বৃহস্পতিবার, ১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৬শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
ময়ূরী এক সময়ের আলোচিত নায়িকা। রূপালি পর্দা থেকে দীর্ঘ দিন তিনি দূরে আছেন। আসল নাম মুনমুন আক্তার লিজা। এ নায়িকা সম্প্রতি আবার আলোচনায় এসেছেন নতুন সংসারে প্রবেশ করে। তিনি দ্বিতীয়বারের মত বিয়ে করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী শফিক জুয়েলকে।
বিয়ে, চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে যাওয়া ও বিয়ের পর তাবলীগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া নিয়ে তিনি এই প্রথম পূর্ণ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মঈনুল রাকীব ।
-কেমন আছেন?
আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছি।
-কেমন কাটছে নতুন সংসার?
জ্বী ভাল। সকলের দোয়ায় আমরা ভাল আছি।
-শফিকের সঙ্গে পরিচয় কিভাবে?
শফিকের সাথে পরিচয় ফেসবুকে হয়েছে। ও আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। পরে সে মাঝেমাঝে টেক্সট দিতো। আমি একদিন আগ্রহ নিয়ে দেখলাম, কে এই ছেলে যে এইভাবে আমার ব্যাপারে আগ্রহী, আমাকে ফোন করে নাছোড় বান্দার মত। সত্যি বলতে আমি, ওকে বেশি কথা বলার জন্য ওর প্রোফাইলটা দেখলাম। দেখি, হুজুর ধরণের ছেলেটা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশেনা করে। তো ভাবলাম, এই ধার্মিক ছেলে ময়ূরীকে চেনে কিভাবে? পরে বকাঝকা করার উদ্দেশ্যে কথা বলি। কিন্তু কথা বলে আর বকতে পারিনি, ও এত সুন্দর করে কথা বলছে! আমাকে নিয়ে, আমার মেয়েকে নিয়ে, আমার পরিবারকে নিয়ে। কথা হতো, মাঝেমাঝে ফোন দিতো। এই তো পরিচয়। ও ফোন করলে ভাল্লাগতো। কারণ অন্যদের কথার মধ্যে যে লোভনীয় বা নোংরা একটা ব্যাপার ছিল, তা জুয়েলের মধ্যে ছিলনা।
-দেখা হলো কবে?
দেখা হয় পয়লা বৈশাখে। আমাকে ঐ দিন শফিক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে বলে। পরে আমি আমার মেয়ে ও একজন আত্মীয়কে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করি। জাবির বটতলায়। আমি সেদিন সাধারণ একটা পোশাক পরে গিয়েছিলাম যাতে ও চিনতে না পারে। ও চিনতে পারেনি সত্যিই, আমিই ওকে দেখে চিনেছি। সেদিন কথা বলে ওর মধ্যে যে সরলতা দেখেছি তাতে আমি মুগ্ধ হই। আমার মেয়েটা ওকে ভীষণ পছন্দ করে।
-তারপর বিয়ে করে ফেললেন?
না না, বিয়ে করেছি দুই মাস পরে। দেখা হয়েছে এপ্রিলে আর বিয়ে হয়েছে জুনের শেষের দিকে। আমার মেয়ের একটি অপারেশন হয়। তখন আমরা হাসপাতালে ছিলাম খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে। সে সময় শফিক জুয়েল একদিন ওর খালার বাসা থেকে রান্না করে আমাদের জন্য নিয়ে আসে। আসলে তখন আমি এই ওর মধ্যে যে মানুষটাকে দেখেছিলাম তার প্রতি আমার পরিবারের অন্যরাও ইতিবাচক ছিল। (হাসতে হাসতে) আসলে ঐ যে খাবার রান্না করে খাইয়ে জুয়েল আমাকে ঋণী করেছে। এই ঋণ শোধ করতে গিয়ে কথা হতো। খাবারটা আমি আর আমার মামী খেয়েছি। মামীকে বললাম, মামী দেখেন, এই ছেলেটা থাকে ভার্সিটিতে, অথচ কোথা থেকে কষ্ট করে খাবার রান্না করিয়ে নিয়ে আসছে আমাদের জন্য। এটা এ যুগে আশা করা যায়না।
স্বজনরা রাজি হলো এই অসম বিয়েতে?
আমার স্বজন ও হিতাকাঙ্খীদের সঙ্গে কথা বললাম জুয়েলকে নিয়ে। ওরা সবাই বললো যে ছেলেটা ভাল। জীবনে অনেক ছেলেই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। এরকম ইয়াং একটি ছেলে, স্টুডেন্ট, নিজের স্বাভাবিক চাওয়াকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমার তো বদনাম আর বদনাম। কিন্তু এই ছেলেটা মা, বাবা, ভাই, গ্রামের মানুষ, ভার্সিটির সবাই, সমাজের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে নিজেকে কোরবানি দিয়ে আমাকে বিয়ে করতে চায়। একে কষ্ট দেওয়া যাবেনা। ও সেই ২০১৫ থেকে আমাকে ও আমার মেয়েকে খুঁজতেছে। এগুলো শুনে ওর প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। পরে আমি ওকে প্রশ্ন করি, সে কি চায়। ও বলে, আমাকে দ্বীনের পথে আনতে চায়, তাবলীগে নিতে চায়, সুস্থ ও সুন্দর একটি জীবন উপহার দিতে চায়। এমন মানুষকে কষ্ট দেয়া যায়না। আমার প্রথম স্বামী মারা গেলে চেয়েছিলাম আর বিয়ে করবোনা। আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি, যেন বিয়ে কপালে লেখা থাকলে এমন কারো সাথে হয় যে আমাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে বলবে, আমার চেহারা যেন আর দেখাতে না হয়। তখন মনে হলো, আল্লাহ মনে হয় এই ছেলেকে পাঠাইছে। তো জুয়েল, ওর তাবলীগের সাথী আকরাম ভাই উনাদের ব্যবহার দেখে আমার খুব ভাল লাগে। এসব কারণেই ওকে বিয়ে করতে সিদ্ধান্ত নিই। তার ওপর আমার মেয়েটাও জুয়েলকে ভীষণ পছন্দ করে।
-আপনার মেয়ে তাহলে আপনার দ্বিতীয় স্বামীকে মায়ের জন্য পছন্দ করেছে?
হাহাহা, তা বলা যায়। হ্যাঁ। আসলে আমার বিয়ে করার ইচ্ছা ছিলনা। অনেকেই বিয়ে করতে চেয়েছে, আমার মেয়ে মায়মূনা ফিরিয়ে দিয়েছে। অনেকে সম্পদের জন্য বিয়ে করতে চেয়েছে, তাদের সরিয়ে দিয়েছি। অনেক পরে জুয়েল আসে আমার জীবনে। তারপর বিয়ে করি। বিয়েতে আমার মেয়েটা ভীষণ খুশি হয়েছে। ও প্রথম দিন জুয়েলকে দেখে বলেছিল, ‘আম্মু, তোমার এই ভক্তটা না অনেক সুন্দর’। জুয়েলকে ও বাবা বলে এবং জুয়েলও মেয়ের মতই যত্ন করে। বলতে পারেন, মেয়ের পছন্দেও বিয়েটা করছি। এখন আমরা সুখে আছি।
-আপনাদের বিয়ের পর সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বয়সে তরুণ শফিক অনেক চাপে ছিল। সে সময়টায় আপনার কেমন কেটেছে?
আমার জন্য ও অনেক কষ্ট সহ্য করছে, এখনো করছে। আমার স্বামী অনেক আঘাত পেয়েছে। আমার খুব খারাপ লাগছে তখন। আমি কান্নাকাটি করছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করছি ওকে যেন ধৈর্য ধারণ করতে দেন এবং আমাদের যেন সুখে রাখেন। ধীরে ধীরে এখন আমাদের জীবনটা মসৃণ হয়ে উঠছে আল্লাহর রহমতে। ওর গ্রামের মানুষেরাও ওকে ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে।
-আপনার কি মনে হয় জুয়েল আপনার অর্থ-বিত্ত বা খ্যাতি এসব কোন কারণে আপনাকে বিয়ে করেছে?
না, কিছুতেই না। তাহলে তো ও আমাকে ফের চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে বলতো। ও তো আমাকে নিয়ে তাবলীগ জামাতে যেতোনা যেখানে দুনিয়ার কোন স্বার্থ জড়িত নেই। আল্লাহ যেন তিল পরিমাণ আমার মনে ওর প্রতি এমন ধারণা জন্ম না দেন।
-সংবাদমাধ্যমে আপনাদের বিয়ের ব্যাপারে নানা কথা আসছে তা দেখেছেন?
হ্যাঁ, অনেক সংবাদমাধ্যমই আমাদের সঙ্গে কথা না বলে অসত্য তথ্য প্রকাশ করছে। এটা ঠিক নয়। এটি আমার দ্বিতীয় ও জীবনের শেষ বিয়ে। তৃতীয় বিয়ের গুজব ঠিক নয়। আর আমি সকল সাংবাদিক ভাইদের প্রতি অনুরোধ করি, যে সময়টার ময়ূরী আমি হতে চাইনা, সেই অতীত সময়ের ছবি দিয়ে যেন সংবাদ প্রকাশ না করা হয়। আমিও মানুষ। আমার সংসার আছে, সন্তান আছে, আমার ব্যক্তিগত জীবনের প্রাইভেসি প্রতি দয়া করে শ্রদ্ধা পোষণ করুন। অতীতের ময়ূরীকে দিয়ে আমার বর্তমান জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেননা।
-অতীতে যে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন সে ব্যাপারে আপনার এখনকার প্রতিক্রিয়া কী?
আমি ক্লাস নাইনে থাকতে একজন পরিচিত আমাকে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে নিয়ে আসে। সে সময় আমি অনেক ছোট ছিলাম। ১৪-১৫ বছরের মেয়ে। আমি ক্যামেরার কারসাজি বুঝতাম না। আমাকে তখনকার বড় বড় নায়িকার ভিডিও, ছবি দেখিয়ে বলা হতো, তারা যদি এমনভাবে অভিনয় করতে পারে, তুমি পারবেনা কেন? সে অনেক কথা। সে সব কথা বললে অনেকের মুখ থাকবেনা। আমার সঙ্গে কোন নায়ক সে সময় অভিনয় করেনি? পরিচালক, প্রযোজকরা আমাকে যেভাবে উপস্থাপন করেছে বাণিজ্যিক স্বার্থে তা যখন আমি বুঝতে পারলাম তখন সরে আসি। আর তখনই ওরা কাটপিস ব্যবহার শুরু করে, আমি সেগুলো জানতে পেরে কষ্ট নিয়ে এফডিসি ছেড়েছি। পিছনের সেই সব দিনের কথা আর মনে করতে চাইনা। এখন সামনে এগিয়ে যেতে চাই মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে।
-সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার বিয়ে নিয়ে আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। জানেন?
জানি। অনেকেই আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। অনেকেই আক্রমণ করে কথা বলেছে। সবচেয়ে কষ্ট লেগেছে কিছু মেয়ে আমাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করছে। আমি একটি মেয়ে, এই মেয়ের প্রতি এসব মেয়েদের এমন ধারণা দেখে কষ্ট পেয়েছি। ওরা কিভাবে আরেকটি মেয়ের নতুন জীবন নিয়ে এমন করতে পারলো? নারী বলেই আমার প্রতি সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি। আমার সাথে অভিনয় করা নায়কদের ব্যাপারে ওরা কিছু বলেনা। যেসব ছেলেরা শফিক জুয়েলকে নিয়ে কথা বলে তাদের বলবো, জুয়েলের মত এমন সিদ্ধান্ত কয়জন নিতে পারবে? একটি বিধবা মেয়েকে যে শফিক বিয়ে করেছে তার মত বুকের পাটা কজনের আছে?
-জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শফিকের বন্ধু, সিনিয়র ও জুনিয়রদের উদ্দেশ্য কিছু বলবেন?
সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
-ভবিষ্যতে কী পরিকল্পনা আছে?
আপাতত পরিকল্পনা দুজনে মিলে এক চিল্লার উদ্দেশ্যে তাবলীগ জামাতে যাবো। তারপর অন্যান্য কিছু। আমরা বিয়ে করেছি শবে কদরের রাতে। শফিকের সাথে হজ্জ্ব করতে যাবো ২০১৯ বা ২০২০ সালে।
-ভক্ত, পাঠক, দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার আছে?
দেশবাসীর কাছে অনুরোধ, আমাকে খারাপ চোখে দেখবেন না। আমি আপনাদের মা-বোনের মত। আমি যে অবস্থানে আছি সেরকম যে কোন মেয়ের জীবনে ঘটতে পারতো। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করবেন না। অন্তত আমার স্বামী শফিক জুয়েলকে নিয়ে কোন খারাপ কথা বলবেননা, কারণ ও অনেক সরলমনা একটি ছেলে। সে কোন হাসিঠাট্টার কাজ করে নাই, সে অনেক বড় একটা কাজ করেছে। আমার মেয়ে ও জুয়েলকে নিয়ে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত যেন সুখে-শান্তিতে ঈমান নিয়ে বাঁচতে পারি সে জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
লেখক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ইত্তেফাক/আনিসুর,