শনিবার, ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

নওমুসলিমদের সাক্ষাৎকার [পর্ব-১০] :: মুহাম্মদ আসজাদ (বিনদ কুমার)-এর সাক্ষাৎকার


একটা স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম এক জায়গায় প্রচন্ড আগুন জ্বলছে। সে আগুনে মানুষ দগ্ধ হচ্ছে। কখনও আগুন উপরের দিকে উঠছে আবার কখনও নিচের দিকে নামছে। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ স্পর্শ করছে। সে ভয়ানক অগ্নি লেলিহানে পড়ে মানুষ চিৎকার করছে। আগুনের শিখা উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। আর আসজাদ দূর থেকে আমাকে বলছে গড্ডু ভাই! এটা হলো দোখযের আগুন। আল্লাহ তায়ালা কালেমার উসিলায় তোমাকে এই আগুন থেকে রক্ষা করেছেন। তার এই কথা শোনার পর আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি বলে বুঝাতে পারবো না এই স্বপ্ন আমার মধ্যে কতোটা ভীতির সৃষ্টি করেছিল। আমার রুমে ঘুমন্ত সঙ্গীদের কথা কোনরূপ ভাবা ছাড়াই আমি লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। ‘আপকি আমানত’ পুস্তিকাটি পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম আসজাদ! তুমি সত্যিই আমার কল্যাণকামী। তুমি আমাকে বিনোদ কুমার থেকে আসজাদ করেছো। তুমি আমার ভালো করেছো, তুমি আমাকে দিয়ে আমার ওয়াদা পূর্ণ করিয়ে ছেড়েছো। আমি জানিনা তুমি কি কোনো শিশু না আল্লাহ তোমাকে অন্য কিছু বানিয়েছেন।


আহমদ আওয়াহ: আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু!
মুহাম্মদ আসজাদ: ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু!

আহমদ আওয়াহ: আসজাদ ভাই! মাশাআল্লাহ আপনার সাথে সাক্ষাত হয়ে গেল। আপনাকে এ নতুন রূপে দেখে কী যে আনন্দ লাগছে!
মুহাম্মদ আসজাদ: আহমদ ভাই! আপনি যখন আমাকে দেখে এতো আনন্দিত হচ্ছেন তখন ভাবুন আমি নিজেকে যখন আয়নায় দেখি তখন আমি কতোটা আনন্দিত বোধ করি! আমি যখন জামাতে ছিলাম তখন বারবার হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী শুনেছি, এমন একটা সময় আসবে যখন মানুষ সকালে মুমিন হবে তো সন্ধ্যায় হবে কাফের। আর সন্ধ্যায় মুমিন হবে তো সকালে হবে কাফের। অর্থাৎ, একদিন এবং এক রাত নিজেকে ঈমানের উপর রাখা মুশকিল হয়ে যাবে। মূলত এখন আমরা সে কালটাতেই আছি। তো যে কালটা ছিল ঈমান চলে যাওয়ার, আল্লাহ আমার মতো অধমকে কোনরূপ প্রার্থনা ছাড়াই ঈমানের ঋণ দান করেছেন। জানিনা আমি কিভাবে আমার মালিকের শুকরিয়া আদায় করবো। আমি যখনই আমাকে আয়নায় দেখি তখন এসব কথা কল্পনা করি। তারপর আমার ভেতর এই অনুভূতি সৃষ্টি হয়, যে ঘর থেকে আমি এই মায়া-মমতা লাভ করেছি আল্লাহ তায়ালা যেন এই খান্দানকে কেয়ামত পর্যন্ত হেদায়েতের বাতিঘর হিসেবে কবুল করেন। মাওলানা কালিম সাহেবের একটি আলোচনা শোনার পর তো আমি এই দুআ পড়তে শুরু করেছি, হে আল্লাহ! তুমি এই খান্দানকে কেবলমাত্র জগতের জন্য নয় বরং সমগ্র জগতের হেদায়েতের উসিলা হিসেবে কবুল করো।

নওমুসলিমদের সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসুন 

আহমদ আওয়াহ: আপনার মতো নেক ও পবিত্র মুসলমানের অন্তর থেকে বের হওয়া এই দুআ পরিবার এবং খান্দানের জন্যে অনেক বড় অর্জন। আল্লাহ তায়ালা আপনার দুআ কবুল করুন। ভাই আসজাদ! আরমুগানের পক্ষ থেকে কিছু কথা বলতে চাচ্ছি।
মুহাম্মদ আসজাদ: হ্যাঁ, অবশ্যই বলুন।

আহমদ আওয়াহ: শুরুতেই আপনার পারিবারিক পরিচয় জানালে ভাল হয়।
মুহাম্মদ আসজাদ: আমার দেশ নেপাল। কাঠমন্ডু থেকে দশ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামে আমার জন্ম। আমার জন্ম তারিখ ২১ শে মে ১৯৮০ সালে। জন্মগতভাবে আমি ব্রা‏‏হ্মণ। আমার পারিবারিক নাম বিনোদকুমার। আদর করে পারিবারের লোকেরা আমাকে গডডু বলে ডাকতো। আমি প্রাথমিক লেখাপড়া নেপালেই করেছি। বাবা মারা গেলে আমার এক আত্মীয় আমাকে দিল্লী নিয়ে এলো। দ্বাদশ শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষার পর আমার সেই আত্মীয়ও মারা গেলেন। তখন আমি উখলা জামেয়া নগরে আপনাদের বাসার কাছেই একটি দোকানে সেলসম্যানের চাকরি নিলাম। সেইসাথে আমি ইউনিভার্সিটিতে বি.কম এ ভর্তি হয়ে গেলাম। আর সেখান থেকেই আমার প্রতি আল্লাহ তাআলার রহম আসা শুরু হয়।

আহমদ আওয়াহ: মাশাআল্লাহ! আশ্চর্যের বিষয় হলো, ২১ শে মে ১৯৮০ যে দিন আপনার জন্ম সেদিনই আমার আব্বাজানের বিয়ে সম্পাদিত হয়।
মুহাম্মদ আসজাদ: বাস্তবেই এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। হয়তো আমার ভাগ্যে হেদায়েত লেখা ছিল। এজন্য যেদিন আমার জন্ম সেদিনই হেদায়েতের বন্ধনও আল্লাহ তায়ালা তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। যদি আপনার আব্বার বিয়ে না হতো তাহলে আসজাদ মিয়ার জন্ম হতো না এবং আল্লাহ তায়ালাও তার উসিলায় আমাকে হেদায়েত দিতেন না। এটা বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপার।

আহমদ আওয়াহ: আসলেই বিষয়টি আমার কাছে বেশ ভালো লাগছে। আপনার জন্ম তারিখ আর আমার আব্বার বিয়ের তারিখ হুবহু মিলে যাচ্ছে। এবার আপনার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি আমাদের বলুন।
মুহাম্মদ আসজাদ: আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন, আপনাদের বাসার কাছেই একটি জেনারেল মার্চেন্টে আমি চাকরি করতাম। আপনার ছোট ভাই আসজাদ মিয়া আমার সামনে দিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জন্য মসজিদে যেত। যেতে যেতে অন্য বাচ্চাদেরও নামাযের তাগিদ করতো। যখন নামায শেষে সে ঘরে ফিরতো তখন মহল্লার নামাযীরা তাকে নানাভাবে বিরক্ত করতো। কেউবা বলতো হযরত আসজাদ! আমাদের এখানে একটু চা পান করুন। আবার কেউ তাকে খাবারের জন্য আহ্বান করতো। সে লজ্জায় পালিয়ে বাঁচতো। আপনাদের বিল্ডিংয়ে এক মুসলমান চৌকীদার থাকতো। সে নামায পড়তো না। আসজাদ মিয়া নিয়মিত তাকে নামাযের জন্য বলতো।, একদিন আমি তাকে বললাম, প্রতিদিন আসজাদ তোমাকে নামাযের জন্য ডাকছে তুমি কথা দিয়েও যাচ্ছ না কেন? বেশ শক্ত করেই বললাম। আসজাদ মিয়া তাকে দোযখের ভয় দেখিয়ে চলে গেল। কয়দিনের মধ্যে সেই চৌকিদারও নামায শুরু করলো। প্রত্যেক নামাযের সময় আসজাদই চৌকিদারকে সঙ্গে করে নিয়ে যেত। একদিন যোহরের নামায পড়তে গেলে চৌকিদারের জুতা চুরি হয়ে গেল। আসজাদ মিয়া তখন ঘর থেকে পয়সা এনে নতুন চপ্পল কিনে দিল এবং বলল, দেখ! তুমি নামায পড়েছ তাই আল্লাহ তায়ালা তোমার পুরনো চপ্পল সরিয়ে নতুন চপ্পলের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

আহমদ আওয়াহ: আম্মু আমাকে বলেছেন যখন চৌকিদারের জুতা চুরি হয়ে গেল তখন আসজাদ ঘরে এসে কান্নাকাটি জুড়ে দিল আর আম্মুকে বললো আম্মু! এই চৌকিদার আর নামায পড়তে যাবে না। তার ধারণা নামায পড়লে ক্ষতি হয়। জুতা চুরি হয়ে যায়। আপনি আমাকে পয়সা দিন আমি তাকে একজোড়া নতুন জুতা কিনে দিই, তাহলে সে নিয়মিত মুসল্লি হয়ে যাবে। তারপর সে ঠিকই চৌকিদারের জন্য নতুন জুতা কিনে আনে। হ্যাঁ বলুন, তারপর কী হলো?
মুহাম্মদ আসজাদ: যখন চৌকিদার নিয়মিত নামাযী হয়ে গেল তখন এল আমার পালা। আসজাদ জানতো না আমি যে হিন্দু। তাছাড়া আমি যখন তাকে দেখতাম আদর করে সালাম দিতাম। আসজাদও আমাকে বলতো গড্ডু ভাই! তুমি দোকানে বসেবসে আযান শোনো অথচ নামাযে যাও না। আযান শুনে যে ব্যক্তি মসজিদে যায় না মসজিদ তার জন্য বদদোয়া করে। আমি তখন আসজাদকে বলতাম তুমি যাও, আমি আসছি। এভাবে দু সপ্তাহ কেটে যায়। প্রতিদিনই সে আমাকে নানাভাবে নামাযের কথা বলতে থাকে। বিশেষ করে আসর-মাগরিব এবং এশার সময় আমাকে ডাকে। আমি তাকে বিভিন্ন কথা বলে পাশ কাটিয়ে যাই।

একদিন আসরের সময় এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো, গড্ডু ভাই! আজ আমি তোমাকে মসজিদে না নিয়ে যাবো না। আমি তখন নিরুপায় হয়ে বললাম, আসজাদ! তুমি জান না, আমি মুসলমান নই! আমার নাম বিনোদ কুমার। তখন সে বলে উঠলো, গড্ডু ভাই! তাহলে তো বিপদ আরও বাড়লো। তুমি বেনামাযীর চে’-ও বড় বিপদের মধ্যে আছ। বললাম, সেটা কিভাবে? আসজাদ বললো, বেনামাযী তো জাহান্নামে গেলেও একদিন মুক্তি পেয়ে বেহেশতে যাবে। কিন্তু বেঈমান অবস্থায় যদি কোনো ব্যক্তি মারা যায় তাহলে সে জাহান্নামে থাকবে অনন্তকাল। গড্ডু ভাই! তুমি কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে যাও। কথা বলতে বলতে জামাতের সময় ঘনিয়ে এসেছিল। আমি বললাম, আসজাদ তোমার জামাত ছুটে যাবে তুমি এখন যাও।

আসজাদ বললো, আমার তো জামাত ছুটে যাচ্ছে আর তোমার যদি জীবন বেরিয়ে যায় তাহলে তো হিন্দু অবস্থায় মারা গেলে। একবার ভেবেছো, তোমার কত বড় ক্ষতি হবে? আমি বললাম, আচ্ছা আগে নামায পড়ে এসো তারপর কথা হবে। সে নামায পড়ে এসে বারবার নানাভাবে দাওয়াত দিচ্ছে। বলছে, গড্ডু ভাই! তোমার কাছ থেকে আমরা সদাই কিনি। তোমার সাথে আমাদের কত ভালো সম্পর্ক। তোমাকে কালেমা না পড়িয়ে আমি যাচ্ছি না। তোমাকে মুসলমান হতেই হবে। আমি তাকে বলি আসজাদ তুমি এখন যাও, পরে একদিন কথা হবে। সে বললো, এর কী নিশ্চয়তা আছে। আজই তোমার মৃত্যু হয়ে যেতে পারে।

যখন দেখলাম সে নাছোড়বান্দা তখন ভাবলাম, এ একজন শিশু মানুষ। তাছাড়া আহমদ ভাই! এখন আসজাদের বয়স কত হবে! এই এগার বছর। অর্থাৎ, আমার সাথে যখন কথা হচ্ছিল তখন তার বয়স ছিল আট বছর বা তার চে’-ও কম। আমি তখন ভাবলাম, আচ্ছা, এর কথা রাখতে আমার এমন কী অসুবিধা! মূলত তাকে এড়াবার জন্য অথবা তার মনরক্ষার জন্যই আমি বললাম, ঠিক আছে কালেমা পড়িয়ে দাও। আসজাদ আমাকে কালেমা পাড়িয়ে দিলো। আমি হাসতে হাসতে কালেমা পড়ে নিলাম। আসজাদ বললো, গড্ডু ভাই! তুমি একটি মুসলমান নাম রেখে নাও। আমি বললাম, নামও পরিবর্তন করতে হবে? আসজাদ বললো-
আব্বু বলেন নাম পরিবর্তন করা জরুরী নয় তবে ভালো। যখন তুমি কালেমা পড়েই নিয়েছ তখন নামটাও বদলে ফেলো। আমি বললাম, আমার তো তোমার নামটাই পছন্দ। আমি আমার নাম রাখবো মুহাম্মদ আসজাদ। আসজাদ বললো কোনো সমস্যা নেই, আসজাদ নামের অর্থ খুব সুন্দর। এর অর্থ হলো, অনেক বেশি সেজদা আদায়কারী। খুবই চমৎকার নাম। আমি বললাম, তাহলে তো তোমার নাম বদলাতে হবে। সে বললো কোনো? একই নামের তো অনেক ব্যক্তি হতে পারে! কথা বলতে বলতে মাগরিবের সময় হয়ে গিয়েছিল। আসজাদ বললো, এখন তুমি মুসলমান। সুতরাং মসজিদে চলো। আমি তাকে বিভিন্ন বাহানায় এড়িয়ে গেলাম। আসজাদ নামায পড়তে চলে গেল। নামাযের পর আপনার আব্বাজানের লেখা কিতাব ‘আপকি আমানত’ নিয়ে এলো এবং বললো, আসজাদ ভাই! এই পুস্তিকাটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়বে। তারপর বুঝতে পারবে আল্লাহ তায়ালা তোমাকে মুসলমান বানিয়ে কী অনুগ্রহ করেছেন। একবার নয় বইটি তোমাকে বারবার পড়তে হবে।

আমি তার হাত থেকে বইটি নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, ভারী অদ্ভূত ছেলে দেখি! একদম পিছু ছাড়ছে না। তাছাড়া আমি ভেতরে-ভেতরে যেন কারও কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম, একজন ছোট্ট শিশু সে তোমাকে এতটা দরদ ও আন্তরিকতার সাথে কালেমা পড়াচ্ছে, তোমাকে নামাযের কথা বলছে। আর তুমি তা এড়িয়ে যাচ্ছ। আমি আসজাদকে বললাম, অবশ্যই পড়বো। আসজাদ বললো, পাক্কা ওয়াদা কিন্তু। আমি বললাম পাক্কা ওয়াদা। দোকান বন্ধ করে আমি আমার ঘরে চলে গেলাম। খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়লাম। সামান্য সময় পর একটা স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম এক জায়গায় প্রচন্ড আগুন জ্বলছে। সে আগুনে মানুষ দগ্ধ হচ্ছে। কখনও আগুন উপরের দিকে উঠছে আবার কখনও নিচের দিকে নামছে। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ স্পর্শ করছে। সে ভয়ানক অগ্নি লেলিহানে পড়ে মানুষ চিৎকার করছে। আগুনের শিখা উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। আর আসজাদ দূর থেকে আমাকে বলছে গড্ডু ভাই! এটা হলো দোখযের আগুন। আল্লাহ তায়ালা কালেমার উসিলায় তোমাকে এই আগুন থেকে রক্ষা করেছেন। তার এই কথা শোনার পর আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি বলে বুঝাতে পারবো না, এই স্বপ্ন আমার মধ্যে কতোটা ভীতির সৃষ্টি করেছিল। আমার রুমে ঘুমন্ত সঙ্গীদের কথা কোনরূপ ভাবা ছাড়াই আমি লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। ‘আপকি আমানত’ পুস্তিকাটি পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম, আসজাদ! তুমি সত্যিই আমার কল্যাণকামী। তুমি আমাকে বিনোদকুমার থেকে আসজাদ করেছো। তুমি আমার ভালো করেছো, তুমি আমাকে দিয়ে আমার ওয়াদা পূর্ণ করিয়ে ছেড়েছো। আমি জানিনা, তুমি কি কোনো শিশু না আল্লাহ তোমাকে অন্য কিছু বানিয়েছেন। আমার মনে হলো আসর নামাযের পর আমি কালেমা পড়েছিলাম। কালেমা পড়ার পর আমার উপর যে নামাযগুলো ফরয হয়েছে সেগুলো আদায় করা আমার কর্তব্য। তাছাড়া আমি আসজাদের মুখে প্রায়ই শুনতাম, ও নাফিসকে বলতো এক ওয়াক্ত নামায কাযা করলে দুই কোটি আটাশি লাখ বছর জাহান্নামে জ্বলতে হবে। আমি আমার রুমমেট ফরিদকে জাগালাম। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত পর্যন্ত একজন মুসলমানের উপর কয় ওয়াক্ত নামায ফরজ হয়? সে বললো দুই ওয়াক্ত। আমি বললাম, আমাকে তুমি নামাযগুলো পড়িয়ে দাও। সে বললো, এখন আমাকে বিরক্ত করো না এখন ঘুমাও।

আমি তাকে পীড়াপীড়ি করতে লাগলাম। এক সময় আমার প্রতি তার করুণা হলো। সে উঠলো এবং আমাকে ওযু শিখিয়ে দিল। তারপর মাগরিব ও এশার নামায পড়ালো। আমি কোনমতে রুকু-সেজদা করে নামায শেষ করলাম। পরদিন সকালে আমি দোকানে গেলাম। আসজাদ স্কুল থেকে ফিরছিলো। তাকে দেখে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম এবং বললাম, আসজাদ বাসায় ব্যাগ রেখে খাওয়া-দাওয়া করে আমার কাছে চলে এসো। গতকাল আমি তোমার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কালেমা পড়েছিলাম। এখন ‘আপকি আমানত’ পড়ে ইসলামকে ভালো করে বুঝেছি, এবার তুমি আমাকে সত্যি সত্যি কালেমা পড়িয়ে দাও। তারপর আসজাদ আমাকে কালেমা পড়ালো। আমি নিয়মিত মসজিদে যেতে শুরু করলাম। আমার দোকানের মালিকও ছিল মুসলমান। আর দশজন সাধারণ মুসলমানের মতোই ব্যবসায়ী মুসলমান। দুই তিন দিন পর আমার মালিক লক্ষ করলো আমি মসজিদ থেকে আসছি। তখন সে আমাকে বললো, আরে গড্ডু! তুমি মসজিদে গিয়েছিলে কেন? আমি বললাম- আসজাদ জিদ ধরেছিল, আমি ভাবলাম একবার মসজিদে গিয়ে নামায পড়েই দেখি না কেমন লাগে! মালিক বললো তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এখানে ক্রেতা অপেক্ষা করছে আর তুমি! তার কথায় আমার মন ভেঙ্গে গেল। আমি ‘আপকি আমানত’, বইটিতে পড়েছিলাম, একজন মুসলমানের জন্য নিয়মিত নামায পড়া অবশ্য কর্তব্য। তাছাড়া এক ওয়াক্ত নামায কাযা করার যে শাস্তির কথা আসজাদ বলেছিলো সেটা আমার কাছে এতোটাই ভয়াবহ লেগেছিল যে, কোনভাবেই এর খেলাফ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি মনে করতাম, আযান হলো মহান মালিকের পক্ষ থেকে এক আমন্ত্রণবার্তা। একজন সাধারণ গোলামের পক্ষে এটা কিভাবে সম্ভব মালিকের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণবার্তা আসবে আর গোলাম বসে থাকবে? এরচে’ নীচতা আর কী হতে পারে?

আমার মনে হলো। ইনি হচ্ছেন দোকানের মালিক। আমার তো মালিক নন। আমাকে তো মানতে হবে আমার মালিকের কথা। আমি দোকানের মালিকের গোলাম নই। আমি গোলাম বিশ্বজাহানের যিনি মালিক তাঁর। আমি নিয়মিত মসজিদে যেতে থাকলাম। তিন দিন পর আমি মসজিদ থেকে এশার নামায পড়ে ফিরছি, এ অবস্থায় আমাকে দেখে দোকানের মালিক ক্ষেপে গেল। বললো, সকালে মন্দিরে গিয়ে পূজা করতে পারো না? তুমি হিন্দু। তুমি নাপাক। মসজিদে যাও কেন? তুমি মসজিদে গেছো এদিকে আমার দশজন কাস্টমার ফিরে গেছে। আমি বললাম, আমি হিন্দু নই আমি মুসলমান। একথা বলার পর তিনি আমাকে বাসায় নিয়ে গেলেন। খুব গালমন্দ করলেন। আমাকে প্রচন্ডভাবে চাপ দিতে লাগলেন নিজের ধর্মে ফিরে যাওয়ার জন্য। তিনি বারবার বলছিলেন, এটা নিয়ে পুরো এলাকায় দাঙ্গা বেঁধে যাবে। আমি বললাম এটা মুসলমানের এলাকা। আর আমার বাড়ি নেপাল। আমার পরিবারের সাথেও আমার বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। আপনি খামোখা ভয় পাচ্ছেন কেন? যদি কোনো সমস্যা হয় সেটা আমিই দেখবো। আমার কথায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। পায়ের জুতো খুলে আমার উপর চড়াও হলেন। খুবই বিশ্রী রকমের গালাগাল করলেন। মারের প্রচন্ডতায় আমার শরীরের কয়েক জায়গা দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। কিন্তু তার জিদ কমলো না। তিনি বললেন, এখনই আমার সামনে থেকে সরে যা। এই বলে তিনি আমার সামানপত্র বাইরে ছুঁড়ে মারলেন। তখন ছিল ফেব্র“য়ারী মাস। রাত গভীর। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমার বইপত্রগুলো বৃষ্টিতে ভিজছে। আমি তখন কোনো আশ্রয় খুঁজলাম না। মনেমনে প্রার্থনা করলাম, মালিক! আমি তোমার গোলাম। তোমার গোলামির জন্য যদি জীবন দিতে হয় তার জন্য আমি প্রস্তুত। তুমি আমার ঈমানটুকু কবুল করো।

আহমদ আওয়াহ: আসজাদ ভাই! আসলে আমাদের মোটেও জানা ছিল না আপনার প্রতি এমন অবিচার করা হয়েছে। আচ্ছা তারপর কী হলো?
মুহাম্মদ আসজাদ: পরদিন আমি সামানাপত্র তুলে নিয়ে একটি যাত্রী ছাউনীর নিচে বসলাম। এক ভদ্রলোক প্রাইভেট কার নিয়ে তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। যাত্রী ছাউনীর কাছে এসে তিনি গাড়ি থামালেন। আমাকে ডেকে বললেন, আপনি এখানে বসে আছেন কেন? আমি বললাম, এমনিই। তিনি বললেন, না-না। সত্যি করে বলুন! তখন আমার বেশ লজ্জা হলো। ভাবলাম আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে আমার সমস্যার কথা বলবো? ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। বললেন, দেখুন! আল্লাহ তায়ালা আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আর আপনি তো আমাকে বলেননি এখানে গাড়ি থামাও। আল্লাহ তায়ালাই আমাকে এখানে গাড়ি থামাতে বাধ্য করেছেন। সবকিছু আল্লাহ তায়ালাই করেন। তবে আল্লাহ পাক দুনিয়াতে সবকিছু উপায় উপকরণের মাধ্যমে করেন। তার পীড়াপীড়িতে আমি সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে বাধ্য হলাম। তিনি আমার সামানপত্র তার গাড়িতে তুলে নিলেন। বললেন, আজ থেকে তুমি আমার ছেলে। আমার কোনো সন্তান নেই। আমি বললাম, আপনি তো আমাকে ছেলে বানিয়ে পরাধীন করে ফেললেন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আল্লাহ ছাড়া আর কারও গোলামি করবো না। আমি এক শর্তে আপনার সাথে যেতে রাজি আছি, আপনি আমাকে নামায এবং ধর্মীয় কাজে বাঁধা দিতে পারবেন না।

আমার কথা শুনে ভদ্রলোক কাঁদতে লাগলেন। বললেন, একজন মুসলমান না বুঝে তোমার সাথে খারাপ আচরণ করেছে। এর অর্থ এই নয় আল্লাহর পৃথিবীতে আর কোনো মুসলমান নেই। আমি তার সাথে জাফরাবাদ চলে গেলাম। তিনি মুক্তার ব্যবসা করতেন। আলহামদুলিল্লাহ! অনেক বড় ব্যবসা। আমি আগে বি,কম কমপ্লিট করেছিলাম। ছুটিতে তিন চিল্লার জন্য ব্যাঙ্গালোর চলে গেলাম। আমাদের জামাতের আমীর ছিলেন একজন আলেম, তিনি মাওলানা কালিম সিদ্দিকীকে জানতেন। জামাতে থাকাকালীন তিনি আমার অনেক খিদমত করেছেন। তাছাড়া অন্য সাথীদেরও খেদমত করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের সময়টা খুব সুন্দর কেটেছে। জামাত থেকে ফিরে আমি এম.বি.এতে ভর্তি হই। এম.বি.এ কমপ্লিট করার পর একটি আমেরিকান কোম্পানীতে এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে চাকুরি নিই। আলহামদুলিল্লাহ! গুড়গাঁওয়ে কাজ করছি। পূর্ব দিল্লীতে একটি ফ্ল্যাটও কিনেছি।

আহমদ আওয়াহ: আব্বুর সাথে আপনার কবে সাক্ষাত হয়েছিল?
মুহাম্মদ আসজাদ: দোকানে তো প্রতিদিনই দেখা হতো। তিন চিল্লা থেকে আসার পর একদিন নিযামুদ্দিন দেখা হলো। মাওলানার একজন মেহমান তখন নিযামুদ্দিনে অবস্থান করছিলেন। মাওলানা মূলত তার সাথে দেখা করার জন্য এসেছিলেন। নিযামুদ্দিনে প্রধান গেটের সামনে তাঁর সাথে দেখা হয়। তিনি প্রথমে আমাকে চিনতে পারেননি। আমি বললাম, আমি গড্ডু। আপনার বাসার সামনের দোকানে বসতাম। তারপর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমার মুসলমান হওয়ার কাহিনী জানতে চাইলেন। আমি তাকে সমস্ত কাহিনী শোনালাম। তিনি আমাকে বাসায় যাওয়ার জন্য খুব পীড়াপীড়ি করলেন। তার সাথে যখন বাসায় গেলাম আসজাদ অনেক খুশি হলো। বললো, নাফিস আমাকে বলেছিলো, তোমার মালিক তোমার সাথে খুব অবিচার করেছে। আমি আল্লাহ তায়ালার কাছে কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ করেছিলাম, হে আল্লাহ! তুমি এর বিচার দুনিয়াতেই করো। একজন বিদেশী মুসলমানের প্রতি সে অবিচার করেছে। আল্লাহ তায়ালা কিন্তু তার বিচার করেছেন। তার দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। কোটি টাকার প্লট বদমাশরা কব্জা করে নিয়েছে। তার সামানা পত্র ওরা গলিতে ছুঁড়ে ফেলেছে। মহল্লার লোকজন তাকে একসময় খানাপিনা দিত।

এই কাহিনী শুনে আমার মনেও বেশ কষ্ট লাগলো। আমি দুআ করলাম, হে আল্লাহ্! তুমি তাকে মাফ করে দাও। বেচারা ঘরহারা হয়ে পড়েছে। তুমি তাকে ঘরের ব্যবস্থা করে দাও!

আহমদ আওয়াহ: এখন কিভাবে সময় কাটছে?
মুহাম্মদ আসজাদ: আলহামদুল্লিাহ! বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রীও দীনদার গ্রাজুয়েট। পুরনো দিল্লীর পাঞ্জাবী খান্দানের মেয়ে। আমরা খুব সুখে আছি। সেও মেয়েদের সাথে মাস্তুরাত জামাতে বের হয়। তাছাড়া আমি কেনিয়াতেও এক চিল্লা দিয়েছি।

আহমদ আওয়াহ: স্বদেশে আপনার আত্মীয়-স্বজনের কথা কিছু ভেবেছেন?
মুহাম্মদ আসজাদ: এ বিষয়ে আমার স্ত্রী সবসময় আমাকে বলে। আগামী মাসে আমরা কাঠমন্ডুতে যাচ্ছি। দুআ করবেন এই সফর যেন সফল হয়।

আহমদ আওয়াহ: আরমুগানের পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
মুহাম্মদ আসজাদ: আমার ক্ষুদ্র জীবনের এই কাহিনীই এক পয়গাম। এর মধ্যে শিক্ষার অনেক উপকরণ আছে। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে অমুসলিমরা মুসলমানদের কষ্ট দিত। বলত কেন মুসলমান হয়েছো? আর এখন মুসলমানরাই নওমুসলিমদের এই প্রশ্ন করছে। এমন অবস্থায় আমরা কিভাবে নেতৃত্ব পাওয়ার আশা করতে পারি?

আহমদ আওয়াহ: আপনাকে অনেক-অনেক শোকরিয়া। আসলালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু!
মুহাম্মদ আসজাদ: আপনাকেও অনেক শোকরিয়া। ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু!


সাক্ষাৎকার গ্রহণে
মাও. আহমদ আওয়াহ নদভী
মাসিক আরমুগান, এপ্রিল- ২০০৭

Series Navigation

Archives

April 2024
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930