রবিবার, ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

শায়েখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা রহ.

সোনারগাঁও থেকে ফিরে জহিরুল ইসলাম সাদী : শায়েখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা রহ. এর করব জিয়ারতে গিয়েছিলাম চোখের পানি আর দরে রাখতে পারলাম না!
যেসব মহান পুরুষ ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষা প্রসারে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন তন্মধ্যে শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শেখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.) ইয়েমেনের অধিবাসী ছিলেন। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আনুমানিক ১২৭৭ খৃস্টাব্দে তিনি দিল্লীতে আগমন করেন। সে সময় গিয়াসউদ্দিন বলবন ভারতবর্ষের শাসনকর্তা ছিলেন।
আল্লাহর এ অলির আগমনে লোকজন খুবই আনন্দিত হয়। অগণিত মানুষ তার দরবারে ভিড় জমাতে থাকে। এক পর্যায়ে তার জনপ্রিয়তা বাদশাহর জনপ্রিয়তাকেও অতিক্রম করে। অবস্থা বেগতিক দেখে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন আবু তাওয়ামাকে বাংলায় পাঠিয়ে দেন। তিনি তদানীন্তন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে এসে ধর্ম প্রচার শুরু করেন। ভারত উপমহাদেশের এই মহাপুরুষ অমর হয়ে থাকবেন তার একটি মহান কর্মের জন্য। তিনি সোনারগাঁওয়ে এসেই ইসলামী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে বর্তমান মোগরাপাড়ার দরগাবাড়ি প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠা করেন একটি বৃহৎ মাদরাসা ও সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, হাদিস ও ইসলামী আইনশাস্ত্রের পাশাপাশি তিনি ভেষজশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, ভুগোলশাস্ত্র এবং রসায়নশাস্ত্রেও বুৎপত্তি অর্জন করেন। গবেষকেরা মনে করেন, তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাই উপমহাদেশে ইলমে হাদিসের সর্বপ্রথম বিদ্যাপীঠ। এলম অর্জনের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা এখানে ছুটে আসত। সে সময় ওই মাদরাসার ছাত্রসংখ্যা ছিল ১০ হাজার। তিনি দীর্ঘ ২৩ বৎসর এখানে হাদিসের শিক্ষা দিয়েছেন।

20170704_160218
সেখানে তিনি একটি খানকাও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘মানজিলে মাকামাত’ নামে তাসাউফ সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তা ছাড়াও ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ফিকাহবিষয়ক যেসব বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেগুলোর সংকলন নিয়ে ফার্সি ভাষায় রচিত ‘নামাজে হক’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে ১৮০টি কবিতা নিপিবদ্ধ আছে। অনেকে এ গ্রন্থটিকে ‘মাছনবী বনামে হক’ নামে অভিহিত করেছেন। গ্রন্থটি ১৮৮৫ খৃস্টাব্দে মোম্বাই থেকে এবং ১৯১৩ খৃস্টাব্দে কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। জানা যায় ব্রিটিশ জাদুঘরের আর্কাইভ ভবনে শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার লিখিত পান্ডুলিপির অস্তিত্ব সংরক্ষতি আছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিশ্বকোষ মতে, তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকেই উপমহাদেশে প্রথম হাদিসের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান শুরু হয়, শায়খ তাওয়ামা এখানে বোখারি, মুসলিম ও মুসনাদে আবু ইয়ালার দরস প্রদান করতেন।

20170704_155810
অল্পদিনের মধ্যে এ প্রতিষ্ঠানের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে অগণিত শিক্ষার্থীরা তার হাদিসের দরসে শরিক হতে থাকে। সুদূর দিল্লী ও সেরহিন্দ থেকে আসা ছাত্ররাও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণের জন্য এখানে হাজির হয়। বহুসংখ্যক হাদিস বিশারদও তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৩৪৫ খৃস্টাব্দে বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় আগমন করেন। তিনি তার ভ্রমণকাহিনীতে এই ঐতিহাসিক মাদরাসার কথা উল্লেখ করেন। বিখ্যাত হাদিসবিশারদ আবু তাওয়ামা (রহ.) ৭০০ হিজরি মোতাবেক ১৩০০ খৃস্টাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পরও বহুদিন এ মাদরাসা চালু ছিল। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কালের পরিক্রমায় এক সময় মাদরাসার শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এখন সেই মাদরাসাটির অস্তিত্ব আর নেই। তবে কালের সাক্ষী হিসেবে ঐতিহাসিক বিদ্যাপীঠটির কিছু ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।

20170704_155822-1
১৮৮৪ সালে ইসলামী দার্শনিক ও চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি হিন্দুস্তান থেকে সোনারগাঁওয়ে আসেন এবং শায়খ আবু তাওয়ামা (রহ.) প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার ধ্বংসাবশেষ ও বেহাল দশা দেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। তিনি এর অদূরে ওই এলাকায় শায়খ শরফুদ্দিনের স্মৃতিকে ভাস্মর করে রাখার জন্য ‘মাদরাসাতুশ শরফ’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করে যান।
ঐতিহ্যবাহী সেই দরসগাহে হাদিসের প্রায় সবটুকু কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও চুন-সুরকির গাঁথুনির প্রধান ফটকটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন তা বিলীন হওয়ার সম্মুখীন। পাশেই ঘুমিয়ে আছেন উপমহাদেশের বিখ্যাত শায়খুল হাদিস হযরত শাহ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.) সেখানে গেলে একটি ভগ্নপ্রায় দালান দেখা যাবে। অবহেলা আর অযতেœ কোনোমতে টিকে আছে দালানটি। স্থানীয় জনসাধারণ জানান, দালানের অলঙ্কৃত তোরণ, প্রশস্ত কক্ষ এবং দোতলায় ওঠা সিঁড়ি প্রমাণ করে যে, দালানটি মাদরাসা হিসেবে ব্যবহৃত হতো, দেয়ালগুলো প্রশস্ত এবং পুরু ইটগুলো ছোট ছোট পাতলা জাফরি ইট। চারপাশের দেয়ালে মেঝের তিন ফুট ওপর থেকে প্রায় ছাদ পর্যন্ত রয়েছে ইটের গাঁথুনিতে করা সেলফ।

20170704_160236
এ থেকেই বোঝা যায়, এটিই ছিল এক সময়ের বিখ্যাত মাদরাসার সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে ময়লা আবর্জনার স্তূপ ও জানালাবিহীন কক্ষ। কক্ষটির ডান পাশ দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে নেমে গেছে একটি সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে দু’জন একসাথে নামার উপায় নেই। ৮ থেকে ১০ সিঁড়ি নামার পর মোড় নিতে হয় হাতের বাঁ দিকে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। গা ছমছম করে। সেখানে ৮ থেকে ১০ বর্গফুটের একটি কক্ষ আছে। কক্ষটির উচ্চতা সর্বোচ্চ ছয় ফুট। লোকশ্রুতি আছে, এটা ছিল হযরত শাহ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর ইবাদত কক্ষ। এটা ‘অন্ধকার কুটির’ নামে পরিচিত। এখানেই তিনি তার শিষ্যদের নিয়ে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন, অনতিবিলম্বে এ মাদরাসাটি সংস্কার করা জরুরি, নইলে অচিরেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে উপমহাদেশের ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থানটি।
হাদিসশাস্ত্রের সাথে এ দেশের প্রাচীন ও নিবিড় সম্পর্কের অন্যতম প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে স্থানটির গুরুত্ব অপরিসীম। যথাযথ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে জনপ্রিয় পর্যটন স্পটে পরিণত করা যেতে পারে এ স্থানটি। এমনকি জাতীয়ভাবে পদক্ষেপ নিলে এটি হতে পারে গবেষণার যোগ্য স্থান। তাই দ্রুত এর সংস্কার জরুরি। এ ব্যাপারে পথমে উদ্যোগ নিতে হবে সরকার ও অত্র এলাকার জনপ্রতিনিধিদের।

Archives

April 2024
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930