তাকদির: আল্লাহ্ই সব করিয়েছেন, আমার কোন দোষ নাই! আসলেই কি তাই??
Admin |
৪৮৩ views |
ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৯ |
নাস্তিকদের প্রশ্নোত্তর
|
২:৫৮ পূর্বাহ্ণ
- আমাদের অনেকের মনেই এরকম প্রশ্ন আসে- আমি খারাপ; এটা কি আমার দোষ? আল্লাহ্ই তো আমার ভাগ্যে খারাপ লিখেছেন। কোন কাজে ব্যর্থ?- আমার পোড়া কপাল! এরকম প্রশ্নও আসে- আল্লাহ্ যেহেতু জানেনই কে বেহেশতে যাবে আর কে জাহান্নামে যাবে, তাহলে দুনিয়াতে পাঠিয়ে এত কষ্ট দেয়ার মানে কি? সরাসরি জাহান্নাম বা জান্নাতে পাঠালেই তো হত! আজকে আমরা এরকম প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো।
- মনে করুন, আপনি কোন পাওয়ার স্টেশন থেকে বিদ্যুৎ নিচ্ছেন এবং সেই বিদ্যুৎ আপনি ইচ্ছামত বিভিন্ন কাজে লাগাচ্ছেন। এখান থেকে আমরা দুইটা পয়েন্ট পাচ্ছি।
- ১। বিদ্যুতের জন্য আপনি পাওয়ার স্টেশন যিনি চালাচ্ছেন তার মুখাপেক্ষী।
- ২। কিন্তু বিদ্যুৎ কি খাতে ব্যবহার করবেন সেটা আপনার ইচ্ছাধীন।
- তারমানে-
- ১। বিদ্যুতের সঠিক/অপ ব্যবহারের জন্য আপনি নিজেই দায়ী, ‘পাওয়ার স্টেশন যিনি চালাচ্ছেন’ তিনি নন।
- ২। কিন্তু যেহেতু ‘পাওয়ার স্টেশন যিনি চালাচ্ছেন’ তার ইচ্ছা ব্যতীত আপনি বিদ্যুৎ পেতে পারেন না, সেহেতু একথা বলা যায়, বিদ্যুতের যে ইচ্ছামত ব্যবহার আপনি করছেন তা ‘পাওয়ার স্টেশন যিনি চালাচ্ছেন’ তার ইচ্ছাতেই করতে পারছেন।
- কেউ যখন বলে “আল্লাহর ইচ্ছাতেই সবকিছু হয়”, তখন সবচেয়ে বড় যে ভুলটা সাধারণত হয় তা হলো আল্লাহর ইচ্ছাকে মানুষের ইচ্ছার মত কিছু একটা বিবেচনা করা হয়। বস্তুত আল্লাহর ইচ্ছা হচ্ছে আমাদের জন্য একপ্রকার শক্তি, যেই শক্তির বলে আমরা ইচ্ছা করতে পারি। আমরা তখনই কেবল ইচ্ছা করতে পারি যখন “আল্লাহর ইচ্ছা” আমাদেরকে ইচ্ছা করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে।
- ১। ইচ্ছা করতে পারব কি না এই ব্যাপারে আমরা আল্লাহর ইচ্ছার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। “আল্লাহর ইচ্ছা” তথা শক্তি ছাড়া আমরা কোন ইচ্ছাই করতে পারি না।
- ২। কিন্তু ইচ্ছা করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি “আল্লাহর ইচ্ছা” কর্তৃক প্রাপ্ত হবার পর আমরা “কী ইচ্ছা করব”- সেই ব্যাপারে আমাদের স্বাধীনতা রয়েছে। [মানুষের ইচ্ছার স্বীকৃতি রয়েছে এমন কিছু আয়াত ১৮:২৯, ২৫:৫৭, ৭৬:২৯, ৭৩:১৯, ৭৮:৩৯, ৮০:১২, ৭৪:৫৫]
- এ ব্যাপারে আরও কিছু বিষয় বলে রাখা প্রয়োজন। সবক্ষেত্রে আমরা স্বাধীনভাবে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে পারবো- ব্যাপারটা এমন না। তবে আমাদের শুধু সে সকল বিষয়েরই হিসাব নেয়া হবে, যে সকল বিষয়ে আমরা স্বাধীনভাবে ইচ্ছা শক্তিকে প্রয়োগ করতে পারবো।
- আর যে সকল বিষয়ে আমাদের কোন হাত নেই, আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এবং তা তাকদিরের কিতাবে লিখেও রেখেছেন। যেমন- কোন মানুষ কখন জন্মাবে, কখন মারা যাবে, সে কতটুকু রিযিক পাবে ইত্যাদি। এসব ব্যাপারে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে না।
- অধিকাংশ বিষয়েই আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা প্রয়োগের ক্ষমতা বা স্বাধীনতা দিয়েছেন। যেমন- ঈমান আনা বা না আনা, হালাল উপায়ে রিযিক অন্বেষণ করা বা হারাম উপায়ে করা, ভাল বা খারাপ কাজ করা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলোর জন্য মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে। এগুলোও তাকদিরের কিতাবে লিপিবদ্ধ করা আছে, কিন্তু এগুলো তাকদির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। প্রশ্ন হল- এটা কিভাবে সম্ভব? তাকদিরের কিতাবে লিপিবদ্ধ করা আছে, কিন্তু এগুলো তাকদির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়! এবার চলুন এই প্যারাডক্সের সমাধান করি।
- প্রথমে ছোট একটা উদাহরন দেই। ধরুন- আপনি কোন পড়াশোনা করেন না। আপনার শিক্ষক আপনার প্রস্তুতি সম্পর্কে অবগত। এখন তিনি যদি পরীক্ষার আগে আপনাকে বলেন যে, আপনি পাশ করতে পারবেন না। আর রেজাল্ট দেয়ার পর যদি দেখা যায়, আপনি সত্যি সত্যিই ফেল করেছেন। সেক্ষেত্রে আপনি কাকে দায়ী করবেন? শিক্ষককে নাকি নিজেকে?! স্রষ্টা আর আমাদের জানাটা ‘কিছুটা’ এরকমই। (তবে এক্ষেত্রে শিক্ষকের ভবিষ্যৎবাণী ভুল হতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্র হবে না)। স্রষ্টা জানেন আমরা কি করবো, কিন্তু এর মানে এই নয় যে তিনি আমাদের কৃতকর্মের জন্য দায়ী। আমরা কি করবো সেটা আল্লাহ্ তার জ্ঞানের কারণে আগে থেকেই জানেন। কিন্তু তিনি জানেন বলেই আমরা ঐ কাজ করবো- ব্যাপারটা এমন নয়।
- আরও একটা উদাহরন দেখি। আমার সামনে দুইটা রাস্তা আছে। ধরা যাক, আমি ডান দিকের রাস্তায় গেলাম। আমি যে ডান দিকের রাস্তায় যাবো- এটা আল্লাহ্ আগে থেকেই জানতেন, তাই তিনি এটা আমাকে দুনিয়াতে পাঠানোর আগেই লিখে রেখেছিলেন। এখন তিনি লিখে রেখেছিলেন বলেই কিন্তু আমি ডান দিকের রাস্তায় যাই নি। বরং আমি ডান দিকের রাস্তায় যাবো দেখে আল্লাহ্ লিখে রেখেছিলেন। আরও একটা ব্যাপার আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সময়কে আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন। তাই তিনি সময়ের উপর নির্ভরশীল নন। আমরা সময়ের গণ্ডিতে বাঁধা। কিন্তু আল্লাহ্ নন। আমাদের কাছে কোন ঘটনা ঘটার আগে সেটা ‘হতে পারে’ অবস্থায় থাকে। কিন্তু আল্লাহ্র কাছে ‘হতে পারে’ বলে কিছু নাই। আল্লাহ্র কাছে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সকল জ্ঞান রয়েছে। সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ জানেন কখন মানুষ কী করবে। এবং এই জানার ভিত্তিতেই আল্লাহ্ তাকদিরের কিতাবে লিখে রেখেছেন মানুষ কি কি করবে।
- এবার আসি বিখ্যাত সেই প্যারাডক্স প্রসঙ্গে- আল্লাহ্ যেহেতু জানেনই কে বেহেশতে যাবে আর কে জাহান্নামে যাবে, তাহলে দুনিয়াতে পাঠিয়ে এত কষ্ট দেয়ার মানে কি? সরাসরি জাহান্নাম বা জান্নাতে পাঠালেই তো হত!
- একটু চিন্তা করলেই বুঝা যায় যে, এটা আসলে কতটা হাস্যকর কথা। যদি আপনাকে কোন কিছু করার সুযোগ না দিয়েই জাহান্নামে পাঠানো হয়- তাহলে আপনি নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ্কে বলবেন- “কেন আমাকে দোযখ দেওয়া হল? আমি কি অপরাধ করেছি?” যারা বেহেস্তে যাবে, তারা কি দাবি করবে না, “কেন আমাকে বেহেশতে ৫০,০০০ একর বাগান দেওয়া হল; কেন ১,০০,০০০ একর বাগান দেওয়া হল না?”
- মানুষকে যদি আল্লাহ্ কোন শাস্তি দেন, তাহলে এটা স্বাভাবিক যে আল্লাহ্ মানুষকে সেই শাস্তি পাবার কারণ কি সেটা দেখাবেন। তা না হলে মানুষ দাবি করবেই কেন তাকে শাস্তি দেওয়া হল। আল্লাহ্ যদি মানুষকে পৃথিবীর জীবনের সুযোগটা না দিয়ে জাহান্নাম বানিয়ে, তাতে সরাসরি মানুষ ভরে দিতেন– তাহলে মানুষ কি সেটা মেনে নিত?
- একই ভাবে মানুষ যখন বেহেশতে যাবে, তার দাবি থাকবে তাকে বেহেশতে যা দেওয়া হয়েছে তা কিসের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। কেন সে কম পেল তার বেহেশতের প্রতিবেশীর থেকে? কেন সে যা পেয়েছে তার থেকে অন্য কিছু পেল না? মানুষ স্বাভাবিকভাবেই দাবি করবে আল্লাহ কিসের ভিত্তিতে তাকে বেহেশতে সেসব দিয়েছে।
- একারণেই মানুষকে পৃথিবীর জীবন দেওয়া হয়েছে যেন মানুষ বেহেশতে যা কিছু পাবে, তা সে নিজে পৃথিবীতে অর্জন করে যেতে পারে।
- ইসলাম একথা বিশ্বাস করতে বলে যে, আল্লাহ্ তার ইলমের দ্বারা জানেন মানুষ কী করবে, তা তিনি তাকদিরের কিতাবে লিখে রেখেছেন। স্রষ্টা অনাদি, অনন্ত, সর্বজ্ঞ। তিনি সময়ের অধীন না। অতীত, বর্তমান ভবিষ্যতের সব জ্ঞানই তার কাছে আছে। সেই জ্ঞান তিনি লিপিবদ্ধ করবেন কি করবেন না, সেটা তার ইচ্ছা। সেটা লিপিবদ্ধ করা বা না করার দ্বারা কারো ওপর কিছু আরোপিত হয় না।
- ইসলাম একথা বিশ্বাস করতে বলে না যে, আল্লাহ তাকদিরের কিতাবে লিখে রেখেছেন বলেই আমরা পৃথিবীতে সব কাজ করি, বা আল্লাহ ‘by force’ আমাদেরকে দিয়ে তাকদিরের কিতাবের লিখিত বিষয়বস্তুর অভিনয় করাচ্ছেন আর আমরা রোবটের মত অভিনয় করে যাচ্ছি! [অথচ আমরা অনেকে তাকদিরকে সেটাই মনে করি, আর সেখানেই আমাদের ভুল।]
- শেষ কথা- আল্লাহ্ই ভাল জানেন তাকদির সম্পর্কে। আমাদের শুধু বিশ্বাস রাখতে হবে।