শুক্রবার, ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

নওমুসলিমদের ঈমান জাগানীয়া সাক্ষাৎকার | পর্ব- ০১


ইউটিউবে আমাদের সাক্ষাৎকার গুলো সরাসরি দেখতে ক্লিক করুন 

আব্দুল্লাহ ভাই-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার

 

শুধু ইসলাম কবুল করার অপরাধে আমি আপন ভাতিজী ‘হেরা’কে জীবন্ত আক্সনে পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। জ্বলন্ত আক্সনের ক্সহা থেকে সে আকাশের দিকে, হাত তুলে চিৎকার করে বলছিল, ‘ও আমার আল্লাহ! আপনি আমাকে এই অগ্নিদগ্ধ হেরাকে দেখছেন তো! হে আল্লাহ! আপনি আমাকে; আপনার হেরাকে ভালোবাসেন তো! আপনি তো হেরা ক্সহাকে ভালোবাসেন, আর অগ্নিক্সহায় পড়ে থাকা এই হেরাকেও ভালোবাসেন তাই না! তবে আমার কোন দুঃখ নেই। আপনার ভালোবাসার পর আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আর কিছুর প্রয়োজন নেই।

আহমদঃ আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
আব্দুল্লাহ. ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
প্রশ্ন. আব্দুল্লাহ ভাই! আপনার সম্ভবত জানা আছে, আমাদের ফুলাত থেকে আরমুগান নামে একটি মাসিক উর্দূ পত্রিকা বের হয়। তাতে কিছুদিন যাবত ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণকারী সৌভাগ্যবানদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হচ্ছে। তাই এ ব্যাপারে আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।
উত্তর. (চোখের অশ্র“ মুছতে মুছতে) আহমদ ভাই! আমার মত অধম অত্যাচারীর কথা এই পবিত্র ম্যাগাজিনে দিয়ে একে কেন অপবিত্র করতে চাচ্ছেন?
প্রশ্ন. না আব্দুল্লাহ ভাই! আব্বু মাওলানা কালীম সিদ্দিকী সাহেব (দা.বা.) বলছিলেন যে, আপনার জীবন আল্লাহর কুদরতের এক আশ্চর্য নিদর্শন। আব্বুর ঐকান্তিক আকাক্সক্ষা যে, আপনার সাক্ষাৎকার অবশ্যই আরমুগানে প্রকাশিত হোক। উত্তর. আল্লাহ তা’আলা আপনার আব্বুকে দীর্ঘজীবি করুন। আমি নিজেকে তাঁর শিষ্য ও গোলাম মনে করি। তাই তাঁর আদেশ আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। আপনি যা প্রশ্ন করবেন আমি তার উত্তর দিতে প্রস্তুত।
প্রশ্ন. প্রথমে আপনার পরিচয় দিন?
উত্তর. আমি যদি বলি যে, পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দুনিয়ার বুকে সবচাইতে অত্যাচারী ও পাপাচারী, নিকৃষ্ট বরং হিংস্র প্রাণী এবং সৌভাগ্যবান মানুষ । তাহলে এটা হবে আমার প্রকৃত পরিচয়।
প্রশ্ন. এটাতো আপনার আবেগময় পরিচয়। আপনার পরিবার ও বংশ সম্পর্কে কিছু বলুন?
উত্তর. মুজাফফরনগর জেলার বুরহানা থানার (উত্তর প্রদেশ, ভারত) এক মুসলিম রাজপুত সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামের এক গোয়ালের ঘরে মোটামুটি ৪২-৪৩ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করি। আমার খান্দান ছিল ধার্মিক হিন্দু এবং পেশা ছিল অপরাধ প্রবণতা। আমার পিতা ও চাচা একটি দলের নেতা ছিলেন। বংশগতভাবে লুটপাট, নির্যাতন নিপীঁড়ন, জুলুম-অত্যাচার আমাদের রক্তের সাথে মিশে ছিলো।
১৯৮৭ ইং সনে মিরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় উপস্থিত ছিলাম। সে সময় আমার পিতার সাথে আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্য করি এবং আমরা দু‘জন কমপক্ষে ২৫ জন মুসলমানকে নিজ হাতে হত্যা করি। অতঃপর মুসলিম বিষণœতার আবেগে প্রভাবিত হয়ে ‘বজরং’ দলে যোগদান করি। ১৯৯০ ইং সনে বাবরী মসজিদ শাহাদতকে ইস্যু বানিয়ে শামেলিতে অনেক মুসলমনাকে শহীদ করি।
১৯৯২ ইং বুরহানায় অসংখ্য মুসলমানকে শহীদ করি। এলাকার প্রসিদ্ধ এক বদমাশ; কিন্তু নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিল। তাকে দেখে পুরো এলাকার অমুসলিমরা র্থ র্থ করে কাঁপতো। আমি আমার বন্ধুকে সাথে নিয়ে তাকে গুলি করে দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় করে দিই। এই মুসলিম বিদ্বেষের কারণে এই হিংস্র পশু এমন স্বেচ্ছাচারিতাও করেছে, (দীর্ঘক্ষণ ক্রন্দনরত অবস্থায়) মনে হয় এধরনের বর্বরতা ও স্বেচ্ছাচারিতার কথা আকাশের নিচে যমিনের উপর না কেউ শুনেছে না দেখেছে। না ধারণাও করতে পেরেছে (আবার অনেক্ষণ কাঁদতে থাকেন)।
প্রশ্ন. দয়া করে আপনার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কিছু বলুন?
উত্তর. কুরআন শরীফে ৩০ নং পারায় সূরা বুরূজ নামে একটি সূরা আছে। তার মধ্যে অগ্নিকুন্ডের অধিবাসীদের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন যে, ‘অভিশপ্ত হয়েছে গর্ত ওয়ালারা অর্থাৎ অনেক ইন্ধনের অগ্নিসংযোগকারীরা;’ (সূরা আল বুরূজ ৪-৫) এই সূরাটি মনে হয় আমার জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে। ব্যাস, এতটুকুই যে, তারা আগুনের অধিবাসী এটাই বলা হয়েছে বলুন তো আরবিতে আয়াতটি কী?
প্রশ্ন. قُتِلَ أَصْحٰبُ الاُْخْدُودِ * النَّارِ ذَاتِ الْوَقُودِ ‘অভিশপ্ত হয়েছে গর্ত ওয়ালারা অর্থাৎ, অনেক ইন্ধনের অগ্নিসংযোগকারীরা;’ (সূরা আল বুরূজ ৪-৫)
উত্তর. যদি বলা হয়, দয়া করা হয়েছে আগুনের অধিবাসীদের উপর, তাহলে এর আরবি কী হবে?
প্রশ্ন. رُحِمَ أَصْحٰبُ الاُْخْدُودِ
উত্তর. যদি আমার ব্যাপারে কোন আয়াত অবতীর্ণ হতো, তাহলে এমনই হতো যে ُرحِمَ أَصْحٰبُ الاُْخْدُودِ ।
প্রশ্ন. আপনার পুরো ঘটনা বলুন?
উত্তর. হ্যাঁ ভাই! বলছি কিন্তু কোন মুখ দিয়ে বলবো এবং কোন অন্তর দিয়ে ব্যক্ত করবো। আমার পাথরের ন্যায় অন্তরও এ ঘটনা শোনাতে সাহস পায় না।
প্রশ্ন. তারপরও বলুন, মনে হয় এ ধরনের ঘটনা থেকে অনেক মানুষ শিক্ষা ও নসিহত গ্রহণ করতে পারবে।
উত্তর. হ্যাঁ ভাই! বাস্তবেই আমার ইসলাম গ্রহণ করার ঘটনা প্রত্যেক হতাশ মানুষের জন্য আশার আলো বয়ে আনবে। ঐ দয়াময় আল্লাহ তা‘আলা যখন আমার মতো অত্যাচারীর উপর এমন দয়া করতে পেরেছেন তাহলে অন্যদের নিরাশ হওয়ার অবকাশ কোথায়? শুনুন তাহলে আহমদ ভাই! আমার একজন বড় ভাই ছিলেন, এত অত্যাচার ও অপরাধের পরও দু’ভাইয়ের মধ্যে অন্তহীন ভালোবাসা ছিলো। আমার ভাইয়ের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে ছিলো। আমার কোন সন্তান নেই। ভাইয়ের বড় মেয়ের নাম ছিল হিরা। সে ছিল অভিনব উন্মাদিণী মেয়ে। অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিলো। সে যার সাথে মিশতো; পাগলের মত মিশতো, যার সাথে শত্র“তা করতো পাগলের মতই শত্রুতা করতো। কখনো কখনো আমাদের মনে হতো যে, তার ওপর কোন জ্বীন-পরীর আছর আছে। কয়েকজন বড় কবিরাজকেও দেখানো হয়েছে কিন্তু তার অবস্থা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল।
সে স্কুলে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলো। বড় হয়ে যাওয়ায় তাকে ঘরের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। তার আরও লেখাপড়া করার ইচ্ছা ছিলো। সে কারো অনুমতি ছাড়াই হাই স্কুলের ফরম পূরণ করে। আট দিন পর্যন্ত মানুষের বাড়িতে কাজ করে ফিস জমায় এবং এর দ্বারা বই-খাতা ক্রয় করে। যখন তাঁর পড়া বুঝে না আসত তখন পড়া বুঝার জন্য পাশের বাড়ির ব্রাহ্মণের মেয়ের কাছে যেতো। ব্রাহ্মণের এক ছেলে ছিলো সন্ত্রাসী। জানি না আমার ভাতিজী হিরাকে সে কিভাবে পটিয়েছে। একদিন রাতে সে হিরাকে ভাগিয়ে বারুতের পাশে এক জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে তার গ্র“পের সদস্যরা থাকতো। হিরা তো তার সাথে চলে গেছে কিন্তু সেখানে গিয়ে তার পিতা-মাতার কথা খুব মনে পড়ে এবং সে তার ভুলের উপর অনুতপ্ত হয়। সে চুপে চুপে কাঁদত। সেই দলে ছিল ইদ্রীসপুরের এক মুসলমান ছেলে। একদিন সে হিরাকে কাঁদতে দেখে তার কাছে এর কারণ জানতে চাইলে সে উত্তরে বলল, আমি অল্প বয়সী মেয়ে। কিছু বুঝতে না পেরে এই ছেলের সাথে চলে এসেছি। কিন্তু আমার মান-সম্মানের ভয় হচ্ছে এবং আমার পিতা-মাতার কথা খুব মনে পড়ছে। হিরার প্রতি ঐ ছেলের দয়া হলো এবং সে বললো, আমি মুসলমান। আর মুসলমান তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না। আমি তোমাকে আমার বোন বানাচ্ছি। আমি তোমার ইজ্জত হেফাজত করবো এবং তোমাকে এই জঙ্গল থেকে বের করে নিরাপদে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করবো। সে তার বন্ধুদেরকে বললো, এই মেয়েটিকে খুব সাহসী এবং পাক্কা মনে হচ্ছে। আর আমাদের দলে দু’একটি মেয়েও দরকার, প্রায়ই প্রয়োজন পড়ে। এখন তাকে আমাদের সাথে রাখার উপায় এই হতে পারে যে, তাকে পুরুষের কাপড় পরিধান করানো হোক। বন্ধুরা তার কথা মেনে নিলো। হিরাকে পুরুষের কাপড় পরিয়ে পুরুষ বানিয়ে দেওয়া হলো এবং সে তাকে সাথে নিয়ে ঘুরাফেরা করতে লাগলো। হিরা দেখতে পেলো ১০-১২ জন মানুষের মধ্যে সেই মুসলমান ছেলেটির আচার-ব্যবহার অন্যদের থেকে পৃথক। সে কথায় পাকা ছিলো এবং মানুষকে ভালো পরামর্শ দিতো। যখন মাল বন্টন হতো তখন গরীবদের জন্য একটি অংশ রেখে দিতো। হীরাকে পৃথক কামরায় শোওয়ানোর ব্যবস্থা করতো এবং রাতে পাহারা দিতো যে, কোন হিন্দু এদিকে আসে কি-না। যখন কিছুদিন হিরাকে তার সাথে থাকতে দেখলো তখন তাদের বিশ্বাস হয়ে গেলো যে, সে তাদের দলের সদস্য হয়ে গেছে, তাই তার সাথে পাহারা কমিয়ে দেওয়া হলো।
একদিন সে হিরাকে কোন বাহানায় তার বাড়ি বারুতে পাঠিয়ে দিলো এবং হিরাকে বললো যে, তুমি সেখানে গিয়ে গাড়িতে উঠে আমাদের বাড়ি ইদ্রীসপুর চলে যাবে এবং সেখানে গিয়ে আমার ছোট ভাইকে সব কথা বলবে। তাকে বলবে যে, তোমার ভাই তোমাকে যেতে বলেছে। আর বলবে সে যেন এখানে এসে বলে যে, সেই মেয়েকে বারুত ওয়ালারা সন্দেহবশত পুলিশের হাতে উঠিয়ে দিয়েছে। হিরা এমনই করলো এবং তার ভাই জঙ্গলে এসে বললো, সেই মেয়েকে বারুত ওয়ালারা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। সে তার ভাইকে বলে দিলো, হিরাকে থানায় পাঠিয়ে দাও এবং সেখানে গিয়ে সে বলবে যে, ডাকাতদের একটি দল আমাকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে। আমি কোন রকম পালিয়ে এসেছি। আমার জীবনের ব্যাপারে ভয় হচ্ছে। হিরা এমনই বললো। বারুত ওয়ালারা বুরহানা থানার সাথে যোগাযোগ করলো। সেখানে পূর্বেই সেই মেয়ে ছিনতাইয়ের রিপোর্ট করা হয়েছিলো। বুরহানা থানা ওয়ালারা মহিলা পুলিশ দিয়ে বারুত নিয়ে এলো। হীরাকে ঐ থানা থেকে আমাদের গ্রামে নিয়ে আসা হলো। আমরা তাকে বাড়িতে রাখলাম, কিন্তু এমন খারাপ মেয়েকে রাখিই বা কীভাবে? হিরা বললো, যদিও আমাকে সন্ত্রাসীরা নিয়ে গেছে কিন্তু আমি আমার ইজ্জতকে সংরক্ষণ করেছি। এ কথাটি কারও বিশ্বাস হয়নি। কেউ বিশ্বাস করেনি। শিক্ষিত পরিবার থেকে একটি বিয়ের প্রস্তাব এলো। তারা বললো, ডাক্তারি পরীক্ষা করে নিন। আমরা দুই ভাই তাকে পরীক্ষা করাতে বুরহানার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরিকল্পনা ছিলো, যদি তার ইজ্জত ঠিক থাকে, তাহলে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। অন্যথায় মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেবো।
আল্লাহর মেহেরবানী যে, রিপোর্ট ভালো হয়েছে। তার ইজ্জত সংরক্ষিত আছে। আমরা খুশি মনে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। এরপর থেকে সে মুসলমানদের খুব প্রশংসা করতো এবং বারবার একজন মুসলমান ছেলের ভদ্রতার কারণে তার বেঁচে যাওয়ার কথা বলতো। সে মুসলমানদের বাড়িতে যাতায়াত করতে শুরু করে। সেখানে এক মেয়ে তাকে (দোজখ কা খটকা আওর জান্নাত কি কুঞ্জি নামে) একটি বই দেয়। মুসলমানদের বই পড়তে দেখে আমরা তাকে অনেক মারপিট করি এবং বলি যে, সামনে যদি এ ধরণের বই পড়তে দেখি, তাহলে তোকে জবাই করে ফেলবো। কিন্তু ইসলাম তার মনকে তখন বেষ্টন করে ফেলেছিলো। তার অন্তরের অন্ধকার পর্দা খুলে দিয়েছিলো এবং তার অন্তরকে আলোকিত করেছিলো। সে এক মুসলমান মেয়ের সাথে মাদরাসায় গিয়ে একজন মাওলানা সাহেবের হাতে মুসলমান হওয়ার পর ঘরে শিরকের অন্ধকারে সে হাঁপিয়ে উঠে। সে উদাসীন অবস্থায় সময় কাটায়। হাসি-খুশি মেয়েটি এখন এমন হয়ে গেছে যেন তার সব কিছুই বদলে গেছে। জানি না সে কেমন করে প্রোগ্রাম বানিয়েছে। সে আবার বাড়ি থেকে বের হয়ে এক মাওলানা সাহেবের স্ত্রীর সাথে ফুলাত চলে যায়। আহমদ ভাই! আপনাদের এখানেই ছিলো। মনে হয় আপনার মনে আছে?
প্রশ্ন. হ্যাঁ হ্যাঁ হেরাজী! আচ্ছা, এখন ঐ হেরাজী কোথায়? আমাদের পরিবার তার ব্যাপারে খুবই চিন্তিত। সে তো খুব ভালো মানুষ ছিলো। আচ্ছা! আপনি তাহলে হেরাজীর চাচা?
উত্তর. হ্যাঁ, আহমদ ভাই! আপনার আব্বু তার নাম হেরা রেখেছিলেন। আর সেই নেক বখত মেয়েটির জালেম চাচা হলাম আমিই (কাঁদতে কাঁদতে)।
প্রশ্ন. আগে তো বলুন হেরাজী কোথায়?
উত্তর. বলছি আমার ভাই, বলছি! আমার অত্যাচার ও পশুত্বের কাহিনী মনে হয় আপনার জানা আছে যে, মাওলানা সাহেব (মাওলানা কালীম সিদ্দিকী সাহেব) সতর্কতাবশত; তাকে দিল্লীতে তার বোনের নিকট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং সে সেখানেই থাকতো। ওখানে সে সুন্দর মনোরম পরিবেশ পেয়েছিল। মাওলানা সাহেববের বোনকে রাণী ফুফু বলে সম্বোধন করতো। আপনার আম্মুও তাকে খুব ভালোবাসতেন। তার রাণী ফুফু তাকে অনেক দীনী প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বোধ হয় সে এক দেড় বছর দিল্লীতে ছিলো। ফুলাত এবং দিল্লীতে অবস্থান করায় সে এমন মুসলমান হয়েছিলো যে, যদি এখন কুরআনে হাকীম অবতীর্ণ হতো; তাহলে আহমদ ভাই শহীদ মেয়েটির নাম নিয়েও আলোচনা হতো। ঘরের লোকদের প্রতি তার খুব ভালোবাসা ছিলো। বিশেষত; তার মায়ের প্রতি। তার মা অধিকাংশ সময় অসুস্থ থাকতো।
এক রাত্রে সে তার মাকে স্বপ্নে দেখে যে, তার মা মারা গেছে। ঘুম ভাঙার পর তার মায়ের কথা খুব মনে পড়লো। যদি তার মা বেঈমান অবস্থায় মারা যায়, তাহলে কী হবে! এ কথা মনে করে সে কাঁদতে লাগলো। এমনকি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। বাড়ির সকলেই তাকে সান্তনা দিলেন। সাময়িকভাবে যদিও সে চুপ হয়ে গেলো। কিন্তু বার বার তার স্বপ্নের কথা মনে পড়তে থাকে। সে আপনার আব্বুর কাছে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি চাইলে আপনার আব্বু তাকে বুঝালেন যে, তোমার পরিবার তোমাকে জীবিত থাকতে দেবে না। এর চাইতেও ভয়ের ব্যাপার যে, তোমাকে আবার হিন্দু বনিয়ে দেবে। ঈমানের ভয়ে সে কিছুু দিন থেমে থাকলো। আবার যখন বাড়ির কথা মনে পড়তো তখন বাড়ি যাওয়ার জন্য জিদ করতো।
মাওলানা সাহেব অপারগ হয়ে অবশেষে তাকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলেন। কিন্তু বলে দিলেন যে, পরিবারকে দাওয়াত দেওয়ার নিয়তে বাড়ি যাবে। বাস্তবেই যদি তোমার পরিবারের প্রতি ভালোবাসা থাকে তাহলে সবচাইতে বড় হক হলো, তুমি তাদেরকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেবে এবং তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। হেরা বললো, তারা তো ইসলামকে ঘৃণা করে। তারা কখনোও ইসলাম গ্রহণ করবে না। সে বাড়িতে বলেছিলো, মাওলানা সাহেব তাকে বলেছিলেন, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরকে ইসলামের জন্য খুলে দেবেন। তাহলে তারা কুফর শিরককেও ঘৃণা করবে। যেভাবে এখন ইসলামকে ঘৃণা করে। মাওলানা সাহেব বললেন, তুমিও তো এক সময় ইসলামকে ঘৃণা করতে যেভাবে এখন কুফরকে ঘৃণা করো। আল্লাহর কাছে দো‘আ এবং আমার কাছে অঙ্গিকার করো যে, তুমি বাড়ি গিয়ে তোমার পরিবারকে দোযখ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। যদি তুমি এই নিয়তে বাড়ি যাও তাহলে প্রথমত: আল্লাহ তা’আলা তোমাকে হেফাজত করবেন। আর যদি তোমাকে কষ্টবরণ করতে হয় তাহলে কষ্ট স্বীকার করতে হবে। যা আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামÑএর আসল সুন্নত। যদি তোমাকে তোমার পরিবার মেরেও ফেলে তাহলে, তুমি শহীদ হয়ে যাবে এবং শাহাদাত জান্নাতের সংক্ষিপ্ত রাস্তা। আমার বিশ্বাস যে, তোমার শাহাদাত তোমার পরিবারের হেদায়াতের কারণ হবে। যদি তোমার পরিবারকে দোযখ থেকে বাঁচানোর জন্য তোমার জীবনও দিয়ে দাও এবং তারা হেদায়েত পেয়ে যায়, তাহলে তোমার জন্য সহজ ব্যবসা হবে। মাওলানা সাহেব বলেন, তিনি তাকে দুই রাকাত নামায পড়তে বলেছিলেন এবং তাদের জন্য হেদায়েতের দু’আ এবং দাওয়াত দেওয়ার নিয়ত করে বড়ি যেতে বলেছিলেন। তারপর দিল্লী থেকে ফুলাত এবং ফুলাত থেকে সে বাড়ি এলো। তাকে দেখে আমাদের গায়ে আগুন ধরে গেলো। আমি তাকে জুতা দিয়ে মারপিট করলাম। সে এ কথা তো বলেনি যে সে কোথায় ছিলো। তবে বললো, আমি মুসলমান হয়ে গেছি। এখন আমাকে ইসলাম থেকে কেউ সরাতে পারবে না। আমরা তার উপর কঠোরতা করি আর সে উল্টো কেঁদে কেঁদে আমাদেরকে মুসলমান হতে বলে।
তার মা অসুস্থ ছিলো। দুই মাস পর সে মারা যায়। সে তার মাকে দাফন করানোর জন্য মুসলমানদের ডেকে বলছিল যে, আমার মা আমার সামনে কালেমা পড়েছেন। তিনি মুসলমান হয়ে দুনিয়া ত্যাগ করেছেন। তাই তাকে জ্বালানো-পোড়ানো অন্যায় ও যুলুম হবে। কিন্তু আমরা তাকে কীভাবে দাফন করি। তাকে আমরা জ্বালিয়ে দিলাম। প্রতিদিন এ নিয়ে আমাদের বাড়িতে ঝগড়া-ফাসাদ হতো। সে কখনো তার ভাইকে কখনো তার বাবাকে মুসলমান হতে বলতো। আমরা তাকে তার নানির বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম। তার মামা অবশেষে অপারগ হয়ে আমাকে ও ভাইয়াকে খবর দিয়ে বললো যে, এই বিধর্মীকে আমাদের এখান থেকে নিয়ে যান, প্রতিদিন আমরা তার সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি। আমি বজরং দলের নেতাদের সাথে পরামর্শ করলাম। তারা মেরে ফেলার পরামর্শ দিলো। আমি তাকে গ্রামে নিয়ে আসি। একটি নদীর কিনারায় পাঁচ ফুট একটি গর্ত খনন করি। আমি এবং আমার বড় ভাই তাকে বোনের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার ছলনা করে সে দিকে নিয়ে চললাম।
সে মনে হয় স্বপ্নে জানতে পেরেছিলো। সে গোসল করে নতুন কাপড় পরে আমাকে বললো যে, চাচা! আমাকে শেষ দুই রাকাত নামায পড়তে দিন। দ্রুত নামায আদায় করে বিয়ের কনে সেজে খুশি মনে আমাদের সাথে চলতে লাগলো। লোকালয় থেকে অনেক দূরে এবং রাস্তা থেকে অনেকটা সরে আসার পরও সে একটু জিজ্ঞাসাও করেনি যে, আপনার বোনের বাড়ি কোথায়? একেবারে কাছে গিয়ে হেসে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি আমাকে আপনার বোনের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন, না মুত্যুর বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন? (অনেক সময় কাঁদতে কাঁদতে)
প্রশ্ন. (পানি পান করানো অবস্থায়,) হ্যাঁ ভাই, ঘটনাটি সম্পন্ন করুন।
উত্তর. কোন মুখ দিয়ে স¤পন্ন করবো! হ্যাঁ, শেষ তো করতেই হবে। আমার কাছে একটি ব্যাগে পাঁচ লিটার পেট্রোল ছিলো। হেরার পিতা এবং আমি এই জালেম চাচা দু‘জনে সাথে করে সেই সত্য মুমিনা আশেকা শহীদাকে নিয়ে গর্তের নিকট গেলাম। যা একদিন পূর্বে খনন করে রেখেছিলাম। এই হিংস্র চাচা এই বলে তাকে গর্তে ঠেলে দিলো যে, আমাদেরকে নরক বা দোযখ থেকে কি বাঁচাবি! যা নিজেই তার মজা দেখ। গর্তে নিক্ষেপ করে তার শরীরে সমস্ত পেট্রোল ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। আমার ভাই কাঁদতে কাঁদতে সেই গর্তের দিকে তাকিয়ে থাকলো। জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি তার উপর পড়তেই তার কাপড়ে দ্বাউ দ্বাউ করে আগুন লেগে গেলো।
সে গর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলো এবং জ্বলন্ত আগুনে দাঁড়িয়ে আসমানের দিকে হাত উঠিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, হে আমার আল্লাহ! আপনি আমাকে দেখছেন না? আমার আল্লাহ! আপনি কি আমাকে দেখছেন না? হে আমার আল্লাহ! আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন না? হ্যাঁ অবশ্যই আপনি ‘গারে হেরাকে’ ভালোবাসেন। আর গর্তের মধ্যে জ্বলন্ত হেরাকেও ভালোবাসেন, তাই না? আপনার ভালোবাসার পর আর কোন জিনিসের প্রয়োজন নেই। অতঃপর সে উচ্চস্বরে বলতে লাগলো, পিতাজী! অবশ্যই আপনি ইসলাম গ্রহণ করে নেবেন। চাচাজী! অবশ্যই মুসলমান হয়ে যাবেন (হেঁচকির সাথে কাঁদতে কাঁদতে)। এতে আমি অনেক রাগ করলাম। আমি ভাইয়াকে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে এলাম। ভাইয়া আমাকে বলতে লাগলেন যে, আর একবার তো তাকে বুঝিয়ে দেখতে। কিন্তু আমি এতে রাগান্বিত হলাম, ফেরার (সময় গর্ত থেকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর আওয়াজ শুনতে পেলাম এবং আমরা আমাদের ধর্মীয় কর্তব্য(!)পালন করে বাসায় চলে এলাম। কিন্তু শেষে এ শহীদার ভালোবাসায় এই জানোয়ারের পাথরের মত শক্ত আত্মাও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। আমার ভাই বাড়িতে এসে অসুস্থ হয়ে গেলেন। তার অন্তরে একটি ব্যথা স্থায়ীভাবে বসে গেলো। আর এটাই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ালো। মৃত্যুর দু’দিন পূর্বে আমাকে ডেকে বললেন, আমি জীবনে যা করেছি তো করেছি, কিন্তু আমার মৃত্যু হিরার ধর্মের উপর হবে। তুমি কোনো মাওলানা সাহেবকে ডেকে নিয়ে এসো। আমিও ভাইয়ার অবস্থা দেখে আর স্থির থাকতে পরলাম না, ভেঙে পড়লাম। আমাদের এলাকার ইমাম সাহেবের সাথে দেখা করে তাঁকে বাসায় নিয়ে এলাম। ভাইয়া তাকে কালেমা পড়াতে বললেন। তিনি কালেমা পড়ালেন। তার মুসলিম নাম রাখলেন আব্দুর রহমান। তিনি আমাকে ইসলামি পন্থায় দাফন করতে বললেন। আমার জন্য এ কাজ অত্যন্ত কঠিন ছিলো। কিন্তু আমি আমার ভাইয়ের অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করার জন্য কৌশল অবলম্বন করলাম এবং চিকিৎসার বাহানায় দিল্লীতে নিয়ে গেলাম। এবং হাসপাতালে ভর্তি করলাম। সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। অতঃপর আমি হামদর্দের এক ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করি এবং তাকে বিস্তারিত বললাম। তিনি কিছু মুসলমানকে ডেকে তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করলেন।
প্রশ্ন. আশ্চর্য ঘটনা! আপনি তো আপনার ইসলাম গ্রহণ করার ঘটনা এখনও বলেননি?
উত্তর. এটাই বলছি। ইসলাম থেকে তো দুশমনি কমে গেলো। কিন্তু ভাইয়ার মুসলমান হয়ে মারা যাওয়ায় আমার অন্তরে দুঃখ-বেদনা ছিলো। ভাইয়া মুসলমান হয়ে মারা যাওয়ার কারণে আমার বিশ্বাস হয়ে গেলো যে, ভাবিও মুসলমান হয়ে মারা গেছেন। আমার মনে হচ্ছিল যে, কোনো মুসলমান আমাদের বাড়িতে যাদু করে রেখেছে এবং অন্তরকে বেঁধে রেখেছে যে, শেষ পর্যন্ত এক এক করে সকলেই নিজ ধর্ম ত্যাগ করে মৃত্যুবরণ করবে। আমি অনেক কবিরাজের সাথেও আলোচনা করেছি। এক ব্যক্তির খোঁজে শামেলি থেকে আউন যাচ্ছিলাম। বাসে উঠলাম। বাসটি কোনো মুসলমানের ছিলো। ড্রাইভারও ছিলো মুসলমান। সে ক্যাসেটে কাওয়ালি চালিয়ে রেখেছিলো। কাওয়াল ছিল বৃদ্ধ বয়সী। তার মধ্যে আমাদের নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক বৃদ্ধার খেদমত এবং তার ইসলাম গ্রহণ করার ঘটনা ছিলো। আর স্পিকারটি ছিলো আমার মাথার উপর। বাস ঝিনঝানায় থামলো। সেই কাওয়ালি ইসলাম সম্পর্কে আমার ধারণাকে পাল্টে দিলো।
আমার মনে হলো, যে নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই ঘটনা তিনি মিথ্যা হতে পারেন না। আমি আউনে না নেমে ঝিনঝানায় নেমে গেলাম এবং আমার মনে হলো যে, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে হবে। অতঃপর শামেলীর বাসে উঠলাম। ক্যাসেটে পাকিস্তানের মাওলানা হানিফ সাহেবের ওয়াজ চলছিলো। তাঁর বয়ান ছিলো মৃত্যু ও তার পরের অবস্থা সম্পর্কে। আমার শামেলিতে নামার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু সেই ওয়াজ শেষ হয়নি। শামেলি বাস টার্মিণালে এসে ড্রাইভার ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করে দিলো। আমার বক্তৃতা শোনার খুব আগ্রহ ছিলো। জানতে পারলাম বাসটি মুজাফ্ফরনগর যাবে। তাই বক্তৃতা শোনার জন্য মুজাফফরনগর এর টিকেট কাটলাম। বঘরা গিয়ে বক্তৃতা শেষ হয়ে গেলো। বক্তৃতাটি আমার ও ইসলামের মাঝে দুরত্ব অনেক কমিয়ে দিলো। আমি বুরহানা রোডের ওপর নেমে গেলাম এবং বাড়ি যাওয়ার জন্য বুরহানার গাড়িতে উঠলাম। আমার পাশেই এক মওলানা সাহেব বসেছিলেন। আমি তাকে বললাম যে, আমি ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। আপনি কি এ ব্যাপারে আমাকে কিছু সহযোগিতা করতে পারবেন? তিনি বললেন, আপনি ফুলাত চলে যান এবং মাওলানা কালীম সিদ্দিকী সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করুন। তাঁর থেকে ভালো মানুষ আমাদের এলাকায় আর পাওয়া যাবে না।
আমি ফুলাতের ঠিকানা নিলাম এবং বাড়ি না গিয়ে ফুলাত চলে গেলাম। মাওলানা সাহেব ছিলেন না। তিনি পরের দিন আসার কথা ছিলো। রাতে এক মাস্টার সাহেব মওলানা সাহেবের লিখিত বই ‘আপ কি আমানাত আপ কি সেওয়ামেঁ’ এক কপি দিলেন। এই বইটি পড়ে আমি মুগ্ধ হলাম। মাওলানা সাহেব পরদিন সকালে না এসে রাতে বাসায় ফিরলেন। আমি মাগরিবের পর তার কাছে মুসলমান হওয়ার আকাঙক্ষা ব্যক্ত করলাম এবং বললাম যে, আমি ইসলাম সম্পর্কে জানতে এসেছিলাম কিন্তু ‘আপ কি আমানাত আপ কি সেওয়ামেঁ’ আমাকে শিকার করে নিয়েছে। মাওলানা সাহেব খুব আনন্দিত হলেন এবং ১৩ জানুয়ারি ২০০০ ইং আমাকে কালেমা পড়ালেন।
আমার নাম রাখলেন আব্দুল্লাহ। রাতে সেখানেই অবস্থান করলাম এবং মাওলানা সাহেবের কাছে ১ ঘন্টা সময় নিলাম ও আমার এই নির্যাতনের নির্মম কাহিনী শুনালাম। মাওলানা সাহেব আমার ভাতিজী হেরাকে হত্যা করার কথা শুনে অনেক সময় পর্যন্ত কাঁদতে থাকেন এবং বললেন যে, হেরা আমাদের এখানেই ছিলো। দিল্লীতে আমার বোনের কাছে থাকতো। মাওলানা সাহেব আমাকে সান্ত¡না দিলেন, ইসলাম আপনার পিছনের সমস্ত গুনাহ মুছে দিয়েছে। কিন্তু আমার অন্তর সান্ত¡না পাচ্ছিলো না যে, এ ধরনের হিংস্র অত্যাচারীর ক্ষমা কীভাবে হবে? মাওলানা সাহেব আমাকে বললেন, ইসলাম পিছনের সমস্ত গুনাহ মুছে ফেলে। আপনি এতগুলো হত্যা করেছেন, এখন আপনার সান্ত¡নার জন্য আপনি মুসলমানদের জান বাঁচানোর চেষ্টা করুন। কুরআন বলে যে, সৎ কাজ গুনাহ কে দূর করে দেয়। বর্তমানে আমি আমার মনের সান্ত¡নার জন্য এবং মজলুমের অন্তরকে জাগাবার জন্য বিপদগ্রস্ত, নির্যাতিত নিপীঁড়িত মুসলমানদের সহযোগিতা ও সহ-মর্মিতার চেষ্টা করি। এটা আমার জানা আছে যে, মৃত্যু ও জীবন দেয়ার আমি কে? কিন্তু চেষ্টাকারী তো সম্পাদনকারীর মতই তাই চেষ্টা করি।
গুজরাটের দাঙ্গা হলো। আমি সেই সময়টাকে গনিমত মনে করলাম। আমার আল্লাহর মেহেরবানী যে, তিনি আমাকে খুব সুযোগ করে দিয়েছেন। সেখানে আমি হিন্দু সেজে অনেক মুসলমান কে নিরাপদ স্থানে পৌঁছিয়ে দিয়েছি। অথবা পূর্ব থেকে আশঙ্কা থাকলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছি। প্রথমে গিয়ে হিন্দুদের পরামর্শে শরিক হয়েছি। এভাবে ১০-১১টি হামলার পূর্বেই খবর দিয়ে তাদের গ্রাম থেকে পালাতে সহযোগিতা করেছি। এ কাজ তো আমার আল্লাহ এমন করিয়েছেন যা আমাকে অনেক সান্ত¡না দিয়েছে। আপনি হয়তো শুনেছেন যে, ভাউনগরে এক মাদরাসার ৪০০ ছাত্রকে আগুনে জ্বালিয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা ছিলো। আমি সেখানে থানা ইনচার্জ মি.শরমাকে খবর দিলাম এবং তাদেরকে প্রস্তুত করলাম। সেই দলটি আসার ১০ মিনিট পূর্বে পিছন দিক থেকে নিজ হাতে দেওয়ালটি ভেঙে দিলাম। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ৪০০ নিষ্পাপ শিশুর জান বাঁচানোর উছিলা বানিয়ে দিলেন।
আমি তিন মাস পর্যন্ত গুজরাটে অবস্থান করি। তারপরও আমার জুলুম এত বেশি যে, এই সব কিছু তার সমপর্যায়ের নয়। একবার মাওলানা সাহেব শান্তনা দিয়েছিলেন যে, আল্লাহ তা’আলার রহমতের জন্য অসুবিধা কী? মৃত্যুর সময় বিভিন্ন বাহানা করে দেন। যেই আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে হেদায়াত দান করেছেন, সেই আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করতে কেন সক্ষম নন? এর দ্বারা কিছুটা চিন্তামুক্ত হই। মাওলানা সাহেব আমাকে ইসলাম শেখার জন্য তাবলীগে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আমি দু‘মাসের সময় নিলাম এবং গ্রামের বাড়ি-ঘর জমি-জমা সস্তা দামে বিক্রি করে দিল্লীতে বাসা নেই। আমার স্ত্রী ও দুুই ভাতিজা ও হেরার বোনকে প্রস্তুত করে ফুলাতে নিয়ে কলেমা পড়ালাম। এতে আমার দুই মাসের স্থানে এক বছর লেগে গেলো। তারপর জামা’য়াতে সময় লাগালাম। সর্বদা আমার অন্তর এই চিন্তায় ডুবে থাকতো যে, এতগুলো মুসলমান এবং ফুলের মতো শিশুদের হত্যাকারী কিভাবে ক্ষমার উপযুক্ত হতে পারে? মাওলানা সাহেব আমাকে কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতে বলেছেন। বিশেষ করে সূরা বুরুজ বেশি বেশি পাঠ করতে বলেছেন। এখন আমার সেই সূরাটি অর্থসহ বেশ মুখস্থ আছে। যেমন ১৪০০ বছর আগে আমার আল্লাহ তা’আলা কেমন সত্য কথা বলেছেন! আমার মনে হয় যে, অদৃশ্যের প্রজ্ঞাময় জ্ঞানী এতে আমারই ছবি এঁকেছেন।
قُتِلَ أَصْحٰبُ الاُْخْدُودِ ণ النَّارِ ذَاتِ الْوَقُودِ ণ إِذْ هُمْ عَلَيْهَا قُعُودٌ ণ وَهُمْ عَلىٰ مَا يَفْعَلُونَ بِالْمُؤْمِنِينَ شُهُودٌ
অর্থ. ‘অভিশপ্ত হয়েছে গর্ত ওয়ালারা।  অনেক ইন্ধনের অগ্নিসংযোগকারীরা;  যখন উহারা ইহার পাশে উপবিষ্ট ছিল।  এবং উহারা মু’মিনদিগের সহিত যাহা করিতেছিল তাহা প্রত্যক্ষ করিতেছিল।
-সূরা বুরুজ-৪-৭
আহমদ ভাই! আপনি এই সূরাটি পড়–ন এবং হেরার কম্পন সৃষ্টিকারী আওয়াজের দিকে একটু লক্ষ্য করুন! (হে আল্লাহ! আপনি কি আমাকে দেখছেন না? আমার আল্লাহ! আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন না? হে আল্লাহ! আপনি আপনার হেরাকে ও অনেক ভালবাসেন না! হেরা গুহা থেকে ও আমাকে ভালোবাসেন তাই না! আপনার ভালোবাসার পর আর কারো ভালবাসার প্রয়োজন নেই। পিতাজী! অবশ্যই ইসলাম গ্রহণ করবেন। চাচাজী! অবশ্যই মুসলমান হয়ে যাবেন (হেঁচকির সাথে ক্রন্দনরত)
প্রশ্ন. আল্লাহর শুকরিয়া, আপনি তার কথা মেনে নিয়েছেন। আপনি অত্যন্ত ভাগ্যবান, এই পথভ্রষ্টতার অন্ধকারকে আল্লাহ তা’আলা আপনার জন্য ইসলাম ও রহমতের কারণ বানিয়ে দিয়েছেন।
উত্তর. আহমদ ভাই! আপনি আমার জন্য দু’আ করবেন। আল্লাহ তা’আলা যেন আমাকে ক্ষমা করে দেন এবং আমার দ্বারা এমন কাজ নেন যার দ্বারা আমার মতো জালেমের অন্তর তৃপ্ত হয়ে যায়। বাস্তবেই কুরআনের এই ফরমানের মধ্যে আমার মতো চিকিৎসাহীন রোগীর অনেক বড় চিকিৎসা রয়েছে। যা ভালো খারাপের মাঝে পার্থক্য করে দেয়। গুজরাটের দাঙ্গায় কিছু নিষ্পাপ মুসলমানের সাহায্য ও জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করতে পেরেছি ভেবে আমার দিল খুব শান্তি পায়। খোদা হাফেজ!
সাক্ষাৎকার গ্রহণে
মাওলানা.আহমদ আওয়াহ নদভী
মাসিক আরমুগান, ফেব্রুয়ারি ২০০৫ ইং
অনুবাদ: মুফতি যুবায়ের আহমদ

Archives

March 2024
S S M T W T F
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031