শনিবার, ২রা চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ৬ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

নওমুসলিমদের সাক্ষাৎকার [পর্ব-১৪] :: শেখ মুহাম্মদ উসমান (সতীশ চন্দ্র গোয়েল)-এর সাক্ষাৎকার


আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন ইসলামের আমানত অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। ইসলামের প্রতিটি কথার মধ্যেই আকর্ষণ রয়েছে। আমরা যদি ইসলামের সামাজিক বিষয়, ইসলামের চরিত্র এমনকি ইসলামের ইবাদতগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরি তাহলে এর দ্বারা মানুষ প্রভাবিত না হয়ে থাকতে পারবে না। আমরা আসলে সে কথাটিই ভুলে গেছি। দেখুন, এক মুহাম্মদ ইরফান। সে ভুল ব্যবহার এবং আমাদের এই ভারতীয় আচরণ থেকে সরে এসে যখন ইসলামের একটি বিধান মেনেছে তখন তার এই সামান্য পরিবর্তনে কেবল আমার নয় বিশাল একটি শ্রেণীর হেদায়াতের উপলক্ষ হয়েছে। পরিণতিতে তার পার্থিব ক্ষতিও লাভে পরিণত হয়েছে।


আহমদ আওয়াহ: আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
শেখ মুহাম্মদ উসমান: ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

আহমদ আওয়াহ: শেট সাহেব! আপনি দিল্লী কবে এলেন?
শেখ মুহাম্মদ উসমান: মাওলানা আহমদ সাহেব! আজ সকালে এসেছি। আবার রাতেই চলে যেতে হবে। মাওলানা সাহেবের সাথে দেখা করতে মন চাচ্ছিল। ফোন করে জানতে পারলাম, তিনি দিল্লীতেই আছেন। মাওলানা বললেন, আপনার সাথেও আমার সাক্ষাতের প্রয়োজন রয়েছে। পুরান দিল্লী থেকে কিছু মাল কেনা জরুরী ছিল। সদর এবং চাঁদনীচকে কিছু কাজ ছিল। সবগুলো কাজ শেষ করেছি। অবশ্য কাজ এখনও বাকী আছে যা বিকেলে হবে। ভাবলাম দুপুরে হযরতের সাথে দেখা করে আসি। হযরত বললেন, আরমুগানের জন্য আহমদ একটি ইন্টারভিউ নেবে।

নওমুসলিমদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসুন

আহমদ আওয়াহ: আব্বুর সাথে আপনার দেখা হয়েছে?
শেখ মুহাম্মদ উসমান: হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ! সাক্ষাত হয়েছে। আসলে পীর এবং শেখ হলেন অনেকটা চার্জারের মতো, হযরতের সাথে দেখা করলে কিছু কথা শুনলে ঈমানের ব্যাটারী চার্জ হয়ে যায়। হাদীস শরীফেও সৎলোকের সাক্ষাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তাছাড়া আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাক্ষাতে ধন্য হতে পেরেছিলেন বলেই সাহাবায়ে কেরাম সাহাবায়ে কেরাম হতে পেরেছিলেন।

আহমদ আওয়াহ: আপনি একেবারে সত্য বলেছেন। আচ্ছা এবার সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে আসি। আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি।
শেখ মুহাম্মদ উসমান: এতে কষ্টের কী আছে। এটা বরং আমাদের জন্য মহা সৌভাগ্যের বিষয়। একটি দ্বীনি কাজে আমার মতো একজন সামান্য মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ হলো। কোথায় আমি আর কোথায় ঈমানের মতো সম্পদ! সবই আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ।

আহমদ আওয়াহ: প্রথমে আপনার বংশ পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইবো।
শেখ মুহাম্মদ উসমান: আমার জন্ম ইউপির প্রখ্যাত জেলা বুলন্দশহরে। এই শহর রাজা বরুণের রাজধানী ছিল। সেখানেই একটি মর্যাদাশীল ব্যবসায়ী পরিবারে আমার জন্ম। আমার বাবা ছিলেন একজন বড় ঠিকাদার ব্যবসায়ী। তিনি আমার নাম রেখেছিলেন সতীশচন্দ্র গোয়েল। আমার একজন ছোট ভাই আছে। পিতাজীর মৃত্যুর পর আমি ব্যবসার হাল ধরি। ছোট ভাইকে ব্যবসায় লাগিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের ব্যবসা বাণিজ্যে খুব উন্নতি দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ! পিতাজীর ব্যবসাকে আমরা আরও বাড়াতে পেরেছি। লেখাপড়া শিখেছিলাম ইন্টার মিডিয়েট পর্যন্ত। বাবা মারা গেলে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হলো না। ব্যবসা-বাণিজ্যের হাল ধরতে হলো। বিয়ে করেছি মুজাফফরনগরের বড় এক ব্যবসায়ী পরিবারে। আমার স্ত্রী অত্যন্ত ভদ্র, পোস্ট গ্রাজুয়েট। আমাদের দুই ছেলে এবং এক মেয়ে। আমার মা আমাদের সাথেই থাকেন।

আহমদ আওয়াহ: আপনার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বলবেন কি?
শেখ মুহাম্মদ উসমান: আসলে গোড়া থেকেই আমাদের পরিবার ছিল খুব ধার্মিক। আমার পিতাজীকে দেখেছি ধর্মীয় কাজে তিনি খুব খরচ করতেন। বিশেষ করে মানুষকে দান করা এবং লঙ্গরখানা খোলা এসব বিষয়ে তাকে দুই হাতে খরচ করতে দেখেছি। এও লক্ষ্য করেছি এর দ্বারা বাবার ব্যবসা বাণিজ্য বেড়েছে। মূলত সেখান থেকেই ধর্মীয় কাজে খরচের প্রতি আগ্রহ আমার মধ্যেও এসেছে। তাই কেবল হিন্দুধর্ম নয়, অন্যান্য ধর্মের জন্যও পয়সা খরচ করতাম। যদি কোথাও দেখতাম মসজিদ নির্মাণ হচ্ছে, ভাবতাম এটাও মালিকের ঘর। মুসলমানরা না চাইলেও আমি পীড়াপীড়ি করে অংশগ্রহণ করতাম। আমাদের এখানে তাবলীগি ইজতেমা হতো। দায়িত্বশীলদের খোশামোদ করে আমি কিছু পয়সা নিতে বাধ্য করতাম। হয়তো এই কাজ আমার মালিক পছন্দ করেছেন এবং আমার হেদায়েতের উসিলা করেছেন।

আহমদ আওয়াহ: সন্দেহ নেই হেদায়েতের ফয়সালা আল্লাহই করেন। তবে দুনিয়াতে কাউকে না কাউকে উপলক্ষ বানান। তাই আপনি কিভাবে কার মাধ্যমে ইসলাম পেলেন বলবেন কি?
শেখ মুহাম্মদ উসমান: আমার পিতাজি মুসলমানদের মহল্লার কাছে একটি মার্কেট বানিয়েছিলেন। মার্কেটের দশটি দোকানের ছয়টিই ভাড়া নিয়েছিল মুসলমান ব্যবসায়ীরা। আমার ব্যবসা যখন বাড়লো তখন গুদামের প্রয়োজন পড়লো। ভাবলাম, এই মার্কেটটি খালি করে নতুন নকশার মার্কেট তৈরি করবো। সেখানে আমার বড় একটি গুদাম থাকবে। যোগাযোগ করার পর একটি ব্যাংক আমাদের জায়গাটি ভাড়া নিয়ে সেখানে তাদের উদ্যোগেই বিল্ডিং করে দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো। মৌখিকভাবে কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়ে গেল। অ্যাডভান্সের টাকা নিয়ে দোকান খালি করে দেয়ার জন্য ভাড়াটিয়াদের অনুরোধ করা হলো। প্রায় অর্ধেক ভাড়াটিয়া এতে রাজি হয়ে দোকান ছেড়ে দিতে প্রস্তত হলো। যারা অমত করলো তাদের দোকান খালি করে দেয়ার জন্য নোটিশ দেয়া হলো। আমাদের একজন ভাড়াটিয়া ছিলেন, নাম সাঈদ আহমদ। আরেকজন ভাড়াটিয়া মুহাম্মদ ইরফান।

মুহাম্মদ ইরফানের ছিল একটি জেনারেল স্টোর। আল্লাহর ইচ্ছা তার স্টোরটি আগে খুব ভালো চলতো। হঠাৎ করেই তার ব্যবসা ঠান্ডা হয়ে পড়লো। সে দোকান ছাড়তে অস্বীকার করে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করলো। সাঈদ আহমদ মহল্লার ইমাম সাহেবের কাছে দুআ চেয়ে বললোÑ মার্কেটের মালিক আমাদের দোকান থেকে তুলে দিচ্ছে। মসজিদের ইমাম সাহেব মাওলানা মুঈনদ্দীন, মাওলানা কালিম সিদ্দীকির মুরীদ। ইমাম সাহেব সাঈদ আহমেদকে জিজ্ঞাসা করলেনÑ যখন ভাড়া নিয়েছিলে তখন কত দিনের চুক্তি হয়েছিল? সে বললো এগার মাসের। তারপর কথা ছিল প্রতি বছর চুক্তি নবায়ন হবে। কিন্তু তিন বছর ধরে আর নবায়ন করা হচ্ছে না। ইমাম সাহেব বললেন, মুখে মুখেও কোনো কিছু হয়নি। সে বললো, না।
মাওলানা সাহেব বললেন, শেঠজী দোকানের মালিক। তুমি তার দোকান দখল করতে চাচ্ছো। আমি তো দুআ করবো শেঠজীর জন্য। তুমি অন্যের সম্পদ গ্রাস করতে চাচ্ছ। তোমার জন্য কীভাবে দুআ করি? ইমাম সাহেবের কথায় বেচারা সাঈদ আহমদ হতাশ হয়ে ফিরে এলো। মুহাম্মদ ইরফানও ইমাম সাহেবের মুসল্লী। ইরফান গিয়ে তার সাথে পরামর্শ করলো। বললো, শেঠজী প্রথমে দোকান খালি করে দিতে বলেছিল এখন লিখিত নোটিশ দিয়েছে। তাছাড়া দোকানও ভালো চলে না। পরামর্শ দিন এখন কী করবো? ইমাম সাহেব লেনদেনের বিস্তারিত কথাবার্তা শুনলেন। তারপর অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বলে দিলেন, এখনই দোকান খালি করে দাও। যদি মামলায় তোমার পক্ষে রায়ও হয়ে যায় তাহলে মনে রেখো পরকালের আদালতে ধরা পড়ে যাবে।

আমরা মুসলমানরা দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। নামায পড়ার সময় তো মুসলমান থাকি কিন্তু লেনদেন করতে গিয়ে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাই। আমাদের হযরত সত্যই বলেন। তিনি প্রায়ই আমাদেরকে বলে থাকেন, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রায় ভাষণেই বলতেন, লা- ঈমানা লিমান লা আমানাতালাহু ওয়ালা দীনা লিমান লা আহদা লাহু। যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই; যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না তার ধর্ম নেই। তোমাদের চুক্তি যখন ছিল এগার মাসের তখন শেঠজীর অনুমতি ছাড়া তো একদিনও দোকান তোমাদের দখলে রাখার অনুমতি নেই। এ ধরনের অপরাধ সরাসরি ঈমানÑপরীপন্থী। আমার মত হলো, এখন গিয়ে দোকান খালি করে দাও। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ব্যবসায় বরকত দিবেন। মুহাম্মদ ইরফান এমনিতেও স্টোর ছেড়ে দিতে প্রস্তুত ছিল। ইমাম সাহেবের কথায় সে আর দেরি করলো না। পরদিন সে দোকান খালি করতে লাগলো। তড়িঘড়ি করে দোকান খালি করতে দেখে আমি কিছুটা ভয় পেলাম। কারণ, আমাদের এখানে একজন চরম বদমাশ আছে। সে সুযোগ বুঝে মানুষের জায়গা জমি এবং ঘরবাড়ি দখল করে এবং অন্যকে দখল করে দেয়। তাকে কিছু বলার মতো সাহস আমাদের এখানে কারও নেই।
আমি মনে মনে ভাবলাম, ইরফান আবার ঐ দোকান বদমাশটাকে দিয়ে দিচ্ছে কিনা। কিন্তু দেখলাম কিছুই হলো না। পরদিন সন্ধ্যায় ইরফান আমাদের ঘরে এলো। তার আচরণ ছিল খুবই ভদ্রতাপূর্ণ বললো, লালাজি! আপনাকে অনেক অনেক শুকরিয়া। আপনার দোকানে আমাদের দীর্ঘদিন ভাড়ায় থাকতে দিয়েছেন। আমি আপনার নির্দেশে দোকান খালি করে দিয়েছি। খালি করতে কিছুটা দেরী হয়ে গেল। এজন্য আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমি বললাম, এডভান্সের এক লাখ টাকা ফিরিয়ে দেই? ইরফান বললো, না না, লালাজি! এটা কেমন কথা! অ্যাডভান্স আবার কিসের? আমি আপনার দোকান আপনাকে ফিরেয়ে দিয়েছি। আমি তখন এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। ঐ বদমাশ আবার আসছে কি না।

কিছুক্ষণ পর্যন্ত আমি হাতে চাবি তুলে নিতে সাহস পাচ্ছিলাম না। বললাম, ইরফান! তুমি ঠিক আছ তো? ও বললো, লালাজি! আমি পুরোপুরি ঠিক আছি। আমি বললাম, এতো তাড়াতাড়ি কেউ দোকান খালি করে দেয়? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। ইরফান বললো লালাজি! আসলে আমার ভুল হয়ে গেছে। লেনদেনকে আমরা ইসলামের বাইরে নিয়ে এসেছি। এ কারণেই আপনি এখন আমাদের ইসলামী লেনদেন দেখে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমি বললাম, তুমি তো প্রথমে দোকান খালি করতে চাইছিলে না। ইরফান বললো, এটা আমার ভুল ছিল।

আমি মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে যখন গেলাম তিনি আমাকে খুব ধমক দিলেন। বললেন, ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী তুমি যদি এখনই দোকান খালি করে না দাও তাহলে মৃত্যুর পর আল্লাহ তায়ালার আদালতে আটকা পড়বে। তারপর মাওলানা সাহেব যা যা বলেছিল সবকিছু সে আমাকে শুনালো। আমি বললাম, তোমার মাওলানা সাহেবের সাথে আমি কি দেখা করতে পারবো? ইরফান বললো, এখনই চলুন। আমি একটি স্কুটার নিয়ে সোজা ইরফানের সাথে মসজিদে গিয়ে উঠলাম। মাওলানা সাহেব কিতাব পড়ছিলেন। মসজিদের কক্ষেই তার সাথে সাক্ষাত হলো।
আমি বললাম, ইরফানকে দোকান খালি করে দিতে আপনি কেন বললেন? তিনি বললেন, এটা আমাদের ধর্ম এবং কুরআনের বিধান। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, কুরআনে কি ভাড়া লেনদেনের বিধানও রয়েছে। ইমাম সাহেব বললেন, আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিভাবে খেতে হয়, খাওয়ার পর কিভাবে আঙ্গুল চাটতে হয় এমনকি হাতের নখ কি ভাবে কাটতে হয় তাও শিখিয়েছেন। আমি বললাম, আচ্ছা, এই বিধান কি শুধু মুসলমানদের জন্য না কি আমরাও পারি? ইমাম সাহেব বললেন, এটাই তো আমাদের সবচে’ বড় অপরাধ। আমরা আমাদের ধর্মের বিধান আপনাদের পর্যন্ত পৌঁছাতে পারিনি।

ইসলামের আইন এবং কুরআন শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয় বরং এর অনুসরণ প্রতিটি মানুষের জন্যই অপরিহার্য। আমাদের মালিক আমাদের দায়িত্ব দিয়েছেন এই বার্তা আপনাদের পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য। অথচ আমরা আমাদের দায়িত্বে অবহেলা করছি। যার কারণে আজ পৃথিবীর সর্বত্র আমরা লাঞ্ছিত হচ্ছি। আমি বললাম, তাহলে এসব কথা আপনারা আমাদের বলেননি কেন? তিনি বললেন, এটাই তো ভুল। এখন আপনি সামান্য সময় বসুন। আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই। আমি তার সামনে বসে গেলাম। তারপর তিনি কথা বলতে বলতে কিতাব তুলে দিলেন। আমি বললাম। আমি কি প্রতিদিন আপনার কাছে পাঁচ-দশ মিনিটের জন্য আসতে পারি? তিনি বললেন, অবশ্যই আসবেন এবং কোনরূপ সংকোচ করবেন না।
আমি নিয়মিত ইমাম সাহেবের কাছে যাতায়াত শুরু করলাম। যখনই তার কাছে যেতাম কথা শুনতাম আর উঠতে মন চাইতো না। তারপরও তার আরামের কথা ভেবে উঠে আসতাম। পঞ্চম দিন আমি মাওলানা সাহেবের কাছে মুসলমান হওয়ার আবেদন জানালাম।
১৯৯২ সালের ১২ জানুয়ারী এশার পর তিনি আমাকে কালেমা পড়ালেন। তিনি প্রতিদিনই কথা প্রসঙ্গে মাওলানা কালিম সিদ্দীকি সাহেবের কথা বলতেন। সেদিনই আমি হযরতের সাথে সাক্ষাতের প্রোগ্রাম করলাম। রোববার সকালে ফুলাত পৌঁছলাম। আমাদের সাক্ষাতে হযরত মাওলানাও খুব খুশি হলেন। সেদিন তিনি আমার নাম রাখলেন মুহাম্মদ উসমান। এ-ও বললেন, হযরত উসমান রাযি. আমাদের নবীজির অত্যন্ত প্রিয় সাহাবী ছিলেন। তিনি ছিলেন বড় ব্যবসায়ী। প্রচুর দান করতেন। এ কারণেই আপনার নাম রাখলাম মুহাম্মদ উসমান।

হযরত আমাকে মা এবং সন্তানদের মধ্যে দাওয়াতের কাজ করার নির্দেশ দিলেন। অত্যন্ত জোর দিয়ে বললেন, পরিবারের লোকদের সাথে আমার আচরণ বদলাতে হবে। তাদের বেশি করে যত্ম নিতে হবে। তাদের প্রতি খরচের মাত্রাও বাড়াতে হবে। হযরত বললেন, সময়ও বেশি দিতে হবে। মন না চাইলেও তাদের জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের কাছে বসিয়ে দরদ ও মমতার সাথে ‘আপকি আমানত’ পড়ে শুনাতে হবে। তিনি আমাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, একদিন পরিবারের সকলের প্রিয় খাবারের ব্যবস্থা করুন। একসাথে বসে খান। তারপর ‘আপকি আমানত’ পড়ে শুনান। বরং পড়ার আগে তাদের সাথে এমন ব্যবহার করুন যেন তারা শুনার জন্য আবদার করে। তারপর ‘মরনে কে বাদ কেয়া হোগা’ একটু একটু করে পড়ে শুনাবেন।

আহমদ আওয়াহ: তারপর আপনি কিভাবে পরিবারের মধ্যে কাজ শুরু করলেন?
শেখ মুহাম্মদ উসমান: আমি ঘরে ফিরে এলাম। আসার পথে পরিবারের সকলের জন্য তিন চার সেট করে গরম কাপড়, মা এবং স্ত্রীর জন্য কয়েকটি শাল এবং মোজা কিনলাম। তারপর প্রতিদিনই ঘরে ফেরার সময় কিছু না কিছু সকলের জন্যই নিয়ে আসতে লাগলাম। আমার এই হঠাৎ পরিবর্তনে সকলেই বিস্মিত। একদিন আমার স্ত্রী এর কারণ জানতে চাইলো। আমি তার কথাকে এড়িয়ে যেতে চাইলে সে পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। আমি তখন বললাম, আমি মুসলমান হয়ে গেছি। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সবচে’ ভালো মানুষ সে যে তার পরিবারের সাথে উত্তম আচরণ করে। আর সে আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা।
আমার কথায় ইসলামের প্রতি আমার স্ত্রীর আকর্ষণ বেড়ে গেল। একদিন আমি স্ত্রীকে বললাম, আজ ঘরে রান্নার প্রয়োজন নেই। আমি তোমাদের জন্য বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসবো। অত্যন্ত উন্নত মানের একটি রেস্টুরেন্ট থেকে নানা ধরনের খাবার নিলাম। বাসায় গিয়ে সকলে মিলে খুব মজা করে খেলাম। তারপর বললাম, আজ আমি তোমাদের জন্য মানবতার প্রকৃত প্রেমিকের পক্ষ থেকে একটি উপহার নিয়ে এসেছি। দেখো এর নামও কত চমৎকার। ‘আপকি আমানত আপকি সেবা মে’। আজ আমরা এ পুস্তিকাটি পড়বো। এটা কে পড়বে? আমার স্ত্রী বললো, আমি পড়বো। আমি বললাম, ঠিক আছে তুমিই পড়ো। পড়তে পড়তে সে কাঁদতে লাগলো। অবশেষে সে আর পড়তে পারছিলো না। কিতাবটি হাতে নিয়ে আমি পড়া শুরু করলাম। পুরো কিতাবটা শেষ করে দেখলাম। আমার মা-ও কয়েকবার কাঁদলেন। আমি মাকে বললাম, মা! বলো তোমার মত কী? নরকে জ্বলতে না নরক থেকে বাঁচতে চাও? মা বললেন, একটি কয়লা হাতের উপর রাখতে পারি না নরকে জ্বলবো কিভাবে? এই কিতাবে যা লিখেছে একেবারে সত্য লিখেছে।

আমি মাকে কালেমা পড়ার জন্য আবদার করলাম। মা প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তারপর আর কিসের অপেক্ষা? আমার স্ত্রী এবং তিন সন্তানও কালেমা পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। তারা সকলে মিলে আমার মুসলমান হওয়ার একাদশ দিনে কালেমা পড়লো। মাওলানা সাহেব আমার মায়ের নাম রাখলেন আমেনা। স্ত্রীর নাম রাখলেন যায়নাব। আমার দুই ছেলের নাম হাসান ও হুসাইন এবং মেয়ের নাম ফাতেমা। হযরত খুব খুশি হলেন। আমাকে বারবার দুআ দিলেন।

আহমদ আওয়াহ: আপনার ইসলাম গ্রহণের কথা আপনার খান্দানের লোকদের বলেছেন?
শেখ মুহাম্মদ উসমান: হযরত অত্যন্ত কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। কারণ, আমাদের একান্নভুক্ত সংসার। এ কারণে শুরুতে তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। ১৯৯২ সালের অবস্থা তো আপনাদের অজানা নয়। রাষ্ট্রে চূড়ান্ত পর্যায়ের আগুন জ্বলছিল। বাবরী মসজিদের বেদনাদায়ক শাহাদাতের ঘটনা ঘটেছে মাত্র একমাস হলো। এক বছর পর ধীরে ধীরে ব্যাপারটি প্রকাশ পেতে লাগলো। জানাজানি হওয়ার পর খান্দানের লোকেরা প্রচন্ড বিরোধিতা করেছে। হিন্দু সংগঠনগুলো নানাভাবে শাসিয়েছে। বারবার অত্যাচার করেছে। শ্বশুরাালয়ের পক্ষ থেকে আমার স্ত্রীকে এবং সন্তানদের তুলে নিয়ে গেছে। তাদের সাথেও কঠোর আচরণ করেছে। আমি নিজে জামাতে সময় দিয়েছিলাম। তাছাড়া ঘরে নিয়মিত হায়াতুস সাহাবা এবং হেকায়েতে সাহাবা পড়া হতো। স্ত্রী এবং সন্তানদের পড়ে শুনাতাম। আলহামদুলিল্লাহ! তাদের অত্যাচারে আমাদের উপকারই হয়েছে।

আহমদ আওয়াহ: বিশেষ কোনো ঘটনা একটু বিস্তারিত খুলে বলবেন কি? আব্বুর কাছে শুনেছি আপনি নাকি অনেক বড় বড় ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন।
শেখ মুহাম্মদ উসমান: আহমদ ভাই! আসল কথা কী, আমার অনুভূতি হলো, যখনই এসব কথা আলোচনা করি তখনই মনে হয় আমি আমার পূঁজি ক্ষয় করে ফেলছি। তাই এসব ঘটনা যতটা পারি মনের মধ্যেই চেপে রাখার চেষ্টা করি। যদি কোনো ব্যক্তির জীবন বিনাশ হয়ে যায়, তার শরীরের চামড়া তুলে নেয়া হয়, তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় আর তার বিপরীতেও যদি ঈমান বিদায়ের এই সময়ে কোনো ব্যক্তি ঈমানপ্রাপ্ত হয় তাহলে এটা তার অনেক সস্তা অর্জন। আমার সাথে যেসব আচরণ হয়েছে তা খুবই সামান্য। আল্লাহ তায়ালা আমাকে খুবই সস্তায় এবং ফ্রি ঈমান দান করেছেন। মাত্র কয়েক বছরের সামান্য কষ্ট ও অত্যাচারের কথা আমি বলবো। আমার মনে হয় এটা দয়াময় মালিকের বিরুদ্ধে অন্যের কাছে নালিশ করা। তাছাড়া আমাদের সাথে যারা অবিচার করেছে তারা তো বুঝে করেনি। বরং তারা আমার খান্দানেরই মানুষ। এই অত্যাচারে যে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়েছে তাও নয়। আমাদের ঈমানের আলো বৃদ্ধি পেয়েছে। যখনই কোনো বিপদে পড়েছি আমার মনে হয়েছে প্রিয়তম মালিক অত্যন্ত মমতার দৃষ্টিতে আমার এই ত্যাগকে দেখছেন। এই অনুভূতির ফলে বিপদে কষ্টের বদলে আমার কাছে বরং সুখ অনুভূত হয়েছে।

আহমদ আওয়াহ: অবশেষে কি আপনি আপনার এলাকা ছেড়ে দিয়েছিলেন?
শেখ মুহাম্মদ উসমান: হযরতের পরামর্শেই আমি অবশেষে গাজিয়াবাদে নিবাস পেয়েছি। তারপর যখন প্রতিকূলতা কেটে গেছে তখন দাওয়াতের স্বার্থে আবার নিজ এলাকায় ফিরে এসেছি।

আহমদ আওয়াহ: আচ্ছা, মুহাম্মদ ইরফানকে কি আপনি পুনরায় দোকান ভাড়া দিয়েছিলেন?
শেখ মুহাম্মদ উসমান: আমি ভাবলাম, এই ভাড়াটিয়া এবং মার্কেট আমার হেদায়াতের উপলক্ষ হয়েছে। তাই আমি নতুন করে মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনা মুলতবি করে দিই। ইরফানকে দোকানের চাবি ফিরিয়ে দিই। বলে দিই, আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন এই দোকান তুমি করবে। তাকে আমি এক লাখ রুপি করযে হাসানা দিই। আলহামদুলিল্লাহ! তার ব্যবসাও ভালো চলতে শুরু করেছে। তারপর আদালত সাঈদের বিরুদ্ধে দোকান খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এই ঘটনায় সে-ও মাওলানা মঈনুদ্দীন সাহেবের ভক্ত হয়ে যায়। কারণ, মাওলানা সাহেব লালাজির জন্য দুআ করেছিলেন আর-আদালতও লালাজির পক্ষে ফয়সালা করে। সাঈদ গিয়ে বারবার মাওলানা সাহেবের কাছে ক্ষমা চায়। আমার কাছে এসেও ক্ষমা চায়। বলে, আমি আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করেছি। পরিণতিতে আপনাকে মামলায় অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছে। এই টাকা আমি আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। আপনি আমাকে মাফ করে দিন। আমি তাকেও দোকান ফিরিয়ে দিয়েছি।

আহমদ আওয়াহ: শুনেছি অন্যদের মাঝেও আপনি দাওয়াতের কাজ করছেন। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
শেখ মুহাম্মদ উসমান: ব্যস, আল্লাহ তায়ালা আমাকে তাঁর বান্দাদের হেদায়েতের কাজে ব্যবহার করেছেন। কিছু বান্দা হেদায়েত লাভ করেছে। আল্লাহ তায়ালা আমাকে উপলক্ষ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। নতুবা দাওয়াতের মতো মহান কাজের উপযুক্ত তো আমি নই? আমি একটি ইটের ভাটা দিয়েছিলাম। ইটের ভাটায় আগুন দিয়ে উদ্বোধন করার জন্য আমি হযরতের কাছে আবেদন করেছিলাম। হযরত আমার দাওয়াত কবুল করেছেন। বলেছিলেন, এখানে যারা কাজ করবে তাদের মাঝে দাওয়াতের কাজ করতে হবে। তিনিও বলেছিলেন, ইটের ভাটায় দাউ দাউ করে জ্বলা আগুন দোযখের উপলদ্ধিকে সহজ করে দেয়। আপনি চাইলে এটাকেও দাওয়াতের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। আলহামদুলিল্লাহ! আট বছরে একশর চাইতে বেশি শ্রমিক মুসলমান হয়েছে। এর মধ্যে ৮৬ জন এ পর্যন্ত চিল্লা দিয়েছে। এ ছাড়াও আল্লাহ তায়ালা অধমকে বিভিন্ন দ্বীনি কাজে এবং তাঁর বান্দাদের হেদায়েতের উপলক্ষ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এটা তার অনুগ্রহ।

আহমদ আওয়াহ: শুনেছি ভালো কাজে খরচ করার প্রতি আপনার আগ্রহ প্রবাদের মতো?
শেখ মুহাম্মদ উসমান: সত্যকথা হলো, আমরা তো চৌকিদার মাত্র। সম্পদ আমাদের কাছে আমানত। যার যত বেশি তার ভয়ও তত বেশি। আল্লাহ তায়ালার কাছে পাই পাই হিসেব দিতে হবে। আমরা যা খরচ করি তা আমানতের বদলে মালিকানায় চলে যায়। আমি মনে করি, আল্লাহ তায়ালা আমাদের হাতে এই সম্পদ আমানত রেখেছেন। আমরা চাইলে এই আমানত আমাদের স্বার্থে আখেরাতের একাউন্টে সঞ্চয় করে রাখতে পারি। তাছাড়া দেখা গেছে এমন করলে ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। আমি হযরতের কাছে বাইয়াত হয়েছি। দুই বছর যাবত হযরত আমার দায়িত্বে একটি মাদ্রাসা দিয়েছেন। আল্লাহর মেহেরবাণীতে কাজ অনেক সম্প্রাসারিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সবকিছু করে দিচ্ছেন।

আহমদ আওয়াহ: আরমুগানের পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
শেখ মুহাম্মদ উসমান: আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন ইসলামের আমানত অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য। ইসলামের প্রতিটি কথার মধ্যেই আকর্ষণ রয়েছে। আমরা যদি ইসলামের সামাজিক বিষয়, ইসলামের চরিত্র এমনকি ইসলামের ইবাদতগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরি তাহলে এর দ্বারা মানুষ প্রভাবিত না হয়ে থাকতে পারবে না। আমরা আসলে সে কথাটিই ভুলে গেছি। দেখুন এক মুহাম্মদ ইরফান। সে ভুল ব্যবহার এবং আমাদের এই ভারতীয় আচরণ থেকে সরে এসে যখন ইসলামের একটি বিধান মেনেছে তখন তার এই সামান্য পরিবর্তনে কেবল আমার নয় বিশাল একটি শ্রেণীর হেদায়াতের উপলক্ষ হয়েছে। পরিণতিতে তার পার্থিব ক্ষতিও লাভে পরিণত হয়েছে।

আহমদ আওয়াহ: শেট মুহাম্মদ উসমান সাহেব! আপনাকে অনেক অনেক শুকরিয়া। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
শেখ মুহাম্মদ উসমান: আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমাকে আরমুগানের কাফেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছেন। ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

সাক্ষাৎকার গ্রহণে
মাও. আহমদ আওয়াহ নদভী
মাসিক আরমুগান, ডিসেম্বর- ২০০৮

Series Navigation

Archives

March 2024
S S M T W T F
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031