শুক্রবার, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

ঘাড়ের বাতব্যথায় করণীয়

চিকিৎসার পরিভাষায় বলে সার্ভাইকল স্পনডাইলোসিস। আর সাধারণ বাংলায় বলে ঘাড়ের বাত। এ ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের ঘাড়ের অংশের কশেরুকাগুলোর মধ্যকার ডিস্ক বা চাকতিসদৃশ তরুণাস্থির ক্ষয়প্রাপ্তি হবে।

মানুষের মেরুদণ্ড ৩৩টি ছোট ছোট হাড় বা কশেরুকা (ভার্টি ব্রা) দিয়ে তৈরি। ঘাড়ের অংশে থাকে সাতটি কশেরুকা। এই কশেরুকাগুলো একটি অপরটির সাথে ডিস্ক ও লিগামেন্ট দ্বারা সংযুক্ত থাকে। মেরুদণ্ডের ঘাড়ের অংশ সামনের দিকে উত্তলভাবে বাঁকানো। সবচেয়ে বেশি বাঁকানো থাকে পঞ্চ ও ষষ্ঠ কশেরুকার মধ্যকার ডিস্ক বরাবর। এই ডিস্কে স্পনডাইলোসিস বেশি ঘটে, কারণ এই পয়েন্টে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে।

ক্ষয়প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় ডিস্ক তার পানি হারিয়ে ফেলে এবং শুষ্ক হয়ে ওঠে। সুস্থ অবস্থায় ডিস্কগুলো নরম, স্থিতিস্থাপক এবং বেশি মজবুত। ডিস্কে যখন ক্ষয় শুরু হয় তখন তার নমনীয় তন্তুগুলো শক্ত হয়ে ওঠে এবং চাপের ফলে ভেঙে যায়। দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিস্ক ক্ষয়ে যায় এবং পাতলা হয়ে যায়। এর ফলে কশেরুকাগুলোর প্রান্তগুলো পরস্পরের সাথে ঘষা খেতে থাকে এবং বিভিন্ন মাপের নতুন হাড়ের দানা দেখা দেয়। এই হাড়ের দানাগুলো সুচালো ও ধারালো। এক্স-রে পরীক্ষায় এগুলো ধরা পড়ে। যদি এই তীক্ষ্ণ হাড়ের দানাগুলোর কোনোটি স্নায়ুমূলকে খোঁচা মারে তাহলে হাতে তীব্র ব্যথার উদ্রেক হয়। হাড়ের দানাগুলো মাঝে মধ্যে স্নায়ুরজ্জুকেও চাপ দিতে পারে এবং পায়ে অসাড়তা ঘটাতে পারে। ক্ষয়প্রাপ্ত ডিস্ক তার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে সরে যেতে পারে, সেটাকে বলে ‘স্লিপড ডিস্ক’। সে ক্ষেত্রে ডিস্ক স্নায়ুমূলের ওপর চাপ দিয়ে ব্যথা সৃষ্টি করে। স্লিপড ডিস্ক সাধারণত হয় দুর্ঘটনা, হঠাৎ পড়ে যাওয়া কিংবা ঘাড়ে আঘাতের কারণে। যা হোক, ডিস্কের স্থিতিস্থাপকতা হারিয়ে গেলে ক্ষয়প্রাপ্ত মেরুদণ্ডের নড়াচড়া সহজ হয় না।

স্পনডাইলোসিস সাধারণত ঘটে থাকে ঘাড়ের নিচের চারটি কশেরুকাতে, অর্থাৎ চতুর্থ থেকে সপ্তম কশেরুকাতে। ওপরের তিনটি কশেরুকায় স্পনডাইলোসিস খুব কম হয়, কারণ ওখানটায় খুব একটা চাপ পড়ে না। সার্ভাইকল স্পনডাইলোসিসের ব্যথা সর্বদা ঘাড়ের পেছন দিকে অনুভূত হয়, কখনোই ঘাড়ের সামনের দিকে অনুভূত হবে না। ব্যথা তীব্র হলে তা কাঁধে এবং বাহুর পেছনের দিকে কনুই পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। কখনো কখনো ব্যথা হাতে এবং আঙুলেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, করোনারি হৃদরোগ বা এনজিনার ব্যথা বাহুর ভেতরের পাশে অনুভূত হয় এবং সচরাচর তা আঙুলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ঘাড়ের নড়াচড়ায় এই ব্যথা বাড়ে না। কিন্তু সার্ভাইকল স্পনডাইলোসিসের ক্ষেত্রে ঘাড় নড়াচড়া করলে ব্যথা বেড়ে যায়। এ ছাড়া হৃৎপিণ্ডের ব্যথা সাধারণত বাঁ দিকে অনুভূত হয়।

রোগ নির্ণয়
স্পনডাইলোসিস হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এক্স-রে পরীক্ষা করা হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিটিস্ক্যান অথবা এমআরআই করা হয়ে থাকে।
এক্স-রেতে বিশেষ ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডিস্কের ক্ষয়। কশেরুকাতে বিভিন্ন মাপের নতুন হাড়ের দানা দেখা দিতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী অংশের ফাঁক কমে যায়।

সার্ভাইকল স্পনডাইলোসিসে স্নায়ুমূল আক্রান্ত হলে কিছু উপসর্গ প্রকাশ পায় :
– ব্যথা
– অসাড়তা
– শক্ত হওয়া।

যদি ডিস্ক সরে যায় এবং স্নায়ুরজ্জুর ওপর চাপ পড়ে তাহলে হাত অবশ হয়ে যেতে পারে। নতুন হাড় গজানোর জন্যও স্নায়ুরজ্জুতে চাপ পড়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

চিকিৎসাপদ্ধতি
সার্ভাইকল স্পনডাইলোসিসের কারণে ঘাড়ে তীব্র ব্যথা হলে সাধারণত নি¤œলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়-
১. ঘাড়ের নড়াচড়া বন্ধ রাখা
যেসব কাজকর্ম ঘাড়ে নড়াচড়া ঘটায় অবিলম্বে সেসব কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। ভ্রমণের সময় ঘাড়ে ঝাকি লাগে বলে ভ্রমণও বন্ধ রাখতে হবে। যারা অফিস করেন, কিছু দিন তাদের অফিস করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

ঘাড়ের অসঙ্গত নড়াচড়া রোধ করতে সার্ভাইকল কলার ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথম কিছু দিন ঘুমের সময়ও সার্ভাইকল কলার পরে থাকা ভালো- এতে ঘুমের মধ্যে অসাবধানতাবশত ঘাড়ের নড়াচড়া প্রতিহত হয়।

ঘুমানোর সময় ঘাড়টাকে চিত হয়ে কিংবা স্বাভাবিক অবস্থানের চেয়ে ১০-১৫ ডিগ্রি সামনের দিকে বাঁকিয়ে ঘুমানো উচিত। একটি স্বাভাবিক আকৃতির বালিশে ঘাড় সামনের দিকে বেশি বাঁকিয়ে থাকে। সুতরাং ঘুমানোর সময় এসব বালিশ পরিহার করতে হবে। ঘাড়ের মেরুদণ্ডকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য শোয়ার সময় খুব নিচু বালিশ কিংবা সার্ভাইকল পিলো ব্যবহার করতে হবে। মূলত এই বালিশ থাকবে ঘাড়ের নিচে।

২. ব্যথানাশক ওষুধ
ব্যথা থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তির জন্য ব্যথানাশক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। কখনো কখনো ব্যথা নিবারণের জন্য ইনজেকশনের প্রয়োজন হয়। ব্যথা কমানোর পর প্রকৃত চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

৩. গরম সেক
যখনই অস্থিসন্ধি বা হাড়ের গিরায় ব্যথা হয়, গিরার চারপাশের মাংসপেশিগুলো শক্ত হয়ে ওঠে এবং প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে গিরার সচলতা কমিয়ে দেয়। মূলত পেশির সঙ্কোচনের দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে শরীর প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়- এটাই আমরা করে থাকি সার্ভাইকল করার পরে। কিন্তু মাংসপেশির সঙ্কোচন বা টান যখন বেশি হয় তখন ব্যথা সৃষ্টি হয়।

তাপ হলো মাংসপেশিকে শিথিল করতে সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা। এ কারণে পেশিতে গরম সেক দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে হট ওয়াটার ব্যাগ, ইলেকট্রিক্যাল হিটিং প্যাড কিংবা ইনফ্রারেড ল্যাম্প ব্যবহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় গোসলের সময় ঘাড়ে গরম পানি ঢাললে।
অধিক পছন্দনীয় চিকিৎসাব্যবস্থা শর্টওয়েভ ডায়াথার্মি ও আল্ট্রাসাউন্ড হিট। এগুলো ফিজিওথেরাপিস্টরা দিয়ে থাকেন।

৪. ট্রাকশন
ডিস্ক সরে গিয়ে স্নায়ুমূলে চাপ সৃষ্টি করলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ট্রাকশন সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা। ট্রাকশনের ফলে দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী স্থান বৃদ্ধি পায় এবং এ কারণে স্নায়ুমূলের ওপর ডিস্কের চাপ শুরু হয়। ট্রাকশনের ওজন বাড়ানো কিংবা কমানো নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। বসে ট্রাকশন দেয়া যেতে পারে কিংবা শুয়েও দেয়া যেতে পারে। শোয়া অবস্থায় ট্রাকশন দিলে মাথার দিকের খাট ব্লক দিয়ে ৬-৯ ইঞ্চি উঁচু করে রাখতে হবে। ট্রাকশনের ফলে ব্যথা বেড়ে গেলে ট্রাকশন বন্ধ করে দিয়ে পদ্ধতিতে কোনো ত্রুটি আছে কি না তা পরীক্ষা করে সংশোধন করতে হবে।

৫. মালিশ বা ম্যাসাজ
ঘাড়ের টানটান পেশিগুলোকে শিথিল করতে মালিশ অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা। তবে ম্যাসাজ বা মালিশ করার সময় খেয়াল রাখতে হবে এসব যেন উল্টাপাল্টা করা না হয়। দুই কাঁধে এবং ঘাড়ে মালিশ করতে হবে ধীরে ধীরে। মাংসপেশিকে জোরে মুচড়ে দেয়া যাবে না, তাতে ক্ষতি হবে।

৬. ঘাড়ের মাংসপেশি শক্তিশালী করে তোলা
ঘাড়ের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়লে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পেশিগুলো যদি শক্তিশালী থাকে তাহলে মেরুদণ্ডের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে না, ফলে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিছু ব্যায়ামের মাধ্যমে ঘাড়ের মাংসপেশিকে শক্তিশালী করা যায়। তবে এসব ব্যায়াম করতে হবে প্রাথমিক ব্যথা মিলিয়ে যাওয়ার পর।

– হাত দুটো একসাথে করে মাথার সামনে ঠেকিয়ে মাথাটাকে সামনের দিকে চাপ দিতে হয়। হাতের ওপর মাথার চাপ বাড়বে, তবে হাত দুটোও মাথার ওপর সমান চাপ দেবে।
– হাত দুটো মাথার পেছনে নিয়ে মাথা পেছন দিকে চাপ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে হাত দুটো যেন মাথার সামনে চাপ দেয়।
– একইভাবে ডান হাত দিয়ে মাথার ডান দিকে ও বাম হাত দিয়ে মাথার দিকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। মাথাও সমানভাবে হাতের ওপর চাপ দেবে।

মূলত হাত ও মাথার পরস্পরের দিকে চাপ এমন হতে হবে যেন মাথা বাঁকিয়ে যেতে না পারে। অর্থাৎ হাত যত জোরে মাথার দিকে চাপ দেবে, মাথাকে তত জোরে বিপরীত দিকে ঠেলতে হবে।

৭. শক্ত পেশি শিথিল করতে ব্যায়াম
প্রাথমিক ব্যথা সেরে যাওয়ার পর সার্ভাইকল স্পনডাইলোসিসের রোগীরা শক্ত ঘাড়, পিঠের উপরি অংশ ও কাঁধের পেশি শিথিল করতে কিছু ব্যায়াম করতে পারেন-
– মাথা বাম ও ডানে ঘুরান।
– মাথা বাঁকিয়ে সামনের দিকে আনবেন। অতঃপর পেছনের দিকে নেবেন।
– মাথাকে ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘুরাবেন।
– কাঁধ দুটো ওপরের দিকে তুলবেন ও নামাবেন। তারপর কাঁধ দুটোকে ঘুরাবেন।
– হাত দু’টিকে নিজের দুই কাঁধের ওপর স্থাপন করে কনুই দুটো বৃত্তাকারে ঘুরাবেন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমাটোলজি বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।

চেম্বার : পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লি.
২, ইংলিশ রোড, ঢাকা। 
ফোন : ০১৭১৬২৮৮৮৫৫

Archives

April 2024
S S M T W T F
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930