বৃহস্পতিবার, ১০ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

অমুসলিমদের দাওয়াত দেয়ার ইসলামের বিধান কী?

এপর্যায়ে আমরা আলোচনা করবো অমুসলিমদেরকে দাওয়াত দেয়ার শরয়ী বিধান কি? ফরজে আইন, ফরজে কেফায়া, না সুন্নাত। নিচের আলোচনা থেকে আশা করি বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।

ফরজে আইন
অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াতী কাজ ঐ সময় ফরজ হবে যখন কুফর বিজয়ী থাকবে, সত্য পরাজিত থাকবে, দা‘ঈর সংখ্যা হবে নিতান্তই কম, মন্দকাজ হবে ব্যাপক, মুুর্খতা ও অজ্ঞতা সর্বস্তরে বিরাজ করবে। এমতাবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে সাধ্যানুযায়ী অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াত ফরজে আইন।

সুন্নাত
অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াতী কাজ ঐ সময় সুন্নাত হবে, যখন দা‘ঈদের সংখ্যা থাকবে পর্যাপ্ত। দাওয়াতী সংঘঠন চতুরদিকে ছড়িয়ে পরবে। হক বিজয়ী থাকবে। বাতিল থাকবে পরাজিত। রাষ্ট্র নিজেই দাওয়াতী কাজ আঞ্জাম দিবে। এই অবস্থায় সাধরণ মানুষের উপর দাওয়াতী কাজ করা সুন্নাত।

ফরজে কেফায়া
ওলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, অমুসলিম ভাই-বোনদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া ফরজে কেফায়া। অনেকে বলেছেন সাধ্যানুযায়ী ফরজে আইন। আমরা ফরজে কেফায়াই ধরে নিলাম। এবার আমাদের জানতে হবে ফরজে কেফায়া কাকে বলে?
ফরজে কেফায়া বলা হয় এমন হুুকুম বা কাজ, যা সকল মুসলমানের উপর ফরজ। তবে সকলের পক্ষ থেকে যদি কিছু মানুষ ওই কাজ আদায় করে দেয়, তাহলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে এবং আল্লাহ্্র পক্ষ থেকে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে না। যদি আদায় না করো তাহলে সকলেই গুনাহগার হবে।

সাধারণত ফরজে কেফায়া বলতে আমরা জানাজার নামাযকে বুঝি। কাফন দাফনসহ জানাজার নামায সম্পূর্ণ করতে হলে কমপক্ষে চারজন লোকের প্রয়োজন। একজন ইমাম হলে, বাকি তিনজন মুক্তাদি। দাফনের জন্য কবরের উপরে থাকবে দু’জন। আর লাশটি কবরে নামানোর জন্য কবরে থাকবে দু’জন। মোট কথা, কাফন-দাফন সম্পন্ন হতে হলে মোট চারজন লোকের প্রয়োজন। তাহলে ফরজে কেফায়া আদায় হবে। যদি ফরযে কেফায়া আদায় না হয়, তাহলে ওই মহল্লার সকলেই গুনাহগার হবে এবং সমাপ্ত করার দায়িত্ব পড়বে পার্শ্ববর্তী সকল মুসলমানের উপর। যদি তারাও আদায় না করে, তাহলে পর্যায়ক্রমে সকল মুসলমান গুনাহগার হবে। তদ্রƒপ অমুসলিমদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো হলো ফরজে কেফায়া। প্রত্যেক অমুসলিমের কাছে দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য এমন কিছু লোক থাকতে হবে। যাদের মাধ্যমে তাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে যায়। যদি সকলের কাছে দাওয়াত না পৌঁছে, তাহলে সকল মুসলমান গুনাহগার হবে।

জানাজার নামাযের সাথে মিলালে বোঝা যায়, প্রত্যেক এলাকায় কমপক্ষে চার জন ব্যক্তি এমন থাকতে হবে, যারা সর্বদায় অমুসলিমদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিবে। যদিও চারজন দ্বারা দাওয়াতের ফরজে কেফায়া আদায় হবে না।
প্রিয় পাঠক! এবার আপনার কাছে আমার প্রশ্ন, আপনি বলুন তো দেখি! আপনার এলাকায় (আপনি যে অঞ্চলেরই হোন না কেন।) এমন চারজন ব্যক্তি আছে, যারা সর্বদা অমুসলিমদের দাওয়াত দিচ্ছেন ? যদি এলাকায় না থাকে তাহলে আপনার পুরো জেলায় এমন চারজন মানুষ আছে কি, যারা সর্বদা সকল মুসলমানদের পক্ষ থেকে অমুসলিমদেরকে দাওয়াত দিচ্ছেন ? যদি উত্তর ‘না’ হয়, তাহলে বলুন, আমরা কি ফরজে কেফায়া আদায় করছি? যদি আদায় না করে থাকি তাহলে আমরা কি গুনাহগার হচ্ছি না? অবশ্যই হচ্ছি। আর কতদিন এই ফরজে কেফায়া ছেড়ে দেয়ার গুনাহ মাথায় নিয়ে ঘুরবো? যদি কোন ব্যক্তি এককভাবে দাওয়াত দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি নিজে গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। কিন্তু সমষ্টিগতভাবে সকলেই গুনাহগার হবে।

জিম্মাদারী আদায়ের পদ্ধতি
দাওয়াতী কাজ যেহেতু আমাদের উপর ফরজ। এই কাজ আমাদের করতেই হবে। এখন প্রশ্ন হলো – কীভাবে করবো ? সবাই কি একসাথে দাওয়াত দিবে? সাধ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী একেক জনের কাজের ধরণও ভিন্ন হবে। বিষয়টি বুঝার সুবিধার্থে কুরআন থেকে তিনটি উদাহরণ পেশ করছি । আল্লাহ্্তা’আলা সূরা নামলের মাঝে দুইটি প্রাণীর আলোচনা করেছেন।

পিপীলিকা:
সুলাইমান – এর ঘটনায় আল্লাহ্্তা’আলা বলেছেন, সুলাইমান যখন সৈন্যদের নিয়ে যাচ্ছিলেন, পথে এক স্থানে পিপীলিকার দল গর্ত থেকে বাইরে বের হয়ে এসেছিল। পিপীলিকার রাণী যখন বুঝতে পারলো যে তারা সুলাইমান আ. এরসৈন্য দলের পায়ের নিচে পরে পিষ্ট হয়ে যাবে। তখন রাণীপিপীলিকার দলকে ডাক দিয়ে বললো তোমরা তোমাদের গর্তে প্রবেশ কর। অন্যথায় তোমরা সুলাইমান আ. এর সৈন্যের পদদলিত হয়ে পিষ্ট হয়ে যাবে।
কুরআনে করীম পিপীলিকাদের রাণীকে দা‘ঈ হিসাবে পেশ করেছে। কতো ছোট একটি প্রাণী! তার অন্তরে ছোট একটি ব্যথিত হৃদয় ! তার মধ্যে নিজ জাতিকে বিপদ থেকে বাঁচানোর কতো ফিকির। সে কোন মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি নিজ জাতিকে বিপদ থেকে বাঁচানোর ফিকির করেছে।
কিন্তু আমরা দেখছি আমাদের জাতি ঝাপ দিচ্ছে চিরস্থায়ী জাহান্নামের দিকে। প্রতি মুহর্তে পা ফেলছে ধ্বংসের দিকে। এব্যাপারে আমাদের কোন ফিকির নেই।

হুদহুদ পাখি:
আল্লাহ্্ তা’আলা সূরা নামলে হুদহুদ পাখির ঘটনা আলোচনা করেছেন। হুদহুদ পাখি মুলকে সাবায় গেল। গিয়ে দেখল ওই দেশর রাণী বিলকিস এবং তার পুরো জাতি আল্লাহ্্ তা’লাকে ছেড়ে সূর্যের পূজা করছে। পাখি অস্থির হয়ে গেল। সে সরাসরি ওখানে লোকদের বুঝাতে পারলো না। কারণ তার ভাষা ভিন্ন, আর ওই দেশের ভাষাই ভিন্ন। পাখির ভাষা তারা বুঝতে পারতো না। সুলাইমান আ. পাখিদের ভাষা জানতেন। তাদের কথা বুঝতেন। তাই পাখি সুলাইমান আ. এর দরবারে উপস্থিত হয়ে প্রতিবেশী দেশের খবর দিলো। বলল সেখানে শিরক হচ্ছে। ফলে আপনি দ্রুত কোন পদক্ষেপ নিন। সুলাইমান আ. হুদহুদের কথা শুনে খবরটি যাচাই-বাছাই করলেন। এরপর রাণী বিলকিসের কাছে দাওয়াতী পত্র পাঠালেন। এর ফলে রাণী বিলকিস ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয় ।
একটি সাধারণ পাখির প্রচেষ্টায় একটি দেশের রাণী ইসলাম কবুল করেছে। এর দ্বারা আমরা শিক্ষা অর্জন করতে পারি, আমরা যদি নিজে কোন কারণে দাওয়াতী কাজ না করতে পারি, তাহলে এমন লোককে এই কাজে নিয়োগদেব, যে এই কাজ আঞ্জাম দিতে পারবে। আমরা যদি মাদ‘উর ভাষা না বুঝি তাহলে মাদ‘উর ভাষায় ইসলামী পুস্তিকা বই এবং কুরআন ইত্যাদি প্রকাশ করে বিতরণ করতে পারি।

আমাদের দেশে খ্রিস্টানরা বিভিন্ন বই পুস্তক বিতরণ করে। যেখানে সেখানে ইঞ্জিল বিতরণ করে। এসকেটি নামে ডাক যোগে বই ও প্রচারপত্র বিতরণ করে। এই কাজের জন্য তারা নির্দিষ্ট লোক নিয়োগ দিয়েছে। তারা এর জন্য চেষ্টা মেহনত চালিয়ে যাচ্ছে। এতে সফলতাও অর্জন করছে। যা আমাদের করার ছিল তা আমরা করছি না।

প্রিয় পাঠক! বলুন তো এপর্যন্ত কয়জন অমুসলিমের কাছে কয়টি বই বা কুরআন বিতরণ করেছেন? নিজেরা সরাসরি দাওয়াত না দিতে পারলে কমপক্ষে বই পুস্তক বা পত্রের মাধ্যমে খুব সহজেই দাওয়াত দিতে পারি।

আসহাবে কাহাফের কুকুর:
সূরা কাহাফেআল্লাহতা‘আলাআসহাবে কাহাফের কুকুরের দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। সেই সাত যুবক যুগের বাদশার সামনে হক্বের আওয়াজ উচু করে ছিল। ফলে পুরো রাষ্ট্র তাদের দুশমন হয়ে যায়। তারা তাদের জাতি থেকে দূরে এক স্থানে এসে একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়। তাদের সাথে ছিল একটি কুকুর,যা তাদের পাহারা দিচ্ছিলো।

এর দ্বারা বুঝাগেল যে, কেউ যদি নিজে দাওয়াতী কাজ না করতে পারে অন্যকে দিয়েও করাতে পারছে না তাহলে কমপক্ষে দা‘ঈ ইলাল্লাহ্র সহযোগী ও পাহারাদারী হিসাবে কাজ করবে। দা‘ঈদের প্রয়োজন মিটানোর চেষ্টা করবে।
দাওয়াত ফরজ হওয়ার ব্যাপারে দলিল হিসাবে যে সকল আয়াত পেশ করা হয় তার মধ্যে কয়েকটি নিচে পেশ করা হলো-
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِতোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহ্্র প্রতি ঈমান আনবে।

قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ
বলে দিন এটাই আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহ্্র দিকে দাওয়াত দেই এবং আমার অনুসারীরাও। আল্লাহ্্পবিত্র, আমি অংশীবাদীদের (শিরককারীদের) অন্তর্ভুক্ত নই।

এই আয়াতে সকল উম্মতের উপর দাওয়াতের জিম্মাদারী দেয়া হয়েছে। ইমাম গাজালী রহ. একস্থানে লিখেছেন, যদি কোন এলাকায় কোন কাফের মারা যান, তাহলে সকল মুসলিম জিজ্ঞাসিত হবে।

وَادْعُ إِلَى رَبِّكَ وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
কাফেররা যেন আপনাকে আল্লাহ্্র আয়াত থেকে বিমুখ না করে। সেগুলো আপনার প্রতি অবর্তীর্ণ হওয়ার পর আপনি আপনার পালনকর্তার প্রতি দাওয়াত দিন এবং কিছুতেই মুশরিকদের দলভুক্ত হবেন না।
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
আর সমস্ত মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে বুঝার তাওফিক দান করুন।

Archives

July 2024
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031