল ফাতওয়া” এর ৪/২১৩ এ প্রথমে যে ফাতওয়াটি লিখেছেন সেটির সারকথা এটাই।
এরপর তিনি তার কিতাবে কোথাও মাকরূহে তাহরীমী আবার আবার কোথাও হারামও বলেছেন।
মুফতী আযীযুর রহমান রহঃ ও ফাতাওয়া দারুল উলুম দেওবন্দের মাঝে এ বিষয়ে চারটি জবাব দিয়েছেন। ফাতাওয়া দারুল উলুম দেওবন্দের ১৬/২৪০-২৪১ এ যে চারটি জবাব দিয়েছেন, এর প্রথম তিনটির জবাবে বলেছেন, “কালো খেযাব অধিকাংশ মাশায়েখদের নিকট মাকরূহ এবং কতিপয় মাশায়েখ মাকরূহ না হবার প্রবক্তা।
মোটকথা হল,এ থেকে বিরত থাকাই উত্তম।
মুফতী আযীযুর রহমান চতুর্থ জবাবে কালো খেযাব ব্যবহারকে মাকরূহে তাহরীমী প্রমাণ করেছেন।
মুফতী কেফায়াতুল্লাহ রহঃ “কেফায়াতুল মুফতী” এর কদীম সংস্করণ এর ৯/১৭১-১৭২ এবং জাদীদ সংস্করণ এর ১২/৩৪২ এ কালো খেযাব লাগানো শুধু মাকরূহ বলেছেন। তাহরীমী কোথাও লিখেননি।
মুফতী রশীদ আহমাদ গঙ্গুহী রহঃ ফাতাওয়া রশীদিয়ার ৩৪৮ পৃষ্ঠায় তা ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। জাদীদ সংস্করণের ৫৮০ পৃষ্ঠায় এতটুকু এসেছে যে, কালো খেযাব ছাড়া বাকি সকল খেযাব ব্যবহার জায়েজ।
গঙ্গুহী রহঃ ও কোথাও কালো খেযাবকে মাকরূহও বলেননি। শুধু নিষেধ করেছেন।
এবার আমরা হাদীসের আলোকে চিন্তা ফিকির করে দেখি জিহাদ ও বিবিকে খুশি করতে খেযাব ব্যবহার করা ছাড়াও এমনিতে সাজগুজের জন্য কালো খেযাব ব্যবহার করা যাবে কি না?
এ বিষয়ক হাদীসগুলো সামনে রাখলে আমাদের সামনে দুই ধরণের হাদীস আসে। যথা-
১-কিছু বর্ণনা এমন যদ্বারা আমভাবে তা জায়েজ হবার প্রমাণ বহন করে।
২-কিছু বর্ণনা দ্বারা নাজায়েজ প্রমাণিত হয়।
এ কারণে উভয় প্রকারের বর্ণনা সামনে এনে আমাদের চিন্তা করতে হবে “কালো খেযাব ব্যবহার” করার বিধান কী হবে?
প্রথম প্রকারের বর্ণনা ইমাম তাবারানী রহঃ “আলমুজামুল কাবীর” এ হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস রাঃ এবং হযরত জারীর বিন আব্দুল্লাহ বাজালী রাঃ এর আমল নকল করেছেন।
এ উভয় শায়েখ কালো খেযাব ব্যবহার করতেন।
মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা এর সহীহ এবং আলী সনদে নকল করা হয়েছে যে, হযরত উকবা বিন আমের রাঃ কালো খেযাব ব্যবহার করতেন। সেই সাথে তা ব্যবহারে উৎসাহও প্রদান করতেন।
এছাড়া হযরত হাসান রাঃ এবং হযরত হুসাইন রাঃ এর আমলও সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, তারাও কালো খেযাব ব্যবহার করতেন।
হযরত ইমাম মুহাম্মদ বিন হানফিয়্যা রহঃ এর কাছে কালো খেযাব ব্যবহার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমার দৃষ্টিতে এতে কোন সমস্যা নেই।
এ বিষয়ক বর্ণনার অভাব নেই। কয়েকটি বর্ণনা নিচে উদ্ধৃত করা হল,
১
عن ابى عشانة المعافرى قال: رأيت عقبة بن عامر رضى الله عنه يخضب بالسواد، ويقول نسود اعلاها وتابى اصولها (مصنف ابن ابى شيبة-12/555، رقم-25569)
2
عن الحسن أنه كان لا يرى باسا بالخضاب بالسواد، (مصنف ابن ابى شيبة-12/554، رقم-25523)
3
عن قيس مولى خباب قال: دخلت على الحسن رضى الله عنه والحسين رضى الله عنه وهما يخضبان بالسواد (مصنف ابن ابى شيبة-12/554، رقم-25520، المعجم الكبير-3/99، رقم-2787/270/2791)
عن ابى عون قال: كانوا يسألون محمدا عن الخضاب بالسواد، فيقول: لا أعلم به باسا، (مصنف ابن ابى شيبة-12/554، رقم-25524)
عن سعيد بم المسيب ان سعد ابن ابى وقاص رضى الله عنه كان يخضب بالسواد، (المعجم الكبير للطبرانى، دار احياء التراث العربى-1/138، رقم-295)
عن عامر بن سعد رضى الله عنه أن سعدا كان يخضب بالسواد (المعجم الكبير للطبرانى-1/138/296، مجمع الزوائد، دار الكتب العلمية، بيروت-5/158)
এ বিষয়ে অনেক বর্ণনা হাদীসে কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে। যা প্রমাণ করে আমভাবেই কালো খেযাব ব্যবহার করার অনুমতি রয়েছে।
দ্বিতীয় প্রকার বর্ণনা তথা কালো খেযাব ব্যবহার নিষিদ্ধতার বর্ণনাও রয়েছে অনেক।
এর মাঝে দু’টি এমন বর্ণনা আছে, যদ্বারা কালো খেযাব ব্যবহারকে মাকরূহ বলে সাব্যস্ত করা যায়।
১
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ থেকে বর্ণিত। যাতে হযরত আবু বকর রাঃ এর পিতা আবু কুহাফার চুলকে খেযাব লাগাতে হুকুম করা হয়েছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শব্দ এমন ছিলঃ
غيروا هذا بشيئ واجتنبوا السواد (صحيح مسلم، باب فى صبغ الشعر وتغيير الشيب-2/199، رقم-2102، سنن النسائى، النهى عن الخضاب بالسواد-2/236، رقم-5076)
অনুবাদঃ চুলের রঙ পাল্টে দাও, তবে কালো খেযাব থেকে বেঁচে থাকো। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২১০২]
২
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। যাতে কালো খেযাব ব্যবহার বিষয়ে মারাত্মক ধমকিও বিদ্যমান রয়েছে।
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يكون قوم يخضبون فى آخر الزمان بالسواد كحاصل الحمام لا يرحون رائحة الجنة
ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ শেষ যুগে এমন সম্প্রদায়ের আর্বিভাব হবে, যারা কবুতরের গলার থলের ন্যায় কালো রঙের খেযাব লাগাবে। তারা জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। [সুনানে আবু দাউদ-২/৫৭৮, হাদীস নং-৪২১২, সুনানে নাসায়ী-২/২৩৬, হাদীস নং-৫০৭৫]
এবার দু’টি বর্ণনার উপর ফিকির করুন।
প্রথম বর্ণনাটি আদেশসূচক। আর আদেশসূচক শব্দ ওয়াজিব হওয়াকে তাকাযা করে। সেই হিসেবে হাদীসে বর্ণিত দু’টি আদেশই ওয়াজিব পর্যায়ে চলে যাবে।
অর্থাৎ খেযাব ব্যবহার করাও ওয়াজিব আবার কালো খেযাব থেকে বেঁচে থাকাও ওয়াজিব। কারণ দু’টিই হাদীসে আদেশসূচক শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।
এখন যদি বলা হয় যে, সাদা চুলে খেযাব লাগানো আবশ্যক, তাহলেই কেবল কালো খেযাব থেকে বেঁচে থাকাও আবশ্যক হবে। অর্থাৎ কালো খেযাব লাগানোকে হারাম বা মাকরূহে তাহরীমী বলা যাবে।
হাদীসের প্রথমাংশের আদেশসূচক বাক্যের নির্দেশনা অনুপাতে কিন্তু একথা কেউ বলেন না যে,সাদা চুলে খেযাব লাগানো জরুরী বা আবশ্যক।বরং বলা হয় এর দ্বারা উৎসাহ প্রদান উদ্দেশ্য। আবশ্যকতা নয়।
এ হিসেবে হাদীসের দ্বিতীয় আদেশ দ্বারাও আবশ্যকতা নয় বরং উৎসাহ প্রদান উদ্দেশ্য হবার কথা।অর্থাৎ কালো খেযাব ব্যবহার না করা উচিত। জরুরী বা আবশ্যক নয়।
দ্বিতীয় হাদীসের মাঝে এমন কওমের ব্যাপারে বলা হয়েছে যারা জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। তাদের পরিচয় দিতে গিয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
১ তারা কালো খেযাব লাগাবে।
২ তাদের শরীরের কাঠামো হবে কবুতরের গলার থলের মত।
কালো খেযাব লাগানো এ কওমের পরিচয় সাব্যস্ত করেছেন। ধমকির “ইল্লত” তথা মূল কারণ সাব্যস্ত করেননি।
যারা কালো খেযাবকে ধমকির ইল্লত সাব্যস্ত করেছেন তাদের উচিত হাদীসটি নিয়ে আবার গবেষণা করা।
নতুবা হযরত সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস রাঃ, হযরত জারীর বিন আব্দুল্লাহ বাজালী রাঃ, হযরত উকবা বিন আমের রাঃ, হযরত হাসান রাঃ এবং হুসাইন রাঃ এর মত সাহাবাগণের উপর মাকরূহে তাহরীমী কাজ করার অভিযোগ উত্থাপিত করতে হবে। [নাউজুবিল্লাহ]
যা কিছুতেই বৈধ হবে না।
এছাড়া হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাঃ এবং হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাঃ এর বর্ণনাটি সর্বসম্মতভাবে “জন্নিউচ্ছুবুত”। আর কালো খেযাব জায়েজ সম্পর্কিত বর্ণনাগুলোর কারণে এ বর্ণনা দু’টি সর্বসম্মতভাবে “জন্নী” হয়ে যাচ্ছে। আর যে বর্ণনা “জন্নিউচ্ছুবুত” এবং জন্নিউদ দ্বালালাত” হয়, সে বর্ণনা দ্বারা মাকরূহে তাহরীমী এবং হারাম হওয়া সাব্যস্ত হয় না। বরং মাকরূহে তানজিহী প্রমাণিত হয়।
এ কারণেই রশীদ আহমাদ গঙ্গুহী রহঃ এবং হযরত মুফতী কেফায়াতুল্লাহ রহঃ অনেক সতর্কতার সাথে হুকুম বর্ণনা করেছেন।
আর হযরত থানবী রহঃ এবং হযরত মুফতী আযীযুর রহমান রহঃ এর প্রথমে বর্ণিত ফাতওয়াও এমনটাই বুঝায়।
এ কারণে কালো খেযাব লাগানো মাকরূহে তানজীহী হবে। কালো খেযাব লাগানো ব্যক্তির ইমামতীও কারাহাত ছাড়াই জায়েজ হবে।
মাবসূতে সারাখসীতে এসেছেঃ
واما من اختضب لأجل التزئين للنساء، والجوارى، فقد منع من ذلك بعض العلماء رحمهم الله تعالى، والاصح أنه لا بأس به، وهو مروى عن أبى يوسف رح، قال: كما يعجبنى أن تتزين لى يعجبها أن اتزين لها (المبسوط للسرخسى، دار الكتب العلمية، بيروت-10/199)
স্ত্রীকে খুশি করতে যে ব্যক্তি (কালো) খেযাব ব্যবহার করে কতিপয় উলামায়ে কেরাম তা করতে নিষেধ করেছেন। তবে বিশুদ্ধ কথা হল এতে কোন সমস্যা নেই। এটি ইমাম আবূ ই্উসুফ রহঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, যেমনিভাবে আমি চাই স্ত্রী আমার জন্য সজ্জিত থাকুক, তেমনি স্ত্রীও চায় তার জন্য স্বামী পরিপাটি থাকুক। [মাবসূত-১০/১৯৯]
এছাড়া ইমাম নববী রহঃ এ বিষয়ে “ইজমা” নকল করেছেন যে, উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা সর্বসম্মত মতানুসারে “ওয়াজিব” হওয়া সাব্যস্ত হয় না। আর নিষেধাজ্ঞার দ্বারাও সর্বসম্মত মতানুসারে মাকরূহে তাহরীমী বা হুরমত প্রমাণিত হয় না।
সুতরাং শুধু মাকরূহে তানজীহী এর হুকুম সাব্যস্ত হয়।
আর মাকরূহে তানজীহী কাজ করলে উক্ত ব্যক্তি ফাসিক হয় না। তার ইমামতী করাতে কোন সমস্যা নেই।
واختلاف السلف فى فعل الأمرين بحسب اختلاف احوالهم فى ذلك مع أن الأمر والنهى فى ذلك ليس للوجوب بالإجماع، ولهذا لم ينكر بعضهم على بعض خلافه فى ذلك قال: ولا يجوز أن يقال فيهما ناسخ ومنسوخ (شرح نووى على المسلم-2/199)
বিস্তারিত জানতে হলে পড়ুন-ফাতাওয়া কাসিমিয়া-২৩/৬০৩-৬০৮]
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
ইমেইল– [email protected]