শুক্রবার, ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি
মুফতি রিদওয়ানুল কাদির
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া টেকনাফ
আমরা এমন এক ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হবো, যার কথা আমরা এতদিন বই পুস্তকে পড়েছি, কিন্তু তাকে দেখা হয়নি। অনেকেই তো মনে করছেন, তিনি পরপারের যাত্রী হয়েছেন সেই কবে! কিন্তু জেনে আশ্চর্য হবেন, তিনি এখনও জীবিত আছেন।
আসুন পরিচিত হই মুহাদ্দিস ও মুহাক্কিক এ আলেমে দীনের সাথে। তিনি মাওলানা শিব্বির আহমদ বিন হোসাইন আলী।
অল্প শব্দে তাঁর পরিচয় দেয়া মুশকিল। তবুও এতটুকু বলতে পারি, একাধারে তিনি একজন আলেমে দ্বীন, শাইখুল হাদীস, বহু কালজয়ী গ্রন্থপ্রণেতা। সর্বোপরি একজন মজলুম, মুহাজির আলেমে দ্বীন।
জন্ম ও পড়ালেখা
তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন আনুমানিক ১৯৫৩ ঈসায়ীতে। তাঁর বাবা হোসাইন আলী রহ.।
মিয়ানমারে তাদের স্থায়ী নিবাস ছিল উত্তর মংডুর রাংগাবালি গ্রামে। প্রাথমিক পড়াশোনার পাঠ চুকিয়েছেন নিজ গ্রামেই। উচ্চমাধ্যমিক পড়ালেখাও শেষ করেন সেখানেই।
এরপর চলে আসেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের স্বনামধন্য দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় জামাতে উলা (মিশকাত) কৃতিত্বের সাথে শেষ করেন। এরপর দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) পড়ার জন্য ভর্তি হন উম্মুল মাদারিসখ্যাত দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে। হাটহাজারী থেকেই তিনি ১৪০৪ হিজরিতে দাওরায়ে হাদিসের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজগতে
দাওরায়ে হাদিস শেষ করার পর বাংলাদেশের অনেক মাদরাসা তাকে নিয়োগ দিতে চাইলেও তিনি মাতৃভূমির ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান নিজ দেশে। সেখানে বিভিন্ন মাদরাসায় তখন থেকে এ পর্যন্ত ইলমের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন।
শাইখুল হাদীস
শুরু থেকেই তিনি হাদিসের খেদমতের সাথে জড়িত ছিলেন। বিশেষত কুরআনুল কারিমের পর সর্বাধিক বিশুদ্ধতম গ্রন্থ সহিহুল বুখারির দরস দিচ্ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। জামিয়া ইসলামিয়া খুদ্দামুল ইসলাম, ঝিমংখালীতে ১৩ বছর, জামিয়া আরবিয়া ইসলামিয়া নংগ বাজারে ৫ বছর এবং জামিয়া আলিয়া শিকদারপাড়ায় তিনি ৩ বছর পূর্ণ বুখারি শরিফের পাঠ দেন। দরসে নেযামীর অন্যান্য কিতাবের পাঠদান তো দিচ্ছিলেনই।
তার হাতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছাত্র। যারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে দ্যুতি ছড়িয়েছেন
লেখালেখি
তাঁর জীবনের সবচেয়ে অনবদ্য দিক হলো, তিনি একজন অসংখ্য কালজয়ী গ্রন্থপ্রণেতা। ছাত্রজীবনেই পদার্পণ করেন লেখালেখির স্বর্ণালি রাজপথে। রচনা করেছেন পাঠকনন্দিত ৬টি মৌলিক গ্রন্থ।
বইগুলো হলো
১. মাআরিবুত্তালাবা (২ খণ্ডে সমাপ্ত )।
২. মাআরিবুল মুসলিহীন ফী তাজকিরাতিল মুবাল্লিগীন (২ খণ্ড)।
৩. মাআরিবুত্তালিবীন ফী খাসায়িসি খাতামিন্নবিয়্যিন।
৪. মাআরিবুল মুহাসসিলিন ফি তাহকীকিল ফরকি বাইনাল উমাম ওয়া খাতমিন্নবিয়্যিন।
৫. চেহেল হাদীস।
৬. তাজকিরাতিল ফয়জ।
সবগুলো পুস্তকই পাঠকসমাজে বেশ সমাদৃত হয়েছে।
মাআরিবুত্তালাবা
উল্লেখিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পাঠকনন্দিত গ্রন্থ হলো মাআরিবুত্তালাবা। মাদরাসাপড়ুয়া এমন কোন ছাত্র পাওয়া মুশকিল হবে, যে এই কিতাবের সাথে পরিচিত নয়।
উর্দু ভাষায় রচিত প্রায় সাড়ে চারশ পৃষ্ঠার ঢাউস এই গ্রন্থটি তিনি রচনা করেছেন হাটহাজারী মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীস পড়াকালীন সময়ে।
বইটির শুরুতে তিনি উল্লেখ করেন, বইটি তিনি রচনা করছেন মূলত সমার্থবোধক শব্দ ও নিকটার্থবোধক শব্দের মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা করার জন্য।
হাটহাজারী মাদরাসার তৎকালীন শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল আযীয রহিমাহুল্লাহ এর জ্ঞানগর্ভ অভিমত বইটির সৌন্দর্যবর্ধনে সহায়তা করেছে।
বইটিকে তিনি সর্বমোট ১২ টি বাবে (অনুচ্ছেদ) বিভক্ত করেছেন। সেখানে তিনি প্রায় ৫২৮ টি সমার্থবোধক শব্দ ও নিকটার্থবোধক শব্দের মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা করেছেন। এই বইয়ে তিনি নিজের পক্ষ থেকে খুব বেশি কথা বলেননি। বরং অধিকাংশ পার্থক্য বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি বেশ শক্তিশালী গ্রন্থের উদ্ধৃতি পেশ করেছেন। যা কিতাবের গ্রহণযোগ্যতাকে নি:সন্দেহে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রত্যেক তালেবুল ইলমের জন্য বইটি অধ্যয়ন করা অতিশয় জরুরি বলে মনে করেন বিজ্ঞমহল।
বইটি প্রকাশ করেছে হাটহাজারীর ফয়জিয়া কুতুবখানা।
ছেলে সঙ্গে মাওলানা শাব্বির আহমদ
জুলুমের দাস্তান
এতক্ষণ তিনি ছিলেন বেশ প্রফুল্ল, হাস্যোজ্জ্বল। কিন্তু যখনই বার্মার সেনাবাহিনীর জুলুমের বিবরণ জানতে চাইলাম, তখনই তার চেহারাটা বিষাদে ছেয়ে গেলো। চোখ থেকে টলমল করে অশ্রু ঝরতে লাগলো। শুরু করলেন মিলিটারীদের পৈশাচিক আচরণের দু:খভরা দাস্তান।
বলতে লাগলেন, নিজের চোখেই দেখেছি অনেক আত্মীয়-স্বজনের টুকরো টুকরো হওয়া শরীর। মানুষ হত্যা করাটা যেন তাদের কাছে একেবারেই নস্যি ব্যাপার। আমার অনেক প্রিয় ছাত্রও ওই জালেমদের হাতে নিমর্মভাবে শাহাদত লাভ করেছে। সারাজীবনই দেখে এসেছি মুসলমানদের সাথে কি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়।
স্বাধীনভাবে আজান দেয়ার উপর ছিলো অলিখিত নিষেধাজ্ঞা। মুসলমানরা ছিলো প্রচণ্ড জুলুমের শিকার। মুসলমানদের গরু-ছাগল বাচ্চা দিলেও থানায় অবহিত করে ট্যাক্স দিয়ে আসতে হতো।
এই তো বর্তমান চলমান গণহত্যার মধ্যেই আমার ৯ জন নিকটাত্মীয়কে জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তারা জীবিত না মৃত, তাও জানি না।
(এ কথা যখন বলছিলেন, তখন তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। উপস্থিত শ্রোতাদের চোখেও অশ্রু টলমল করছিলো।
অবশেষে অনন্যোপায় হয়েই হিজরত করতে হয়েছে বাংলাদেশে।
পারিবারিক জীবন
পারিবারিক জীবনে মাওলানা শিব্বির আহমদ ১১ সন্তানের জনক। ছেলেদের মধ্যে মুহাম্মদ নোমান ও হাফেজ উসমান হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস শেষ করেছে। আর হাফেজ সোলাইমান কাফিয়া জামাতে অধ্যয়নরত।
বর্তমানে শাইখের পরিবার টেকনাফে খুব কষ্টের সাথেই দিনাতিপাত করছেন।
শেষ কথা
বাংলাদেশী মুসলমান ভাইসহ সারাবিশ্বের মানবদরদী মানুষের কাছে তিনি চিরকৃতজ্ঞ। তারা যেভাবে আরকানের মজলুম ভাই বোনদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন তা প্রোকৃষ্ট উপমা হতে পারে কেবল মদীনার আনসাররাই।
পরিশেষে তিনি সবার কাছে দুআ চাইলেন,আল্লাহ যেন অবশিষ্ট জীবনটা ইমান-আমলের সাথে কাটানোর তাওফিক দান করেন।
আরকানের মজলুম মুসলমানরা যেন নিজ মাতৃভূমিতে সম্মানের সাথে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন, সেজন্য তিনি দুনিয়ার সব নিবেদিতপ্রাণ মুসলিমের কাছে দুআ ও সহযোগিতা কামনা করেন।
সুত্রঃ ourislam24.com