শুক্রবার, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

সব হারানো দুই ভাই

একটি খাবার হোটেলের সামনে গলাগলি করে দাঁড়িয়ে আছে দুটি শিশু। দৃষ্টি হোটেলের ভেতরে। কাছে গিয়ে জানা গেল, তারা দুই ভাই। মোহাইয়ের বয়স ১২ বছর ও ইয়াজের ৮ বছর।

চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা ক্ষুধার্ত। মঙ্গলবার দুপুরে যে হোটেলের সামনে তারা দাঁড়িয়ে ছিল, সেটি টেকনাফ শহরের উত্তরে পল্লী বিদ্যুৎ কার্যালয়ের কাছে অবস্থিত। হোটেলটির কোনো নাম বা সাইনবোর্ড নেই। তবে এর খাবারের খ্যাতি স্থানীয় সবার মুখে মুখে। তাই ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু ক্ষুধার্ত হলেও শিশু দুটি সেই খাবারের স্বাদ নিতে পারছে না। কারণ, খাবার কেনার টাকা নেই। কারও কাছে চাইবে, সেই সাহসও পাচ্ছে না। কিংবা অভ্যস্ত নয় বলে ইতস্তত করছিল।
টেকনাফ শহরে এমন দৃশ্য এখন স্থানীয় লোকজনের চোখ সওয়া। অনেক রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর এখন টেকনাফের পথে পথে ঘুরছে। খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকছে। মোহাই ও ইয়াজও যে রোহিঙ্গা।

মোহাই ও ইয়াজের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলে কৌতূহলী অনেকে এগিয়ে এলেন। তাঁরা সাহায্যও করলেন ওদের আরাকানি বাংলা, প্রমিত বাংলায় অনুবাদ করে দিতে। তাতে জানা গেল, এই দুই ভাই সকালেই নৌকায় করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংগদু থেকে শাহপরীর দ্বীপে এসে নেমেছে। তারপর সেখান থেকে ট্রাকে করে এসেছে টেকনাফ শহরে। স্থানীয় কিছু স্বেচ্ছাসেবক ছোট ছোট ট্রাকে করে বিনা ভাড়ায় এপারে আসা রোহিঙ্গাদের শাহপরীর দ্বীপ থেকে টেকনাফ শহরে আনার ব্যবস্থা করেছেন।

নাফ নদী পার হতে নৌকা ভাড়া এখন কিছুটা কমেছে। তবু জনপ্রতি বাংলাদেশি মুদ্রায় দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা লাগছে। ওরা দুই ভাইও নাফ নদী পার হয়েছে, তবে বিনা ভাড়ায়। তাদের প্রতি এই সহানুভূতির কারণ, দুনিয়ায় ওদের আর কেউ নেই। নৌকায় তারা অন্যের মালামাল তুলে ও নামিয়ে দিয়েছে। মাঝিরা তাদের দুঃখের কথা শুনে ভাড়া নেননি।

মংগদুর মংনিপড়া গ্রামের উত্তরপাড়ায় ছিল মোহাইদের বাড়ি। বাঁশ-কাঠের দেয়াল আর গোলপাতার ছাউনির ঘর। বাবা আইয়ুব উদ্দিন কৃষক। অল্প কিছু জমি ছিল। মূলত অন্যের জমিতেই দিনমজুরি করতেন। পরিবারে আর ছিলেন মা আঞ্জুমান আরা ও বড় বোন ১৬ বছরের শাহানাজ বেগম।

মোহাইউদ্দিন আর ইয়াজউদ্দিন: প্রথম আলো

ঘটনা ঘটেছিল ঈদের পরের দিন বিকেলে। বাড়ির পাশেই মাঠে প্রতিদিনের মতো তারা দুই ভাই খেলতে গিয়েছিল। বাড়িতে ছিলেন মা-বাবা আর বোন। ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লোকেরা আগুন লাগিয়ে দেয়। পুরো পাড়াটিই জ্বালিয়ে দিয়েছিল তারা। ওরা দুই ভাই অন্যদের সঙ্গে পালিয়ে যায় পাহাড়ের জঙ্গলে।

ছোট ভাইটির গলা জড়িয়ে মোহাইউদ্দিন যখন দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা বলছিল, একটা পর্যায়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে ইয়াজউদ্দিন। সেই কান্না খানিক পরে সংক্রমিত হয় বড় ভাইয়ের চোখেও।

সকালে শাহপরীর দ্বীপ থেকে রওনা দেওয়ার আগে লোকজনের দেওয়া এক প্যাকেট বিস্কুট খেয়েছিল দুই ভাই। তাদের কান্না, তাদের কষ্ট স্পর্শ করে গেল উপস্থিত অনেকেরই হৃদয়। তাঁরা ওদের ডাকলেন হোটেলের ভেতর।

Archives

March 2024
S S M T W T F
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031